পরবাসী মানুষের গল্প

দেশান্তরি হওয়ার আগে মনে স্বাভাবিকভাবেই একটা আশঙ্কা ছিল, নতুন পরিবেশে কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নেব। কিন্তু দেশান্তরি হওয়ার পর আমার সেই আশঙ্কা অমূলক বলে প্রমাণিত হলো।

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2017, 05:18 AM
Updated : 18 May 2017, 05:18 AM

নতুন দেশে নতুন পরিবেশে এসে মানুষের যে পরিমাণ সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়েছি, সেটা লিখে শেষ করা যাবে না। তার মধ্যে থেকে আজ কয়েকটা বলার চেষ্টা করবো।

নতুন দেশে এসে মানুষকে সর্বপ্রথম যে ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেটা হলো বাসা ভাড়া নেওয়া। নতুন দেশে মানুষের প্রথমে কোন আয়ের পথ থাকে না, তাই রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো বাসা ভাড়া দিতে চায় না। এক বড় ভাই এবং বাংলাদেশি এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বদৌলতে আমাদের সেই ঝক্কি পোহাতে হল না।

বাড়ির মালিকের শেষ নাম দেখে ধারণা করেছিলাম, উনি অবশ্যই বাঙালি। তবে একটু দ্বিধা ছিল। দ্রুতই বাড়িওয়ালার সাথে পরিচয় এবং সেই সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে গেল।

বাড়িওয়ালি, মানে বৌদি পর্তুগালের মানুষ, সদা হাসিখুশি। আমার গিন্নীর সাথে দ্রুতই বৌদির খাতির হয়ে গেলো, যদিও ভাষা অনেক বড় একটা বাধা হিসেবে কাজ করছিল। আমার গিন্নী প্রায়ই বলতো, আমি তো ওনার ইংরেজি বুঝি না। শুধু ‘ইয়েস’ ‘নো’ দিয়ে কাজ চালিয়ে নেই।  আমি বললাম, ব্যাপার না, এতেই হবে। আসলে দু’জন মানুষের মানসিকতা এক হলে আর সম্পর্কের মধ্যে সততা থাকলে কোন বাধাই বাধা হতে পারে না।

বৌদি দাদার কাছ থেকে বাঙালি রান্না শিখে নিয়েছেন এবং প্রতিদিন উনি আমাদের বাসায় তার রান্না করা খাবার দিয়ে যেতে লাগলেন। আমরা তো লজ্জার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমরা তো তেমন কিছুই রান্না করি না যেটা তাদেরকে দেওয়া যায়। তারপরও সপ্তাহে হয়তো দুই-একদিন আমরা একটা কিছু রান্না করে তাদের সাথে সেটা শেয়ার করার চেষ্টা করতাম।

আমার মেয়ে অবাধে ওনাদের বাড়িতে গিয়ে খেলাধুলা শুরু করে দিল। বৌদিও নিজের বাচ্চাদের নিয়ে বের হওয়ার সময় আমার মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যেতে লাগলেন। হ্যালোইন উৎসবের সময় আমার মেয়েকেও সাজিয়ে ওনাদের সাথে নিয়ে নিলেন, তারপর সারা পাড়া ঘুরে একগাঁদা চকলেট নিয়ে বাসায় ফিরলেন। আমার দেড় বছরের ছেলের জন্যেও উপহার নিয়ে আসলেন।

মেয়ের জন্মদিনেও উনি উপহার নিয়ে আসতেন, যদিও কাউকে দাওয়াত দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বড়দিন, ইস্টারে উনি আমাদের জন্য উপহার আনতেন। গিন্নি মাঝে মধ্যে কোথাও বের হলে ওনার কাছে বাচ্চাদের রেখে যেতে শুরু করলেন। এমনকি, আমরা বাসা বদলানোর পর উনি আমাদের নতুন বাসায় আমাদের জন্য একগাঁদা উপহার নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এভাবে একজন অন্য ভাষার ভিনদেশি মানুষ খুব দ্রুতই আমাদের পরিবারের আপনজন হয়ে উঠলেন।

প্রতিবেশী আরলিনের দেশ ফিলিপাইন, পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কাজ করেন একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে। চলতে-ফিরতে তার সাথেও পরিচয় হয়ে গেলো। সে বললো, কোন কিছুর দরকার হলে যেন তাদেরকে জানাই।

আমার চাকরি হওয়ার আগে আরলিনের গিন্নি আমার গিন্নিকে বলেছিল, আমি যেন আরলিনের সাথে কথা বলি। আমিও যেহেতু সিভিল ইঞ্জিয়ার, তাই হয়তো কাজ পেতে সাহায্য হতে পারে।

বড়দিনের সময় আমাদের বাসার দরজার সামনে একগাঁদা উপহার রেখে গিয়েছিলেন। আমি সেটা টের পেয়ে যাওয়াতে আরলিনের গিন্নি আমাকে বললো, ধরা পড়ে গেলাম যে?

ওনাদের বাচ্চাদের ঘুড়ি উড়ানো দেখে আমি বললাম, তোমরা এই ঘুড়ি কোথায় পেলে? তারা আমাকে বললো, এগুলো সাধারণত সেলে পাওয়া যায় এলডিতে। আমি বললাম, তোমরা যদি কোথাও পাও, আমাকে জানিও।

পরের সপ্তাহে আমাদের ডেকে বললো, আমার বাচ্চাদের একটা পরী ঘুড়ি আছে, তোমার মেয়ের পছন্দ হলে নিতে পারো। আমার মেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে, ওরা আর এগুলো উড়ায় না।

ঘুড়িটা ছিল খুবই সুন্দর, প্রত্যেকটা পাতায় একজন করে পরীর ছবি আঁকা। আমরা অনেকদিন সেই ঘুড়ি বাসার সামনের মাঠে উড়িয়েছি। ঘুড়িটা একটু বেশিই বড় আকারের ছিল, তাই আমার মেয়ের সাথে আমাকেও মাঝে মধ্যে নাটাই ধরে থাকতে হত।

বাসা পরিবর্তনের দিন আমাদের ফ্রিজটা গাড়িতে উঠাতে আমি আর আশফাক ভাই হিমশিম খাচ্ছিলাম দেখে আরলিন এসে বললো, তোমাদের কি সাহায্য লাগবে?

আমরা ‘হ্যা’ সূচক ঘাড় নাড়াতে সে আমাদের সাথে কাজে লেগে পড়লো। ফলে আমরা সহজেই ফ্রিজটাকে গাড়িতে তুলতে পারলাম। মানুষ যদি মানুষের বিপদে এগিয়েই না আসে, তবে সে কীসের মানুষ?

আমাদের বাসাটা রাস্তার তেমাথায় হওয়াতে রাস্তা দিয়ে যত মানুষ হেঁটে আসা-যাওয়া করতো, তাদের সাথে দেখা হত এবং কথাও হত। একদিন আমরা বাইরে যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছি। আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে এক ভদ্রলোক বললেন, তোমরা  কি ইন্ডিয়ান? আমি বললাম, না, বাংলাদেশি। সঙ্গে সঙ্গে তার তড়িৎ উত্তর, ও তোমরা সেই দেশের লোক, যারা গার্মেন্টসের লোকেদের পাওনা মজুরি দাও না।

আমি তো শুনেই অবাক! পরে অবশ্য আমি তাকে ভেঙে বলে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর যতবারই দেখা হত, কুশল বিনিময় হত, পরিবারের খবর আদান-প্রদান হত। আমার ছেলে এবং মেয়েকে উনি খুবই পছন্দ করতেন। আমার ছেলেকে দেখলেই বলতেন, হাউ আর ইউ ব্যাম্বিনো? আমার মেয়েকে দেখলেই জিজ্ঞেস করতেন, হাউ আর ইউ ইয়াং লেডি?

আমার ছেলে-মেয়ের সর্দি জ্বরের খবর শুনে বুদ্ধিও দিতেন। বলতেন, বেশি করে সবজি খাবে আর কম কম দুধ খাবে। কারণ দুধে মিউকাস আছে, এটা ঠাণ্ডা বাড়িয়ে দেয়। ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়াবেন, তাহলেই না আপনি পরিপূর্ণ মানুষ।

স্টেশনে যাওয়ার পথে দেখতাম, এক ভদ্রলোক আমার উল্টো দিকে যাচ্ছেন। মুখের ভঙ্গি বেশ গম্ভীর, কানে হেডফোন। এরকমভাবে বেশ কয়েকদিন দেখার পর আমি নিজেই একদিন তাকে ‘গুড মর্নিং’ বলে শুভেচ্ছা জানালাম। উত্তরে উনি আমার চেয়েও আন্তরিকভাবে আমায় শুভেচ্ছা জানালেন। এরপর সপ্তাহের পাঁচদিনই তার সাথে দেখা হতে লাগলো এবং আমি আর কোনদিনই ওনার আগে শুভেচ্ছা জানাতে পারি নাই।

শুভেচ্ছা জানানোর সাথে সাথে টুকিটাকি কথাবার্তাও হত। সোমবারে যেমন বলতেন, আই হেট মানডে। সেটা শুনে আমিও বলতাম, মি অলসো। মঙ্গলবার-বুধবার এলেই বলতেন, আর মাত্র দু’দিন বা তিনদিন, তারপরেই শুক্রবার।

বৃহস্পতিবারে আমরা খুবই খুশির স্বরে শুভেচ্ছা জানাতাম, কারণ পরেরদিন শুক্রবার। আর শুক্রবারে আমাদের কণ্ঠে খুশি ঝরে পড়তো। একে অপরকে সুন্দর সপ্তাহান্তের শুভেচ্ছা জানাতাম। এছাড়াও আজকের সকালটা কেমন, দিনটা কেমন যাবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ হত। ইদানিং আর ওনার সাথে দেখা হয় না, মনে হয় কাজ বদল করেছেন।

স্টেশনে আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি, ঠিক সেইখানেই এক বয়স্ক ভদ্রলোকও একই ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করেন। বেশ রাশভারী চেহারা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এই বুঝি আপনাকে ধমক দেবে। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, গুড মর্নিং। এরপর থেকে ওনার সাথে প্রতিদিনই শুভেচ্ছা বিনিময় হচ্ছে।

স্টেশনে যাওয়ার পথে এমনই আরও দু’জন লোকের সাথে ঠিক একইভাবে পরিচয় হয়েছে এবং আমাদের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। গত সপ্তাহ থেকে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হয়েছে। উনি থাকেন আমাদের পাশের গলিতে। আমি বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটার পর তার গলিটা পড়ে।

সকাল সকাল হঠাৎ নাকে সিগারেটের গন্ধ লাগলো। চিন্তা করলাম, এত সকালে এখানে আবার কে ধুমপান করলো? সামনে তাকিয়ে দেখি ভদ্রমহিলা বিড়ি ফুকতে ফুকতে যাচ্ছেন। আমি মনে মনে বললাম, খবিশ বেটি সকাল সকাল বায়ুদূষণ করছো? কাছাকাছি গিয়ে ওনাকে পার করার সময় বললাম, গুড মর্নিং। হয়ে গেলো দোস্তি।

গতকাল জিজ্ঞেস করলো, তুমি কোথায় কাজ কর? আমি বললাম, বোটানি, আমার বাসা থেকে আসতে ট্রেন-বাস মিলিয়ে দুই ঘণ্টা লাগে।

শুনে আতকে উঠে উনি বললেন, তোমার ভালো হোক।

আজ সকালে বাসা থেকে বের হতে হতে আমার একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই প্রতিদিন ওনার সাথে যেখানে দেখা হয়, উনি তারচেয়ে একটু এগিয়ে গেছেন এবং পেছনে তাকাচ্ছেন। আমি তাকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়লাম। কাছাকাছি আসতেই শুভেচ্ছা বিনিময় হল। সেই সাথে হালকা কিছু কথা, যেমন- আজ বললেন, শীতকাল আমার প্রিয় ঋতু। কারণ শীতকালে গরম কাপড় পরা যায়, কিন্তু আমি গ্রীষ্মকালকে ঘৃণা করি ইত্যাদি।

আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়ার অন্যতম বড় সুবিধা হচ্ছে- পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া। আপনি সামান্য দুই-একটা শব্দ বলেই একজন সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষের আপনজন হয়ে যাচ্ছেন। ভৌগলিক সীমারেখা বা ভাষাগত এবং ধর্মগত ব্যবধান যেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

তাই নিচের দুইটা উদ্ধৃতি আমার সবচেয়ে প্রিয়-

“জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে

 সে জাতির নাম মানুষ জাতি” – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত

“শোন মানুষ হে ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” –চণ্ডীদাস

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

ছবি: ইন্টারনেট

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!