শৈশবের গাছের দোলনা ‘জিপলাইন ট্যুর’

গ্রাম-বাংলার মানুষদের দুরন্ত শৈশবের একটি অনবদ্য স্মৃতি- ছোটবেলায় গাছের ডালে বানানো দোলনায় দোল খাওয়া। এবার ইলাওয়ারা ফ্লাই ট্রিটপ অ্যাডভেঞ্চারে গিয়ে জিপলাইন ট্যুর করে শৈশবের সেই আনন্দটাই পেলাম।

মো.ইয়াকুব আলী, অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 April 2018, 06:23 AM
Updated : 5 April 2018, 06:23 AM

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহর থেকে দুই ঘণ্টার ড্রাইভে আপনি চলে যেতে পারেন ইলাওয়ারা। গত বছর তামিম ভাই এবং সিথি ভাবি তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে বেড়াতে গিয়ে ছবি দিয়েছিলেন ফেইসবুকে। সেটা দেখেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, আমরাও একদিন যাবো।

তামিম ভাইকে জায়গাটার কথা জিজ্ঞেস করাতে উনি আমাকে মোবাইলে জায়গাটার ওয়েবসাইটের লিংক পাঠিয়ে দিলেন। তাই এবারের ইস্টারের ছুটিতে সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের পুরনো জিপিএস এম ৩১ মোটরওয়ে ধরে আমাদের গাইড করে নিয়ে চলল।

এম ৩১ ছেড়ে গ্রামের রাস্তা ধরতেই চারিদিকে শরতের আগমনী বার্তা পেলাম। গাছে গাছে পাতাগুলো বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করেছে। শীত আসতে শুরু করলেই তারা ঝরে পড়বে।

ইলাওয়ারা ফ্লাই ট্রিটপ অ্যাডভেঞ্চারের বাইরে পর্যাপ্ত কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। গাড়ি পার্ক করে আমরা টিকিট কাউন্টারের গিয়ে শুধু ট্রিটপ ওয়াকের জন্য টিকিট কেটে নিলাম। আপনি অনলাইনেও টিকিট করতে পারেন, তবে চার বছরের কম বয়সের বাচ্চার জন্য টিকিট লাগে না।

আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে আমরা জিপলাইন ট্যুর করতে পারবো কিনা, তাই আপাতত শুধুমাত্র ট্রিটপ ওয়াকের টিকিট করতে হল। আমাদেরকে একটা করে ম্যাপ আর বাচ্চাদের জন্য একটা করে এক্টিভিটির বই ধরিয়ে দেওয়া হলো। সেই বইয়ে মোট সাতটা জীবকে খুঁজে বের করে তাদের ছাপ বইয়ের পাতায় পেন্সিল দিয়ে আঁকতে হবে। এটা বাচ্চাদের জন্য একটা বাড়তি আনন্দ যোগ করে।

ম্যাপ ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম আর সাথে সাথে প্রাণীগুলোকেও খুঁজে বের করছিলাম আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়া মিলে। এগিয়ে যেতে যেতে একসময় আমরা শুন্যে হাঁটা শুরু করলাম। শুন্যে বলতে এখানে প্রথমে ভূমি থেকে বাংলাদেশের বাঁশের সাকোর মত করে সেতু শুরু হয়েছে।

তারপর পাহাড়ের ঢাল, যেখানে আরও গভীর হয়ে গেছে সেখানে স্টিলের অনেক মোটা থামের উপরে সেটাকে বসিয়ে দিয়ে একটা সেতুর আকার দেওয়া হয়েছে। তবে এগুলোকে আমি সেতু না বলে দোলনা বলছি। কারণ, এগুলো বাঁশের সাকোর মতো অনবরত দুলছিল।

আর সত্যি কথা বলতে, ছোট্ট রায়ান আর তাহিয়া ছাড়া আমি এবং আমার গিন্নি রীতিমতো ভয়ই পাচ্ছিলাম। বিশেষ করে ট্রিটপ ওয়াকের দুই প্রান্তে দুটো জায়গা আছে যার নিচে কোনো থাম নেই। সেই জায়গা দুটো অনেক বেশিই দুলছিল বলে বেশিরভাগ অভিযাত্রী সেখানে যেতে সাহস করেন না। কিন্তু রায়ান একেবারে অবলীলায় দৌড়াদৌড়ি করছিল, যেন সে মাটিতেই হাঁটাহাঁটি করছে। ওদের দেখে আমরা একটু সাহস পাচ্ছিলাম।

ট্রিটপ ওয়াকের একেবারে কেন্দ্রে একটি ৪৫ মিটার উঁচু টাওয়ার রয়েছে। আপনি ট্রিটপ ওয়াকে গিয়ে যদি এই টাওয়ারে না ওঠেন তবে আপনি আসল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন। এই টাওয়ারে উঠলে আপনি পাখির দৃষ্টিতে সামনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাবেন, যেটার কোনোই তুলনা নাই।

তাছাড়াও দূরের বস্তুকে ভালোভাবে দেখার জন্য আছে কয়েকটা দূরবীন। তাতে চোখ লাগিয়ে দূরের বস্তুগুলোকে অনেক পরিষ্কারভাবে দেখতে পারেন। তবে ওঠার সময় আপনার একটু কষ্ট হতে পারে, কারণ অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে আপনাকে একেবারে শীর্ষে পৌঁছাতে হবে। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানেও রায়ান সবার আগেই আমাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। তার পেছনে তাহিয়া, আমি আর ওদের মা এগিয়ে চললাম। শীর্ষে ওঠার পর আমাদের একটু ক্লান্তি লাগছিল, কিন্তু রায়ানের দৌড়াদৌড়ি থামলো না। তবে সামনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে দ্রুতই আমরা ক্লান্তি ভুলে গেলাম। টাওয়ার থেকে নামার সময় কষ্ট না হলেও আপনাকে একটু সাবধানে নামতে হবে। কারণ, সিঁড়িগুলো বেশ খাড়া। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, টাওয়ারে ওঠার চেয়ে নামাটাই ঝুঁকিপূর্ণ।

এভাবে একসময় আমাদের ট্রিটপ ওয়াক শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমাদের আরও উপর দিয়ে জিপলাইন ট্যুরের মানুষগুলো এক গাছ থেকে অন্য গাছে ঝুলে ঝুলে যাচ্ছিলো দেখে তাহিয়া বায়না ধরলো, “বাবা, এইবার আমরা জিপলাইন ট্যুর করি।”

ট্রিটপ ওয়াক শেষ করে আমরা সাথে আনা খাবার খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। আপনি চাইলে ওখানের রেস্তোরাঁ থেকেও খাবার কিনতে পারেন। তারপর আমরা কাউন্টারে আরো কিছু ডলারের বিনিময়ে আমাদেরকে জিপলাইনের টিকিট দেওয়া হল। এক ঘণ্টা পর পর জিপলাইনের ট্যুর হয়। আমরা পরবর্তী এবং দিনের শেষ ব্যাচের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। 

এখানে একটা বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো, জিপলাইন ট্যুর করতে হলে আপনাকে অবশ্যই পায়ের আঙ্গুল ও গোড়ালি ঢাকা কোনো কিছু পায়ে দিতে হবে। সোজা কথায়, জুতা বা কেডস পরে গেলে ভালো। নাহলে আপনি ওদের স্টোর থেকেও সামান্য কিছু ডলারের বিনিময়ে কিনতে পারেন। তবে আপনি জিপলাইন ট্যুর করার সময়ে সাথে কোনো কিছুই রাখতে পারবেন না। এমনকি মোবাইল পর্যন্ত ওরা নিতে দেয় না নিরাপত্তার জন্য।

এতবড় একটা অ্যাডভেঞ্চারের ছবি তুলবো না, সেটা কি করে হয়! তখন ওরা জানাল, মোবাইল গলায় ঝুলিয়ে নেওয়া যাবে। গলায় ঝোলানোর প্যাকেটটা তাদের দোকানেই আছে। আর এটা পানির নিচেও ব্যবহার করা যায়।  আমরা তক্ষুণি একটা প্যাকেট কিনে নিলাম। 

এরপর আমাদেরকে জিপলাইন ট্যুরের জন্য তৈরি করতে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে ভিডিওর মাধ্যমে আমাদেরকে সবকিছু হাতে-কলমে শিখিয়ে দেওয়া হল। এরপর আমাদের জিপলাইন ট্যুরের বিশেষ পোশাক পরিয়ে দেওয়া হল। তারপর আমরা দলবদ্ধভাবে জিপলাইন ট্যুরের জন্য এগিয়ে গেলাম। একটা জায়গায় এসে সিঁড়ি দিয়ে আমরা কিছুটা উপরে উঠে গিয়ে জিপলাইন ট্যুর শুরু করলাম। 

জিপলাইন ট্যুরে সর্বমোট পাঁচটা ধাপ। প্রথম ধাপে ছোট একটা স্প্যান ঝুলে পাড়ি দিতে হয়। এরপরের দুইটা স্প্যান পায়ে হেঁটে পার হতে হয়। এরপর একটা অনেক বড় স্প্যান ঝুলে পার হয়ে শেষে আরও একটা স্প্যান ঝুলে পার হয়ে ট্যুরটা শেষ হয়।

ঝোলার শুরুর মুহূর্তে আমার অনেক ভয় লাগছিল। কিন্তু ঝুলবার সময় অনেক ভালো লাগে। আর পায়ে হেঁটে পার হওয়ার জায়গাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লেগেছিল। কারণ, একটু পর পর একটা করে ধাপ, আর হাঁটার সময় নিচের গভীর খাতটা দেখা যায়। কিন্তু তাহিয়াকে দেখলাম, সে অবলীলায় সবগুলো একের পর এক পার করে যাচ্ছে। তাই মনে সাহস নিয়ে আমিও ওকে অনুসরণ করলাম। তবে ঝোলার সময় পেছনের দিকে ঝুলে পা দুটোকে উঁচুতে রাখতে পারলে ভালো। কারণ, আপনি যখন পরবর্তী গাছে গিয়ে নামবেন, তখন সহজেই উঠে যেতে পারবেন।  

এভাবে একসময় আমরা জিপলাইন ট্যুরও শেষ করে ফেললাম। আমরা যখন জিপলাইন ট্যুরে যাচ্ছিলাম, তখন রায়ানকে কোনোভাবেই ওর মা আটকে রাখতে পারছিল না। সেও আমাদের সাথে আসবেই, কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই ওদেরকে ফেলেই আমাদের ট্যুরটা শেষ করতে হল। সমস্ত ভ্রমণের এই একটাই খারাপ লাগা। তাছাড়া প্রত্যেকটা সেকেন্ড আমরা খুবই উপভোগ করেছি। 

বিকেল পাঁচটায় ট্রিটপ ওয়াকের ওয়ার্কিং আওয়ার শেষ হয়। আর জিপলাইন ট্যুর শেষ করতে করতে আমাদের প্রায় সাড়ে চারটা বেজে গেল। তাই এবার ফেরার পালা। তাহিয়া বললো, “বাবা, পরেরবার এসে আমরা শুধু জিপলাইন ট্যুর করবো।”

ফেরার সময় জিপিএসে আমাদের বাসার লোকেশন দেওয়ার পর আসার রাস্তায় না নিয়ে আমাদেরকে অন্য একটা রাস্তায় নিয়ে গেলো। সেটা ছিল জাম্বুরি পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে। জাম্বুরি পাহাড়ের মধ্যের রাস্তাটা আমার ড্রাইভ করা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আঁকাবাঁকা এবং খাড়া রাস্তা। খুবই সাবধানে ড্রাইভ করতে হয়। কিন্তু দুই পাশের দৃশ্য আপনার মনে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে। সারি সারি রেইন ফরেস্টের বিশালাকৃতির গাছ, লতাপাতা, পাখির ডাক- সবমিলিয়ে এক অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশ যেন।

ট্রিটপ অ্যাডভেঞ্চার শেষ করে এসে যথারীতি প্রতিবেশী রুপা বৌদির কাছে ঝাড়ি খেলাম তাদেরকে না জানানোর জন্য। তাহিয়ার বান্ধবী জেইনারাও যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সামান্য সময়ের নোটিশে ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তৈরি হওয়া ঝামেলা, তাই এবার আমরা একাই গিয়েছিলাম।

পরবর্তীতে সবাইকে নিয়ে আবারও যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। আপনিও চলে যেতে পারেন একদিনের জন্য বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শৈশবের গাছের দোলনায় চড়ার আনন্দ নিতে।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী

মেইল: yaqub_buet@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!