গ্রীষ্মকালে যখন গরম পড়ে, তখন অন্যান্য এলাকার তুলনায় চর এলাকায় একটু বেশিই গরম পড়ে। চর এলাকার বেলে-দোআঁশ মাটি খুব দ্রুতই তেঁতে ওঠে আর তেমন বেশি একটা গাছপালা না থাকাতে পরিবেশ ঠাণ্ডা করার তেমন কোন প্রভাবক থাকে না।
বৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণের শেষ চেষ্টা হিসাবে শুরু হতো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। গ্রামের মুরুব্বীরা একসাথে বসে ঠিক করেন কোন দিনটা শুভ হবে এবং গ্রামের কোন জায়গাটাতে হবে প্রার্থনা। তারপর চলে প্রস্তুতি। দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হতো পাড়া হিসাবে।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে শুরু হতো কর্মযজ্ঞ। একপক্ষ শুরু করে নির্দিষ্ট জায়গাতে গর্ত খনন, যাকে গ্রামের ভাষায় আমরা বলতাম খাদ বা মাটিল। প্রায় একমানুষ সমান গভীর হতো সেই গর্ত। অন্য পক্ষ নিজের নিজের পাড়ায় দান নিতে নেমে যেতো।
দানগুলা সব একজায়গায় করতে করতে এবং গর্ত খোঁড়া শেষ করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলে গ্রামের সব শিশু-কিশোর-যুবক-বয়স্ক সবাই নেমে পড়তো গর্তে। আর গ্রামের মেয়েরা সেই গর্তে কলসিতে করে পানি ঢালতে থাকতো। দেখতে দেখতে গর্ত একটা ছোটখাটো পুকুরের আকার ধারণ করতো। তারই মধ্যে চলতো সন্ধ্যা পর্যন্ত জলকেলি।
তারপর সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো রান্নার আয়োজন। সে এক এলাহী ব্যাপার! সবশেষে সবার মাঝে খাবার (সিন্নি) বিতরণ চলতো। সিন্নি বিতরণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা হতো যেন গ্রামের কোন পরিবার বাদ না পড়ে। যে সমস্ত পরিবার থেকে কেউ আসতে পারতো না, তাদেরকে সিন্নি পৌঁছে দেওয়া হতো।
সেই রাতে আমাদের আর ভালো করে ঘুম হতো না। এই বুঝি ঘুমিয়ে গেলে বৃষ্টি আসবে আর আমি টের পাব না। তখন সকাল বেলা উঠে সবাইকে বলতে পারবো না যে আমি সবার আগে বৃষ্টির শব্দ শুনেছি।
অনেকদিন গ্রামে যাই না। শহুরে জীবনে কোন কিছুতেই আমরা শিহরিত হই না, সবকিছুরই পূর্বাভাস পাওয়া যায় এখানে। বাজার দর থেকে শুরু করে ঝড়-বৃষ্টি। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, নাগরিক সকল সুযোগ-সুবিধা বাদ দিয়ে গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসি। আহারে, যদি পারতাম এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে!
সিডনিতে আসার পর অনেক কিছুর সাথে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দটা খুবই অনুভব করছিলাম, কারণ এখানে বৃষ্টি হয় সাধারণত শীতকালে। তাই বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়াটা রীতিমতো বোকামি। তবুও বৃষ্টি এলেই আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়াকে ঘরে আটকে রাখা মুশকিল। যেহেতু বৃষ্টি গায়ে লাগানো যাবে না, তাই আমরা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
সিডনিতেও মাঝেমধ্যে গরমকালে বৃষ্টি হয়। এমনই একদিন আমরা সবাই বাসায়, তখন বৃষ্টি নামলো। আমি আর তাহিয়া হৈ হৈ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমাদের দেখাদেখি রায়ানও দৌড়ে বাইরে চলে এলো। তখন হঠাৎ আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।
গ্রামে বৃষ্টি এলেই আমরা ছোটরা সব দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। তারপর জাম্বুরাকে বল বানিয়ে বৃষ্টির পানির মধ্যে এলোপাথাড়ি খেলে বেড়াতাম। এটা মনে পড়তেই গিন্নিকে বললাম, রায়ানের জন্য কেনা বলটাকে খুঁজে দিতে। তারপর সেটাকে নিয়ে আমরা তিনজন বৃষ্টির মধ্যে এলোপাথাড়ি খেলে বেড়ালাম।
যদিও সিডনির গরমকালের বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, তবুও সেদিন একটু মুষলধারে হওয়াতে আমরা মোটামুটি কাকভেজা হয়ে গেলাম। খেলাধুলা শেষে গিন্নিকে বললাম, আমাদের একটা ছবি তুলে দাও। তাহিয়া এবং রায়ান যখন বড় হবে, তখন এই ছবি দেখে বুঝবে ওদের শৈশবটা মোটেও একঘেয়ে ছিল না।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: yaqub_buet@yahoo.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |