অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর শৈশবের স্মৃতিচারণা

আমাদের গ্রামীণ সমাজে মা-বাবার প্রতি আলাদাভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করার চল কখনোই ছিল না।  দৈনন্দিন কাজ-কর্ম নিয়ে সবাই এত বেশি ব্যস্ত সময় পার করে যে সম্পর্কগুলো আর আলাদাভাবে অনুভব করতে হয় না। 

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2017, 08:04 AM
Updated : 10 Oct 2017, 08:04 AM

মনে হয়, এভাবেই মা-বাবারা সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন সৃষ্টির আদি থেকে। আমি আমার মা আর কাকীদের সবসময়ই আমার মা ভাবতাম। শুধু সম্বোধনটাতেই ছিল তফাৎ। সেই শৈশব-কৈশোর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যতখানি পেয়েছি মায়ের আদর, ঠিক ততখানি বা তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি কাকীমাদের আদর।

এই দূর দেশে থেকে এখন যেমন মায়ের সাথে কথা হয়, একইভাবে কাকীমাদের সাথেও কথা হয়। সেদিন কথায় কথায় কাকীমা আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন, “বাবা চলি আসো লুচি আর লাবড়া রাঁধিছি।”

কথাটা শুনে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। কাকীমা এরপর একে একে বাসার সবার খবর দিচ্ছিলো আর আমি শুধু ‘হ্যা’ ‘না’ দিয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। কথা শেষে বেশ মন খারাপ হল। আর মনের পর্দায় একে একে আমার সব কাকিমার আদরের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলো।

আমাদের বাড়ির দুই বাড়ি পরেই আমাদের তিন ভাইয়েরই বাল্যবন্ধু বিদ্যুতের বাড়ি। আমাদের বাড়িতে ওদের যেমন অবাধ যাতায়াত, আমাদেরও ঠিক তেমনি ওদের বাড়িতে অবাধে যাতায়াত। বিশেষ করে, উৎসবের দিনগুলোতে আমাদের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যেত। কারণ ওরা যেমন আমাদের উৎসবে সক্রিয় অংশ নিতো, আমরাও তেমনি ওদের উৎসবে অংশ নিতাম এবং এখনও নেই।

এখনও বাড়ি গেলে সকাল বেলা ব্রাশটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাকীমাদের বাড়িতে যাই। উনার কলপাড়ে দাঁড়িয়েই দাঁত ব্রাশ করি। তারপর নাস্তার জন্য ভালো কিছু রান্না হলেই কাকীমার বাড়িতেই খাওয়া হয়। কিন্তু অনেকদিন পর দেশে গেলে মা-ও নাস্তা তৈরি করে অপেক্ষা করেন, তাই মা আর কাকীমার ওখানে কম এক্যাওয়া হয়। কিন্তু নাস্তা না খেলেও কাকীমার হাতের চা-টা অন্তত খেয়ে যাই।

তবে আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলো ছিল পূজার সময়টা। আমাদের বাড়ির রাস্তার অন্যপাশেই ছিল বরগী দাদুদের বাড়ি। উনার তিন ছেলে এক মেয়ে। ছেলেদেরকে কাকা আর মেয়েকে পিসি বলতাম। কাকারা ছিলেন প্রতিমা তৈরির কারিগর। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে উনাদের কাছে বায়না আসতো, আর উনারা সেই মোতাবেক প্রতিমা তৈরি করতেন। তাই প্রতিমা তৈরির প্রত্যেকটা ধাপের সাথে আমাদের খুব ভালো জানাশোনা।

একেবারে শুরুতে কাবারির (বাঁশের তৈরি চটা) গায়ে সুতলি দিয়ে বিচালি বেঁধে একটা অবয়ব তৈরি করা হত। তারপর সেটার গায়ে কাদামাটি লাগিয়ে ধীরে ধীরে মূর্তির রূপ দেওয়া হত। এরপর সেটাতে রঙ দিয়ে চোখ-মুখ ফুটিয়ে তোলা হত। আর সবশেষে চুল লাগানো এবং শাড়ি-গহনা পরানো হত। তারপর সেগুলো শহর থেকে লোকজন এসে নিয়ে যেত। নেওয়ার সময় মূর্তিগুলাকে এমনভাবে ঢেকে নেওয়া হত, যাতে কেউ দেখতে না পারে।

প্রতিমাগুলোর মধ্যে থেকে একটা রেখে দেওয়া হত উনাদের নিজেদের জন্য। এরপর শুরু হত পূজার উৎসব। পূজার অনুষঙ্গ হিসেবে সেই ক’দিন ধরে অনবরত চলতো ঢাক আর কাসার বাজনা। ঢাক আর কাসার বাজনা শুরু হলেই আমরা দৌড়ে চলে যেতাম মণ্ডপের সামনে। এরপর দেখতাম পূজার বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম। দিনে দিনে ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠলো, যেন এটা আর শুধু তাদের উৎসব নয়, এটা আমাদের উৎসবও।

পূজার সময়গুলোতে বরগী দাদুদের বাড়ি গিয়ে প্রসাদ খাওয়া থেকে শুরু করে সবই চলতো। এছাড়াও উনারা বাড়ি এসে খাবার দিয়ে যেতেন। বিশেষ করে, লক্ষ্মী পূজোর সময় উনাদের বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু দিয়ে যেত। আমি এক জীবনে অনেক সুস্বাদু খাবার খেয়েছি, কিন্তু লক্ষ্মী পূজোর এই খাবারগুলোর সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো খাবারের তুলনা আমি কখনোই করি না।

সবচেয়ে খারাপ লাগতো প্রতিমা বিসর্জনের দিন। সেদিন কাকীমা-দিদিমাদের মুখের দিকে তাকানো যেত না। প্রতিমাকে অনেক আদরে খাইয়ে পানি পান করিয়ে দিতেন। আর উনাদের দুই চোখ বেয়ে বয়ে চলতো অশ্রুধারা। যখন প্রতিমাগুলোকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হত, উনাদের সবার চোখই তখন শাড়ির আঁচলে ঢাকা থাকতো। যেন পরিবারের কোনো পরমাত্মীয়কে বিদায়ের মুহূর্তের অশ্রুধারা। আমি খুবই অবাক হয়ে ভাবতাম, একটা মাটির তৈরি মূর্তির জন্য মানুষের মনে এতটা ভালবাসা তৈরি হতে পারে!

কলেজে ওঠার পর পরিচয় হলো বন্ধু সুদিপ্ত’র সাথে। তখন থেকে আমার পূজা নিয়ে আনন্দটা এক অন্য মাত্রা পেল। দুর্গা পূজার সময় কাকীমার হাতের তৈরি লুচি আর লাবড়া সাবাড় না করলে আমাদের পূজার আনন্দ পূর্ণতা পেত না। এমনকি কলেজ জীবন শেষ করে বন্ধুরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও আমরা পূজার ছুটিতে একত্র হতাম। তারপর ঘণ্টা হিসেবে ভ্যান ভাড়া করে কুষ্টিয়ার সকল মন্দিরে গিয়ে প্রতিমা দেখা আমাদের জন্য একেবারে রুটিন হয়ে গেল। আর সবকিছুর শেষে সুদিপ্ত’র বাসায় গিয়ে কাকীমার হাতের লুচি-লাবড়া ভক্ষণ দিয়ে আমরা পূজার পর্ব শেষ করতাম।

আমরা বন্ধুরা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় একটু বেশিই খাওয়া-দাওয়া করতাম। আর খাওয়ার মধ্যে কাড়াকাড়ি করা ছিলা খাওয়া-দাওয়ারই অংশ। কাকীমা একা মানুষ, লুচি ভাজতেন। আর এদিকে আমরা দশ-বারোজন মিলে সেটা সাবাড় করতে থাকতাম।

কাকীমা ছোটখাটো মানুষ ছিলেন, আর গায়ের রঙ ছিল ফর্সা। আমাদের বিদায় দেওয়ার সময় কাকীমা যখন রান্নাঘরের বাইরে আসতেন, তখন দেখতাম গরমে-ঘামে কাকীমার মুখটা ভিজে লাল হয়ে আছে। কিন্তু মুখে একটা অপার্থিব হাসি। আমাদের বারবার জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের মনে হয় পেটভরে খেতে দিতে পারলাম না। আমরা যতই আশ্বস্ত করি না কেন, কাকীমা আমাদের কথা বিশ্বাস করতেন না।

এই মানুষটার সাথে আমার পরবর্তিতে ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। আমরা ঢাকা থেকে বাড়িতে গেছি, কিন্তু সুদিপ্ত যেতে পারছে না। তখন বাড়ি থেকে ফেরার সময় একবারের জন্য হলেও উনার সাথে দেখা করতে যেতাম। সব কথা শেষ হবার পরও উনি বাড়ির সদর দরজায় এগিয়ে দিতে এসে দাঁড়িয়ে আবারও গল্প শুরু করতেন।

কত আলাপ হত উনার সাথে। আমি বুঝতাম, উনার ছেলে আসতে পারে নাই, এটা নিয়ে মন খারাপ হচ্ছে কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করছেন না। নিজের ছেলের জায়গায় তখন আমাকে কল্পনা করে আমার সাথে কথা বলে সেই ক্ষতটা একটু পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমার মনে আছে, উনার বাসা থেকে বের হয়ে যাবার পর যতক্ষণ আমাকে দেখা যেত, উনি সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমি জানি না, এরপর উনি সেখানেই বসে নিজের ছেলের জন্য কান্না শুরু করতেন কিনা।

দেশ ছেড়ে আসার পর নিজেদের ঈদ বা রোজার মত উৎসবগুলো সবাই মিলে মোটামুটি পালন করে চলছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে হাহাকার করে চলছিল পূজার আনন্দ। অনেক খুঁজে-ফিরে অবশেষে এখানে মন্দিরের সন্ধান পেলাম। একদিন বিকালে আমরা বাপ-বেটি চলে গেলাম মন্দিরে। গিয়ে দেখি সেটা দক্ষিণ ভারতের মানুষদের মন্দির, সেখানে দুর্গা পূজা হয় না। তাই খুবই মন খারাপ হল।

আবারও মনে মনে খোঁজ শুরু করলাম, কোথায়-কবে দুর্গা পূজা হয়। অবশেষে ফেসবুকের মাধ্যমে খবর পেলাম, ‘আগমনী অস্ট্রেলিয়া’ বলে একটা সংগঠন পাশের সাবার্বে এবার দুর্গা পূজার আয়োজন করেছে। এটা জানার পর থেকেই আমি দিন গণনা শুরু করলাম। অবশেষে যেদিন প্রতিমা আসনে বসবে, সেই দিনটা এসে গেল। অফিস থেকে ফেরার পথে স্টেশনে নেমে আর বাসায় গেলাম না। সরাসরি চলে গেলাম মণ্ডপে। কিন্তু বিফল মনোরথে ফিরতে হলো সেদিন। কারণ, তখনও লগ্ন না হওয়াতে প্রতিমা আসনে বসে নাই। খুবই মন খারাপ করে চলে এলাম সেদিন।

পরেরদিন আবারও গেলাম। দেখি, প্রতিমা আসনে বসে গেছেন আর তার সামনে দুই দাদা একজন ঢাক অন্যজন কাঁসা বাজিয়ে চলেছেন। ঢাক আর কাঁসার বাজনা শুনে আমার চোখটা মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেল। মনে হল, আমি যেন আমার গ্রামের বাড়িতে বরগী দাদুদের বাসার সামনের মণ্ডপে দাঁড়িয়ে পূজা দেখছি। অনেকক্ষণ ধরে শুনলাম সেই শব্দ। তারপর চলে আসলাম। আসার সময় পা আর এগুচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, আরও কিছুক্ষণ থাকি, আরেকটু বাজনা শুনি। কিন্তু বিধি বাম! সময়ের বাস্তবতায় চলে আসতে হল।

এরপর সুযোগ খুঁজছিলাম, কবে বাচ্চাদের নিয়ে যাবো ওখানে। শনিবার ছুটির দিন হওয়াতে আর স্কুল হলিডে থাকায় ওদেরকে নিয়ে একেবারে সকাল সকাল হাজির হলাম। কিন্তু এইবারও বিধি বাম! অত সকালে মণ্ডপ খোলেনি। তাই বাইরে থেকেই ঘুরে চলে আসতে হল।

পরে ফেসবুকের মাধ্যমে এক দাদার কাছ থেকে জানলাম, একটু পরেই খুলবে। আমরা আবার দুপুরে হাজির। দেখলাম, সবাই প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। কারণ সেদিন ছিল বিজয়া দশমী, পূজার শেষ দিন। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢাক আর কাঁসার বাদ্য শুনছিলাম। আমার ছেলেটা এই প্রথম এত জোরে কোনো বাজনা শুনলো। তাই কিঞ্চিৎ ভয় পাচ্ছিল। যদিও যেকোনো ধরনের গান-বাজনা তার অনেক পছন্দ।

পরে দাদারা আমাদেরকে প্রতিমার সামনে বসিয়ে ছবি তুলে দিলেন। কিন্তু ক্যামেরার বিশাল কালো নলের মত অংশটা দেখে ছেলেটা ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেওয়াতে আমি ওকে নিয়ে বাইরে চলে আসলাম। কিন্তু মেয়েটা বেশ উপভোগ করছিল। তাই ওকে আরও কিছুক্ষণ ভেতরে বসিয়ে আমরা বাইরে হাঁটাহাঁটি করলাম। তারপর চলে এলাম। আসার পথে আমাদের দু’জনেরই অনেক মন খারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো হত।

এই পরবাসে এসে দুর্গা পূজা দেখতে পেয়ে, ঢাক-কাঁসার বাদ্য শুনে বারবার শৈশবের সেই রংধনু দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিলাম। কত স্মৃতি, কত কথা মনের মধ্যে ভিড় করছিল! একই সাথে বরগী দিদিমা, পাশের বাড়ির কাকিমা, বন্ধু সুদিপ্ত’র মায়ের মুখটা চোখে ভাসছিল। বারবার চোখটা ভিজে যাচ্ছিল। সময়ের পরিক্রমায় আজ আমি সবার কাছ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আগমনী অস্ট্রেলিয়ার এই দুর্গা পূজা আমাকে আবার আমার মায়েদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। 

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!