বিজয়দার মতো গোছানো আর পরিপাটি মানুষ আমাদের বন্ধুমহলে দ্বিতীয়টি নেই। বিজয়দা, রুপা বৌদি, তাদের মেয়ে এলভিরা আর ছেলে রেনোর আগেই একদিন গিয়ে জায়গাটা দেখে এলেন। আমাদের কাছ থেকে জায়গাটার সৌন্দর্যের কথা লুকিয়ে রাখলেন যদিও।
আমি গুগল ম্যাপে গিয়ে নওরা শোগ্রাউন্ড লিখে সার্চ দিয়ে যে জায়গাটা পেলাম, সেটা একটা বিশাল খেলার মাঠ। এর তিন দিকে বন কিন্তু আশেপাশে বাচ্চাদের কোনো খেলার জায়গা নেই। তাই স্বভাবতই আমি একটু উদ্বিগ্ন বোধ করছিলাম, বাচ্চারা সারাদিন সময় কাটাবে কী করে?
অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে আমরা ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের বনভোজনের বাসে চড়ে বসলাম। মিন্টো থেকে নওরা প্রায় দুই ঘণ্টার বাস ভ্রমণ। তবে আপনি যদি সিটি থেকে যেতে চান, তাহলে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লাগবে।
এক ঘণ্টা পর আমরা লেক ইলাওয়ারাতে বিরতি নিলাম। সকালের হালকা খাবার সেরে নিলাম। ইতোমধ্যেই বাচ্চারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খেলাধুলো শুরু করে দিল। লেক ইলাওয়ারা জায়গাটাও অপার সৌন্দর্যের আধার। তাই আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, পরে কোনো একসময় আমরা এখানে বেড়াতে আসবো।
এরপর আবারও বাস চলতে শুরু করলো। আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর আমরা নওরা শোগ্রাউন্ডে উপস্থিত হলাম। বাস থেকে নেমে জায়গাটা দেখে তখনও বুঝতে পারিনি, আমাদের জন্য আসলে কতো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে!
বিজয়দা মাইকে সবাইকে জানালেন এখানে কী কী আছে। উনি বললেন, আমাদের পেছনে, মানে আমরা যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিকে বেনস ওয়াক নামে বুশওয়াক আছে। অস্ট্রেলিয়াতে বেশিরভাগ বনকেই ‘বুশ’ বলা হয়। বনের মধ্যে বুশ নামে একধরনের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মানোর কারণে এই নাম।
হ্যাংগিং রকের সামনে এসে শাওয়ালহেভেন নদীর দৃশ্যটা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আমরা দু’চোখ ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। কিন্তু এলভিরা তাড়া দিচ্ছিল- আমাদের তাড়াতাড়ি শুরু করা উচিৎ। সেখানকার দিক-নির্দেশনা দেখে আমরা বড়রা একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কোন দিকে যাব? তখন বাচ্চারা বলল, আমরা আগে দেখে আসি। ঠিক রাস্তা হলে তোমাদের ডেকে নিয়ে যাব।
ওরা কিছুদূর গিয়েই আলিশার ফোন থেকে কল দিয়ে জানালো, ওদের যাওয়ার পথটাই ঠিক আছে। তাই আমরাও ওদেরকে অনুসরণ করলাম। এরপর আমরা এগিয়ে চললাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। শুরুতেই অনেকটা ঘুরপথে নিচে নামতে হয়। সেই পথটা এতোটাই খাড়া যে ভুল করে পা ফসকে গেলে আর রক্ষা নাই। তাই আমরা সাবধানে পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম।
পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলেছে নওরা ক্রিক। তার উপরেই রয়েছে কাঠের পাটাতনের একটা ঝুলন্ত সেতু। আমরা সেতুর উপরে চড়ে সেটাকে দোল দিয়ে ভয় পাওয়ার মেকি অভিনয় করে পার হয়ে গেলাম। ক্রিকের ঠিক অন্যপাশেই মোটামুটি সমতল জায়গা। তাই আমরা ফিরে এসে পাহাড়ের পাদদেশ ধরে এগোনোটাকেই বেছে নিলাম। আর আমাদের গাইড এলভিরাও সেটাতেই সায় দিল। তারপর আমাদের প্রায় তিন ঘণ্টার ভ্রমণ শুরু হয়ে গেল।
অন্যপাশে নওরা ক্রিকের কাকচক্ষু জল। তার কিনারে ছোট ছোট লাজুক কাঁকড়ারা ঘর বানিয়েছে। আমাদের দেখলেই টুপ করে তাদের গর্তে ঢুকে পড়ছে। ক্রিকের পানিতে ছোট ছোট মাছ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে এবং পানি স্বচ্ছ হওয়াতে আমরা সেটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। মাছ দেখে ইলা ভাবী বললেন, এরপরে আমরা সবাই আবারও এখানে বেড়াতে আসবো এবং বড়শি নিয়ে এসে মাছ ধরব।
একটু পরপরই ক্রিকের পাড়ের গাছগুলো কাঁত হয়ে ক্রিকের পানির দিকে হেলে পড়েছে। পুলক ভাই সেই গাছ বেয়ে পানির উপরে গিয়ে আমাদের সাহস বাড়িয়ে দিলেন। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এরপর কোনো কাছ পেলেই আমরা চড়ে বসবো।
বলতে বলতেই পেয়ে গেলাম যুতসই একটা গাছ। সেখানে আমি, সোহেল আর পুলক ভাই চড়ে বসলাম। অবশ্য বাচ্চারাও হইচই শুরু করে দিল চড়ার জন্য। কিন্তু পিচ্ছিল পানিতে পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি বলে আমরা তাদেরকে নিরস্ত্র করলাম।
আমি আর রায়ান সবার শেষে যাচ্ছিলাম। কারণ, রায়ান প্রত্যেকটা বস্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে এগোচ্ছিল আর আমাকেও সঙ্গ দিতে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি মাথার উপর দিয়ে একটা অনেক মোটা লতা এগাছ থেকে ওগাছে গেছে। দেখেই আমি বনের রাজা টারজানের ভূমিকায় ঝুলে পড়লাম। আমার ঝুলে পড়া দেখে বাকিরা হৈ হৈ করে চলে আসলো। তখন একে একে পুলক ভাই আর ছোট-বড় সব বাচ্চায় একবার করে ঝুলে পড়ার আনন্দ নিল। তারা বলল- দিস ইজ দ্য বেস্ট পার্ট।
আমরা আরও সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। কারণ আমাদের যাওয়ার পথের পাশের নির্দেশিকা বলছিল, সামনেই ক্রিক পারাপারের বড় পাথর। আমরা আসলে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, পাথর দিয়ে কীভাবে মোটামুটি প্রশস্ত এই নদীটা পার হওয়া যাবে।
আরও বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর এলভিরা ফিরে এসে জানালো, সামনে রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে দেখলাম, আসলেই রাস্তা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু একটা অনেক বড় পাথরের পাশ দিয়ে একজনের চলার মতো রাস্তা নিচে নেমে গেছে। আমরা সে পথ ধরে এগোনো পর দেখলাম, বেশ কয়েকটা পাথর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীটার এপাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত চলে গেছে। সেটা দিয়েই আমাদের নদী পার হতে হবে।
সবাইকে সামনে দিয়ে আমি থেকে গেলাম পেছনে নদী পারাপারের ছবি তোলার জন্য। সবাই নদী পার হচ্ছে। আর প্রত্যেকের ছায়া কাকচক্ষু স্বচ্ছ জলে পড়ে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করছে। এই দৃশ্য শুধুমাত্র সামনাসামনি দেখলেই তার সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব। ভাষায় এর সৌন্দর্য প্রকাশ করা কঠিন ব্যাপার।
সেতু পার হবার পর আলিশা দিশা ভাবী আর নীলা ভাবীর সাথে যোগ দিয়েছিল। উনারা ইউয়ের অন্য পাশে চলে গেলেন কিন্তু আলিশা আমাদের সাথে থেকে গেল। এই সমতল জায়গাটাও অনেক সুন্দর। সামান্য কিছুদূর সমতল জায়গার পর আস্তে আস্তে জায়গাটা উঁচু হয়ে আবার পাহাড়ে রূপ নিয়েছে। দেখে মনে হল, এই জায়গাটা ছোটবেলায় পড়া মালভূমির বাস্তব রূপ।
আমরা হেঁটে হেঁটে সমতল জায়গাটা পার হয়ে আবার সেতু পাড়ি দিয়ে উঁচু ঢাল বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করলাম। উঠতে সবাই হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কারো চোখে-মুখে কোনো ক্লান্তি দেখলাম না। সবার মুখেই এক ধরনের দিগ্বিজয়ীর অভিব্যক্তি। বিশেষ করে বাচ্চারা বলাবলি করছিল, এটা তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার ছিল। শুনে খুবই ভালো লাগলো।
আমরা বড়রা পরিকল্পনা করে ফেললাম, এই জায়গাটাতে আবার বেড়াতে আসার। আর আমরা সবাই খুবই মিস করছিলাম আমাদেরই মতো অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় আরও একজন মানুষকে, যিনি অসুস্থতার কারণে আমাদের সাথে আসতে পারেন নাই। তিনি হচ্ছেন আমাদের রুপা বৌদি। যিনি পুরো অভিযানে আমাদের সাথে না থেকেও আমাদের সাথে ছিলেন।
আপনিও চাইলে যেকোনো ছুটির দিনে আপনার বাচ্চাদের নিয়ে এই অ্যাডভেঞ্চারে চলে যেতে পারেন। তবে দুইটা তথ্য আপনাকে মনে রাখতে হবে। প্রথমটা হলো- পায়ে জুতা বা কেডস পরে গেলে পাহাড়ে চলাচল করতে সুবিধা হবে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে- ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক বেশ দুর্বল। তাই সবাই খুব কাছাকাছি থাকলে যোগাযোগটা সহজ হবে।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: yaqub_buet@yahoo.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |