প্রবাস জীবনে প্রথম আবাসের স্মৃতি

অস্ট্রেলিয়া এসে নতুন বাসাটা বাইরে থেকে দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু থাকতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে সমস্যাগুলো চোখে পড়তে শুরু করলো।

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2018, 06:43 AM
Updated : 28 June 2018, 06:43 AM

প্রথম অসুবিধা ছিল কাপড় শুকানোর কোন জায়গা ছিল না। আমরা কাপড় শুকাতে দেওয়ার একটা ছোট তাক কিনে আনলাম, কিন্তু রাখবো কোথায়? এর মধ্যে শুনলাম, সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি ছাড়া বাসার সামনে কাপড় শুকালে প্রতিবেশীরা অভিযোগ করতে পারে।

প্রথম কয়েকদিন বাসার ভেতরেই কাপড় শুকানো হল। কিন্তু এটা তো সাময়িক সমাধান, স্থায়ী সমাধান কীভাবে হবে? পরে আর কোন কিছু চিন্তা না করেই তাকটা বাইরে দিয়ে কাপড় শুকানো শুরু করলাম আমরা।

প্রথম দিকে খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি পুলিশ এলো। আর কাপড় বাইরে শুকাতে দিতে যাওয়ার সময় চারপাশটা ভালো করে দেখে নিতাম, যাতে কেউ কাপড় মেলার সময় আমাদের দেখে না ফেলে। এ যেন ঠিক চোর-পুলিশের লুকোচুরি খেলা।

পরে এসে বুঝলাম, আমাদের ভয়টা নেহায়েতই অমূলক ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো একটু জোরে বাতাস হলেই কাপড়সহ তাকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়তো। পরে উপরের বারান্দার খুঁটির সাথে একটা সুতলি দিয়ে টানা দিয়ে সেই সমস্যাটার একটা মোটামুটি সমাধান করা গেল। অবশ্য এরপরেও বেশ ক’বার তাক বাবাজি ডিগবাজি দিয়েছিল, কিন্তু সেটাতে আমরা আর খুব বেশি অবাক হই নাই।

দ্বিতীয় সমস্যায় ছিল কাপড় ধোয়া। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, হাত দিয়ে কাপড় কেচেই অভ্যস্ত। তাই সেভাবেই চললো বেশ কিছুদিন। কিন্তু এক সপ্তাহে যে পরিমাণ কাপড় জমা হতো, সেটা ধুতে গিয়ে অন্য অনেক কাজে দেরি হয়ে যেত। পরে বাড়িওয়ালার পরামর্শে আমরা একটা ছোট ওয়াশিং মেশিন কিনলাম।

সমস্যা হলো, ওয়াশিং মেশিনটার পাইপে শুধু ঠাণ্ডা পানিই আসে, গরম পানি আসে না। আর এদেশের ঠাণ্ডা পানি মানে অনেক ঠাণ্ডা পানি। তাই আমাদের বড় মানুষদের কাপড়ের ময়লাগুলো পরিষ্কার হচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাগুলোর কাপড়ের ময়লা আর সেভাবে পরিষ্কার হচ্ছিল না। তাই অবশেষে আবার হাতের উপরই ভরসা করতে হলো, তবে কিছুটা হলেও পরিশ্রম কমে গেলো- সেটাই বা কম কি?

তৃতীয় সমস্যা ছিল রান্নার ব্যবস্থা। রান্নার জন্য ছিল একটা ইলেকট্রিক চুলা, যেটা ছিল একের ভেতর তিন। সেটা একই সাথে হিটার, মাইক্রোয়েভ ওভেন এবং বার-বি-কিউ মেশিন। আমরা শুধু হিটারটাই ব্যবহার করেছি, বাকি সুবিধাগুলোর ব্যবহার আর শেখা হয় নাই। সেই হিটার চালাতে গিয়েও কতো ঝক্কি। এটা কীভাবে চালু করতে হয়, তাপমাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, টাইমার কীভাবে কাজ করে!

অবশেষে আমরা সেটাতে রান্না শিখে গেলাম। কিন্তু সেটা গরম হতে অনেক সময় নিত, তাই শুরুতে আমরা মনে করেছিলাম- এটা বোধহয় নষ্ট। এরপর আপনি রান্না করতে গেলে অনবরত নাড়তে থাকতে হবে। বিশেষ করে তরকারি। তা না হলে পাতিলের তলায় লেগে যায়। সেটাতেও আমরা দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।

সমস্যা বাঁধলো আমাদের ছেলে রায়ান হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করার পর থেকে। উনি উনার সব খেলনা বাদ দিয়ে চুলার কাছে যাবেন। চুলার হাঁড়ি-পাতিল ফেলে দেবেন। এখন চুলা কি জ্বালানো অবস্থায় না নেভানো, সেটা তো আর উনি বুঝবেন না। তাই সেটা আমাদের জন্য মোটেও নিরাপদ ছিল না।

চতুর্থ এবং সবচেয়ে মজার সমস্যাটা হলো- বাথরুম কাম টয়লেট নিয়ে। রায়ান হামাগুড়ি দেওয়ার আগ পর্যন্ত মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল। যদিও বাথরুমে কোন প্রকার লক ছিল না, কিন্তু রায়ান হামাগুড়ি দেওয়া শুরু করার পর শুরু হল মজার ঝামেলাটা।

যেই বাথরুমে যায়, তাকে তার প্রাতঃক্রিয়া বাদ দিয়ে খেয়াল রাখতে হয় দরজার দিকে। কখন রায়ান এসে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে। তাই আসল কাজের চেয়ে দরজার দিকেই মনোযোগ বেশি দিতে হয়। আরও একটা সমস্যা হলো রায়ানেরও পানির প্রতি গভীর প্রেম। তাই সে এমনিতেও মাঝে মধ্যেই বাথরুমে গিয়ে কমোডে হাত দিয়ে পানি ধরার চেষ্টাই থাকতো।

উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে সাথে নিয়েই আমরা চারজন প্রাণী ভালোই ছিলাম। কিন্তু চুলার সমস্যাটা আসলেই অনেক বড় সমস্যা। এটা থেকে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তারপরও যখন এই বাসাটা ছেড়ে যাচ্ছিলাম, কেন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

এই বাসার প্রতিটা দেয়াল আমার চেনা। কোথায় কী আছে আমার জানা। ঘুম থেকে উঠলেই কী কী চোখে পড়বে, সেটা আগে থেকেই ঠিক করা। বাসার প্রত্যেকটা দরজা-জানালাও আমাকে চেনে। বাসার বাইরের ঘাসগুলোও আমার বন্ধু।

বাসার সামনের যে গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে মাঝে মধ্যে আমরা রাস্তার দিকে নজর রাখি, সেও একলা হয়ে যাবে। বাসায় ঢোকার মুখের গেটের দুই পাশের ইটের থাম দুটাও হয়তো আমার মতো মন খারাপ করছে। আমি প্রায়ই তাহিরকে ওই দুটা থামের উপর দাঁড় করিয়ে দিতাম। গিন্নীর হাতে লাগানো ফুলগাছগুলোতে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। ওরাও হয়তো বা কাঁদবে তাদের অভিবাবকের জন্য।

বাসার সামনের চিরপরিচিত পার্কটায় হয়তো খেলতে আসা হবে খুবই কম। আমার দুর্বল মুহূর্তগুলোর সাক্ষী পার্কের বেঞ্চটাও একা হয়ে যাবে আবার। আমি আর চাইলেই রাত-বিরাতে মন উদাস হলে তার উপর শুয়ে আকাশের তারার সাথে কথা বলতে পারবো না। বৃষ্টি আসলেই আমরা বাপ-বেটি পার্কটাতে জমে থাকা পানিতে হাঁটতে যেতে পারবো না। জোরে বাতাস বইলে আর ঘুড়ি নিয়ে বের হতে পারবো না।

সারারাত ধরে ডেকে চলা সাথীহীন পাখিটা, যে ছিল আমার নির্ঘুম রাতগুলোর একমাত্র সাথী, সে-ও হয়তো আমাকে অনেক মিস করবে। এই পার্কটাতেই রায়ানের প্রথম হাঁটা শুরু, তাহিয়ার সাইকেল চালানো। পার্কের দোলনা দুটোতে ওদের ভাই-বোনকে বসিয়ে একই সাথে দোল দেওয়া হবে না হয়তো আমার। সন্ধ্যায় অস্তগামী সূর্যটার দিকে কেউ আর হয়তো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে তার কৈশোরের স্মৃতিচারণ করবে না। 

এগুলোতো গেলো প্রকৃতির প্রতি মায়া। মানুষের প্রতি মায়াটার কথা আর বলছি না। তাহলে আবেগকে সংবরণ করা মুশকিল হয়ে যাবে। তবে হয়তো এমনই অন্য কোন একটা বাসাতে আমরা আবার থাকা শুরু করবো। একসময় সেই বাড়ির সবকিছুকে আপন করে নেব। সেখানেও অবশ্যই এমনি কোন পার্কে আমরা মনের আনন্দে সবাই মিলে খেলা করবো।

মানুষের মন এক বিচিত্র জিনিস। সে অকারণেই তার স্মৃতিপটে অনেক অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি জমা করে রাখবে। বিশেষ করে প্রথম কোন কিছুর স্মৃতি মনে দাগ কেটে থাকে অনেকদিন। তাই অস্ট্রেলিয়াতে থাকাকালে ঘুরে ফিরেই মনে পড়ে যাবে এইসব স্মৃতি। অকারণেই মনটা ভারী হয়ে যাবে। হোক না ভারী, তা হলে আর আমরা মানুষ কীভাবে? আমরা তো যন্ত্র হয়ে যেতাম?

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!