ওয়াটামোলা সৈকত: শৈশবের পুকুর পাড়

বন্ধু আশিক জানালো ‘ওয়াটামোলা’ বলে একটা জায়গা আছে। আমার বাসা থেকে নাকি এক ঘণ্টার রাস্তা। আর সিডনি থেকে ঘণ্টাখানেক লাগে।

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2018, 04:30 AM
Updated : 24 April 2018, 04:30 AM

যাওয়ার রাস্তাটাও শুনলাম অনেক সুন্দর, আঁকাবাঁকা। রাস্তার দু’পাশে ঘন বন। বন্ধুপত্নী লাবণ্য ভাবীও আশিকের কথায় সায় দিয়ে সম্মতি জানালো। বাচ্চাদের জন্যে ওখানে হ্রদের মতো একটা জায়গা আছে, সেটাতে কোনো স্রোত না থাকায় ও অগভীর হওয়ায় বাচ্চারা সহজের নামতে পারে শুনলাম।

পরদিনই আমরা ওয়াটামোলা যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেললাম। সকালবেলা উঠেই তৈরি হয়ে নিলাম। সবাই সাঁতারের পোশাক আর খাবার নিলাম। রওয়ানা দিয়ে এম ফাইভ মোটরওয়ে ধরে কিছুদূর এগোনোর পর হিথকোট রাস্তায় এক্সিট নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। তখন আমরা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে রাস্তার দু’পাশের বনের চিত্র দেখতে লাগলাম।

দুই পাশের সমস্ত গাছ ক’দিন আগের বুশ ফায়ারে জ্বলে গিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। সেই দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। ভেড়ার গা থেকে লোম ছাড়িয়ে নেওয়ার পর তাকে যেমন বদখত দেখায়, বনের গাছগুলোকে দেখে আমার সে কথাই মনে হচ্ছিল।

তাহিয়াকে বললাম, কয়েকটা ছবি তুলে ফেলতে। এরপর হিথকোট রোড পার হয়ে প্রিন্সেস হাইওয়ে পার হয়ে আমরা রয়াল ন্যাশনাল পার্কের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললাম। এতক্ষণের পোড়া দৃষ্টি এখানকার গাছগুলো দেখে কিছুটা শান্ত হলো।

রয়াল ন্যাশনাল পার্কের একেবারে শেষ প্রান্তে রাস্তার ঠিক মাঝ বরাবর একটা টঙ ঘর চোখে পড়ল। তাহিয়া বলল, “বাবা, আমি এর আগেও এখানে এসেছি আমার বান্ধবী জেইনাদের সাথে। এই ঘরটাতে টোল দিয়ে যেতে হয়।”

মাত্র বারো ডলার টোল, কিন্তু আমার কাছে নগদ টাকা ছিলো না। দায়িত্বরত লোকটি আমাকে একটা রশিদ দিয়ে জানালেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে দিয়ে দিলেই হবে। আর আমি যেখানেই গাড়িটা পার্ক করি না কেনো, এই রশিদটা আমার ড্যাশবোর্ডে রেখে দিতে হবে যেন দেখা যায়।

রশিদ নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ওয়াটামোলা পিকনিক স্পটে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এখানে গাড়ি পার্ক করে সবাই দলে দলে বিভিন্ন বেঞ্চে বসে গিয়েছে। এখানে বারবিকিউ করার ব্যবস্থাও রয়েছে আর রয়েছে টয়লেট ও চেঞ্জ রুম।

আমি আর রায়ান ছেলেদের রুমে আর তাহিয়া ওর মায়ের সাথে মেয়েদের চেঞ্জ রুমে গিয়ে পোশাক পাল্টে আরও সামনে এগিয়ে গেলাম। সামান্য কিছুদূর যেতেই খাড়া ঢালু রাস্তা বিচের দিকে নেমে গিয়েছে। সেটা ধরে গেলেই ওয়াটামোলা সৈকত। সেখানে অনেক মানুষের ভীড়। সবাই বালির মধ্যে মাদুর পেতে শুয়ে সূর্যস্নান করছে। তার পেছনেই ঝাউবন।

আমরা মাদুর আনতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে ঝাউবনের মধ্যে একটু ঘাস খুঁজে সেখানে ব্যাগপত্র রেখে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিলাম। সবার আগে রায়ান দৌড়ে পানিতে নেমে গেল। তার পেছনে তাহিয়া আর সবশেষে আমি। রায়ান-তাহিয়ার মতো অনেকেই পানিতে নেমে খেলা করছে। কেউবা সৈকতে স্যান্ড বাকেট নিয়ে বিভিন্ন রকমের আকৃতি বানাতে ব্যস্ত।

এখানকার পানি অনেক পরিষ্কার। একেবারে নিচ পর্যন্ত দেখা যায় আর এখানে মাছেরও আনাগোনা আছে। আপনার পাশ দিয়েই পানির মধ্যে মাছের সাঁতরে যাওয়া দেখতে অনেক ভালো লাগবে। উল্টোপাশেই পাহাড়ের খাড়া পাড়। সেখান থেকে অনেকেই পানিতে লাফ দিচ্ছে।

তাহিয়া বললো, “না বাবা, এখানে লাফ দেওয়ার অনুমতি নাই। কারণ, টোল দেওয়ার সময় টঙ ঘরের সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম জাম্পিং রকটা কি এই রাস্তাতেই পড়বে? উনি বলেছিলেন এই রাস্তাতেই পড়বে, কিন্তু সেখান থেকে লাফ দেওয়া যাবে না।”

তবুও ওকে অনেক বুঝিয়ে যখন লাফ দেওয়ার জন্য উপরে যেতে শুরু করলাম, রায়ান পিছু পিছু আসা শুরু করলো। অবশেষে ওর মা ওকে কোলে নিয়ে নিরস্ত্র করলো। আমি আবারও নামার খাড়া পথ ধরে উঠা শুরু করলাম। লাফ দেওয়ার জায়গাটা লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরা। দামাল ছেলেমেয়েরা সেটাই পার হয়ে ভেতরে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে।

আমি লোহার গ্রিলটা টপকিয়ে ভেতরে গিয়ে নিচে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম। নিচ থেকে জায়গাটাকে যতোটা অগভীর মনে হচ্ছিলো, আসলে জায়গাটা তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর। তবুও দামাল ছেলেমেয়েরা সেখান থেকেই অবলীলায় লাফ দিচ্ছে। এমনকি অনেকেই সোজা এবং উল্টো ডিগবাজির ভঙ্গিতেও ঝাঁপ দিচ্ছে।

আমি সাহস সঞ্চয় করার জন্য তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, “পানির মধ্যে কিছু নাই তো, যেমন- পাথর বা খড়কুটো।” ওরা বলল, “মোটেও না। আর পানি এতোই গভীর যে পানির নিচ পর্যন্ত যাওয়াই যায় না।”

আমি আমার কপালের ডানপাশের কাটা দাগ দেখিয়ে বললাম, “ছোটবেলায় শানবাঁধানো পুকুরের ঘাটে ডাইভ দিয়ে পানির মধ্যের একটি ধাপে আঘাত পেয়ে কেটে গিয়েছিল।” ওরা আমাকে আবারও অভয় দিয়ে বলল, এখানে এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা মোটেও নেই।

একজনকে দেখলাম, ঝাপ দিয়ে দ্রুতই পাশের পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে এসে আবারও লাফ দিচ্ছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কতোবার লাফ দিয়েছো?” সে বলল, “আমি এর মধ্যেই দশবার লাফ দিয়েছি, আরও কয়েকবার দেব।” আমাকে অভয় দিয়ে বলল, “চলো, আমরা একইসাথে লাফ দেই।” আমি বললাম, “আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে নেই। তারপর ঝাঁপ দেব।”

অবশেষে কিছুদূর দৌড়ে এসে নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে দিলাম। তারপর মাত্র কয়েক সেকেন্ড শূন্যে ভেসে পানিতে পড়লাম। ভয়ে শরীরের অবস্থান ঠিক রাখতে পারি নাই, তাই এলোমেলোভাবে পানিতে আঘাত করে সামান্য ব্যথাও পেলাম। কিন্তু যে উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে গেলাম, সেটা অতুলনীয়। তাই সাঁতরে তীরে এসে আবারও লাফ দিতে চাইলাম।

যেখান থেকে লাফ দেওয়া হচ্ছিল, সেখানেই নিচে আরও একটা ছোট পাথর রয়েছে। অনেকেই পাথরের গা বেয়ে উঠে সেখান থেকে লাফ দিচ্ছে। পাথরের উচ্চতা কম হওয়াতে অনেকেই সেখান থেকেও লাফ দিচ্ছিল। আমি ফিরে আসার সাথে তাহিয়া বলল, “বাবা, আমিও লাফ দেব।” আসলে ছোট বাচ্চারা এমনই, একটু আগেই সে আমাকে লাফ দিতে নিষেধ করছিল আর এখন আমার আনন্দ দেখে সে নিজেই লাফ দিতে চাইছে!

অনেক বুঝিয়ে ওকে নিরস্ত্র করে আমি আবারও লাফ দিতে চলে গেলাম। আমাকে লাফ দেওয়ার জায়গায় দেখে একজন চাইনিজ ভদ্রমহিলা বললেন, “তুমি আবার এসেছো।” কারণ সে আমাকে আগেরবারও ঝাঁপ দিতে দেখেছে, কিন্তু সে নিজে সাহস করে উঠতে পারছে না। সাথে তার ছেলেমেয়ে ও স্বামীও রয়েছেন। ছেলেটা দুষ্টুমি করে একবার বোনকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার ভঙ্গি করতেই মেয়েটা অনেক ভয় পেয়ে পাড়ের কাছ থেকে সরে গেলো।

উনি আমাকে বললেন, “আমি ছোটবেলায় অনেক লাফ দিয়েছি কিন্তু এখন আর সাহসে কুলাচ্ছে না। এমনকি আমি ঘুমের মধ্যেও লাফ দেওয়ার স্বপ্ন দেখলাম।” এভাবে তার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে আবারও লাফিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। দেখি নিচে থেকে আমার গিন্নী লাফ দেওয়ার ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করে আছেন।

আবার লাফিয়ে পড়ে তার কাছে ফিরিতেই সে বলল, “তুমি উপরে যাওয়ার পর থেকেই আমি ক্যামেরা তাক করে থাকি, কিন্তু তুমি তো আর সাথে সাথেই লাফ দেও না। তাই ভালোমতো ছবি তুলতে পারছি না।”

এভাবে আমি আরও দুই বার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তারপর গিন্নী বললেন, “চলো, সবাই মিলে অন্যপাশে সমুদ্রের দিকে যাই।” আমরা সবাই মিলে সমুদ্রের দিকে চলে এলাম। সেখানেও অনেক মানুষ পানিতে নেমে পড়েছেন। আসল সমুদ্রের গা থেকে অনেকটা ঘোড়ার খুড়ের আকারে সমুদ্র এখানে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। স্রোত নেই তেমন একটা। শুধু উঁচু ঢেউ এসে সৈকতে ভেঙে পড়ছে।

আমরা আবারও হইহই করে নেমে পড়লাম। তাহিয়া সাঁতরে বেশ অনেকদূর চলে গিয়ে আবার ফিরে আসছিলো। সে একবার বলল, “বাবা, চলো আমরা অনেকদূর যাই। অনেকেই তো অনেকদূর পর্যন্ত যাচ্ছে।” কিন্তু আমি যেতে পারলাম না রায়ানকে সামলাতে ব্যস্ত থাকায়। দেখলাম, সমুদ্রের সাথে এই গোলাকৃতি জায়গাটার সংযোগস্থলে অনেকেই বসে গেছেন। তবে উনারা মাছ পেয়েছেন কিনা সেটা আর জানা হয়নি।

এখানে অনেকক্ষণ ধরে লাফালাফি করে আমরা আমাদের ব্যাগপত্রের কাছে ফিরে এলাম। রায়ান অনেক কাঁপছিল, তবুও ফিরে আসার জন্য তৈরি ছিল না। অনেকটা জোর করেই ওকে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিয়ে আমরা ফেরা শুরু করলাম।

ভ্রাম্যমাণ সেতুটা পার হয়ে খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠতে গিয়ে আমরা একেবারে হাঁপিয়ে উঠলাম। পরে চেঞ্জরুমে গিয়ে কাপড় বদলে একটা বেঞ্চে বসে সাথে আনা খাবার ধ্বংস করা শুরু করলাম। খাবার শেষ হলে তাহিয়া বলল, “বাবা, আমি ভ্রাম্যমাণ আইসক্রিমের দোকান থেকে আইসক্রিম খেতে চাই।” ওর মা অনেক খুঁজে ওকে কিছু ডলার দিলে সে আইসক্রিম খেতে শুরু করল।

এই ফাঁকে আমি জায়গাটার কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। কারণ, উত্তেজনায় আমি ছবি তোলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঝাঁপ দেওয়ার জায়গাটাতে দাঁড়ালে যে দৃশ্যটা আপনি দেখবেন, সেটা খুব বেশি সুন্দর। আপনি পানিতে ঝাঁপ দিতে পারেন বা না পারেন, এখানে যদি সামান্য সময় চুপচাপ বসেও থাকেন, তাহলেই আপনার ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।

তবে একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা দরকার। এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক একেবারেই নেই।  তাই আপনার কোনো দরকারি কথা থাকলে ওয়াটামোলাতে যাওয়ার আগেই সেরে নিতে হবে। এইবারে যাওয়াটা ছিলো হঠাৎ করেই অনেকটা আগেই গিয়ে জায়গাটা দেখে আসার মতো।  ভ্রমণ শেষে এমন একটা জায়গার সন্ধান দেওয়ার জন্য বন্ধু আশিক, লাবণ্য ভাবী আর জেইনার মা’কে মনে মনে আমরা ধন্যবাদ দিলাম।

সব মিলিয়ে ওয়াটামোলা জায়গাটা আউটিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা। তাই পরেরবার আমরা কয়েক পরিবার একসাথে গিয়ে ওখানে বারবিকিউ করার পরিকল্পনা করছি। আপনি শহুরে একঘেয়ে জীবনে ক্লান্ত হয়ে গেলে এক্ষুণি ঘুরে আসতে পারেন ওয়াটামোলা সৈকত।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!