গিন্নির এবং মেয়ের পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়াতে সেই সুযোগ এসে গেল। গিন্নির পাসপোর্টের ফর্ম পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেই হতো, কিন্তু মেয়ের চেহারা বদলে যাওয়াতে ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য ক্যানবেরায় বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতেই হবে।
অনলাইনে আগে থেকে সাক্ষাৎকারের সময় নিয়ে সেই মোতাবেক যাত্রা করতে হবে। এনজ্যাক ডে’র পরেরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পুরো পরিবার যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। কাকতলীয়ভাবে বন্ধু রাজীব ক্যানবেরা থেকে এনজ্যাক ডে’র দিন চাচা-চাচীকে সিডনি এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিল আর ফিরবে পরেরদিন। তাই রাজীব বলল, আমাদের সাথেই চল।
চাচা-চাচীকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আরও কিছু কাজ সেরে রওনা দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল। তাই রাজীব বলল, তুই তোর বাসা থেকে রওনা দিয়ে দে, আমিও ওয়াইলি পার্ক থেকে রওয়ানা দিচ্ছি। আমরা সাটন ফরেস্ট ম্যাকডোনাল্ডে বিরতি নেব। সেখানে তোদের সাথে সাক্ষাৎ হবে। পুরনো জিপিএসটা চালু করে আমরা রওনা দিলাম।
এম-৩১ হাইওয়ে ধরে একেবারে এক রাস্তা চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার দিকে। কিন্তু আমাদের পুরনো জিপিএস আমাদেরকে সাটন ফরেস্টের এমন এক জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে ম্যাকডোনাল্ড তো নেই-ই বরং একটা গ্রাম।
এরপর আমরা মোবাইলের গুগল ম্যাপ ধরে ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে হাজির হলাম। এখানেও প্রত্যকটা হাইওয়ের পাশেই কিছুদূর পরপর থেমে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য এমন ক্যাফে রয়েছে। আর বেশ কিছুদূর আগ থেকেই রাস্তায় আপনি তার নির্দেশিকা পাবেন যে সামনে কতদূর গেলে বিশ্রামের জায়গা আছে। এখানে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যাপারটাকে অনেকভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।
আমরা ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু খাবার আর নিজেদের জন্য কফি নিয়ে নিলাম। আর যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী টয়লেট সেরে নিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার আমরা যাত্রা শুরু করে দিলাম।
এখানে রাস্তায় আরও একটা নির্দেশিকা চোখে পড়বে, সেটা হচ্ছে স্পিড ক্যামেরা বিষয়ক। হাইওয়েতে একটু পরপরই আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া হবে যে রাস্তায় স্পিড ক্যামেরা লাগানো আছে। তাই আপনি বাধ্য হবেন নির্দিষ্ট গতিসীমার মধ্যে গাড়ি চালাতে।
এছাড়াও ক্যানবেরা যাওয়ার পথে অন্য এক ধরনের স্পিড ক্যামেরার দেখা পাবেন। সেটাকে বলা হয় এভারেজ স্পিড ক্যামেরা। ফেডারেল হাইওয়েতে ওঠার পর শুরুতে এবং শেষে স্পিড ক্যামেরা লাগানো আছে।
এই ক্যামেরাগুলো এই হাইওয়েতে ঢোকার এবং বের হওয়ার সময় রেকর্ড করে রাখে। তারপর সেটা দিয়ে মোট অতিক্রান্ত দূরত্বকে ভাগ দিয়ে এভারেজ স্পিড বের করে। যদি সেটা স্পিড লিমিটের মধ্যে থাকে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। অন্যথায় আপনাকে মোটা অঙ্কের ফাইন গুণতে হবে। যারাই প্রথমবার ক্যানবেরা যায়, তারা প্রায় সবাই এই ফাইনের কবলে পড়ে। এভাবেই আমরা একসময় ক্যানবেরা পৌঁছে গেলাম।
আসলে আপনি যদি যাত্রাপথের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে চান, তাহলে আপনাকে চালকের আসন ছাড়া অন্য আসনে বসতে হবে। তাহলে আপনি খুব নিখুঁতভাবে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতে পারবেন। গিন্নি গাড়ি চালানোতে আমার সেই সুযোগ হল এবার।
আমি সামনে-পেছনে ডানে-বায়ে সবকিছু দেখতে শুরু করলাম আর যতদূর পারলাম ক্যামেরাবন্দি করা শুরু করলাম। হাইওয়ের দু’পাশে অবারিত মাঠ। সেখানে কখনও ভেড়ার পালের দেখা মেলে, আবার কখনওবা গরুর পালের অথবা ঘোড়ার পালের দেখা মেলে।
তাহিয়ার বমি বমি ভাব হচ্ছিল বলে আমি তাকেও আশেপাশের দৃশ্য দেখতে ও ক্যামেরাবন্দি করতে বললাম, কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়াতে সে টিস্যু পেপার নিয়ে খেলা শুরু করে দিল। ভাগ্যিস, যাত্রাপথের বেশিরভাগ সময় ছোট্ট রায়ান ঘুমিয়ে ছিল। নাহলে কান্নাকাটি করে আমাদের ব্যস্ত করে ফেলতো!
ফেরার পথেও বিরতি নেওয়ার জন্য আমরা একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা যেখানে বিরতি নিলাম, সেটা শুধুমাত্র একটা খোলা জায়গা। সেখানে কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। কিন্তু ডোনাটের একটা ভ্রাম্যমাণ দোকান পাওয়া গেল। আমরা সেখান থেকে এক গ্লাস ডোনাট কিনে নিলাম।
রাস্তা থেকেই আমরা একটা ইংরেজি ‘এ’ আকৃতির বাড়ি দেখতে পাচ্ছিলাম। এখানে বিরতি নিতে গিয়ে মনে হল, ওই বাড়িটা থেকে ঘুরে আসা যায়। আমি কোনোভাবেই আমার গিন্নি বা তাহিয়াকে রাজি করাতে পারলাম না, কিন্তু গাড়ি যেহেতু আমি চালাচ্ছিলাম, তাই ওদেরকে পাত্তা না দিয়ে আমি একটু ভেতরের দিকে এগিয়ে চললাম।
রাস্তায় কাজ চলছে, তাই আমাদের গ্রামের রাস্তার মতো ধুলো উড়ছে। সেই রাস্তা ধরে কিছুদূর যাবার পর একেবারে মাটির একটা রাস্তা বাড়িটার দিকে চলে গেছে। কিছুদূর যাওয়ায় পর একটা গেট আলগাভাবে লাগানো। আমি গাড়ি থেকে নেমে গেট খুলে ভেতরে গিয়ে আবার গাড়ি থেকে নেমে গেটটা বন্ধ করে দিলাম।
প্রথম গেটের একপাশেই বিশাল গোয়ালঘর। সেটাকে বাম দিকে রেখে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠে গেলাম। সেখানে আরও একটা গেট। অবশ্য সেটা খোলা থাকাতে আমরা সরাসরি বাড়িটার আঙিনাতে চলে গেলাম। আঙিনাতে গিয়ে দেখি, বাড়ির পুরুষ মানুষটা তার ছেলেটাকে নিয়ে একটা এস্কেভেটর চালাচ্ছেন। আমাদের দেখে সেটা থামিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে নেমে আসলেন।
ইতোমধ্যেই আঙিনা থেকে দুটো কুকুর দৌড়ে এসে আমাদের স্বাগত জানিয়েছে। ছোট কুকুরটা দৌড়ে এসে আমার কোলে চড়ে বসল। আর বড়টা এসে আমার পা চাটা শুরু করে দিল। গৃহকর্তা তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওরা আমাকে মনে হয় অনেক বেশি পছন্দ করেছিল। তাই আমার চারপাশে ঘুর ঘুর শুরু করে দিল। একটু পরেই গৃহকর্ত্রী তার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে এসে আমাদের স্বাগত জানালো। তারপর আলাপ জমে উঠলো তাদের সাথে।
বাড়ির ভেতর দিয়ে সিঁড়ি একেবারে উপরের তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। রান্নার জন্য উনারা ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করেন। আর পানির জন্য পাশেই পনেরোশ’ লিটার ধারণ ক্ষমতার একটা কংক্রিটের ট্যাংক রয়েছে। উনারা এখানে মূলত গরু লালনপালন করেন। তবে বাড়ির আঙিনাতে নিজেদের প্রয়োজনে ছোট ঘরে মুরগি পালন করেন বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ির মতো।
মোট তিনটা কুকুর এনাদেরকে পাহারা দেয়। দুইটা ছাড়া থাকে, কিন্তু তৃতীয়টাকে বেঁধে রাখতে হয়। কারণ তৃতীয়টা আকারে মাঝারি হলেও একটু বেশিই রাগী। তবে বাইরে যাওয়ার সময় ছেড়ে দিয়ে যান। আমার সামনে উনাদের বাচ্চা দুইটা বাবা মায়ের কোল থেকে নেমে আঙিনাতে বালি দিয়ে খেলা শুরু করল।
ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বেশ জোরে বইছে। এর মধ্যেই বাচ্চা দুটো বালি নিয়ে খেলছে দেখে বাংলাদেশের গ্রামের আমার শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। খেলতে খলতে বাতাসে বালি উড়ে একজনের চোখে ঢুকে পড়েছে। সেটা নিয়ে কাউকেই তেমন বিচলিত হতে দেখলাম না। উনারা স্বামী-স্ত্রী আমার সাথে আলাপ চালিয়ে গেলেন।
আমরা কোথায় থাকি- জিজ্ঞেস করাতে আমি বললাম ক্যাম্বেলটাউন এলাকাতে। শুনে উনি বললেন, “আমি বেড়ে উঠেছি ওখানে, আর আমার স্ত্রী বেড়ে উঠেছে পিকটন সাবার্বে।” আমি বললাম, “তোমাদের বাড়িটা দেখে খুবই ইচ্ছে করছিল কাছে এসে দেখার, তাই চলে এসেছি।” উনি বললেন, “খুব ভালো করেছো।”
বেশ কিছুক্ষণ আলাপের পর চলে আসার পালা। কারণ উনারা আমার জন্য কাজে যেতে পারছিলেন না। আমি উনাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে বললাম ছবি তুলে দিতে। ছবি তোলা দেখে উনাদের ছেলেটা দৌড়ে এসে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি এক কোলে ছোট কুকুরটাকে অন্য কোলে উনার ছেলেকে নিয়ে ছবি তুলে নিলাম। উনিই নিজ দায়িত্বে খুব সুন্দরভাবে আমার ছবি তুলে দিলেন।
কুকুর দুইটা কোনোভাবেই আমাকে ছাড়ছিল না। পরে উনারা ডেকে নেয়াতে চলে গেল। আমি উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার পথে যাত্রা শুরু করলাম। আমি আবারও একবার অনুভব করলাম, গ্রামের মানুষ দেশ-কালভেদে এখনও অনেক বেশি সহজ-সরল এবং অতিথিপরায়ণ।
সিডনির দিকে আরও কিছুদূর এগোনোর পথে রাস্তার পাশের নির্দেশিকা দেখে বুঝলাম, সামনেই ফল পাওয়া যাচ্ছে। গিন্নি বলল, বাসায় কোনো বাজার নেই। কিছু ফল নিয়ে গেলে খাওয়া যাবে। কারণ এর আগে রাস্তায় কৃষকদের কাছ থেকে ফল কেনার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অনেক সস্তায় ভালো ফল পাওয়া যায়।
আমরা গাড়ি পাশের রাস্তায় নিয়ে এসে পার্ক করে ভ্রাম্যমাণ ফলের দোকানে গিয়ে বারোমিশালি এক বাক্স ফল নিয়ে নিলাম। তারপর বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি নিশ্চয় এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা।” উত্তরে সে বলল, “না, আমি সিডনিতেই থাকি। আর এই ফলগুলো সিডনির বাজার থেকে কিনে এনে এখানে বিক্রি করছি।” ফল কেনা শেষে আবারও আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
আপনি হয়তো এক ব্যাগ বেগুন কিনলেন। উপরে ভালো বেগুন, বাসায় এসে ঢালার পর দেখলেন ব্যাগের নিচ থেকে পচা এবং পাকা বেগুন বের হচ্ছে। এছাড়াও মিরপুরের বেড়ি বাধে কিছু মানুষ মাছ বিক্রি করে, যাদের পেশা আসলে মাছ ধরা নয়। তারা কাওরানবাজার থেকে সস্তায় পচা মাছ কিনে নিয়ে এসে সাজিয়ে রাখে। ক্রেতা সেটাকেই নদীর মাছ ভেবে কিনে নিয়ে আসে। বাসায় আসার পর বুঝতে পারে কতো বড় ধরা খেয়েছে। আমিও এবার ধরা খেলাম। অনেকগুলো ফল পচা ছিল। তাই পরের বার হাইওয়েতে কোনো কিছু কেনার আগে দুইবার ভাববো।
হাইওয়েতে ভ্রমণ সবসময়ই ক্লান্তিকর এবং নিরস। বিশেষ করে যিনি গাড়ি চালান। কিন্তু মাঝেমধ্যে যদি আপনি একটা অনিয়মিত বিরতি নিয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে গ্রামের সহজসরল মানুষগুলোর সাথে আলাপ করেন, তাহলে শহুরে জীবনের অপূর্ণতাগুলোর আক্ষেপ কিছুটা হলেও কমবে। আপনি তখন বুঝতে পারবেন, পৃথিবীর সব মানুষকে যন্ত্র এখনও তার গোলাম বানাতে পারে নাই।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: yaqub_buet@yahoo.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |