অস্ট্রেলিয়া আসার পর থেকেই আমরা মোটামুটি ঘরকুনো জীবনযাপন করেছি। বিভিন্ন কারণে বাসার বাইরে দূরে কোথাও খুব একটা যাওয়া হয় না।
Published : 06 Jun 2018, 01:20 PM
আমরা সিডনিতে আসার প্রায় এক বছরের মাথায় পৃথিবী বিখ্যাত অপেরা হাউস দেখতে গিয়েছিলাম গিন্নির এমসি প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা উপলক্ষে। তাকে পরীক্ষার হলে দিয়ে আমি আর আমার মেয়ে তাহিয়া চলে গিয়েছিলাম অপেরা হাউস দেখতে। ঠিক তেমনই একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল মেলবোর্নে যাবার গিন্নির এমসির দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার সময়।
আগে থেকেই অনলাইনে প্লেনের টিকেট করে ফেললাম। ফেরার সময় দেখে আমার বস বললেন, “তোমার গিন্নির যে সময়ে পরীক্ষা শেষ হবে, আমার মনে হয় না তুমি তোমার ফেরার ফ্লাইট ধরতে পারবে। কারণ, মেলবোর্নের তুলামারিন এয়ারপোর্ট শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। শহর থেকে বাসে করে এয়ারপোর্টে আসতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যাবে। তাই তুমি ফেরার ফ্লাইটের সময় বদলাও।”
অনলাইনে ফেরার ফ্লাইটের সময় বদলাতে গিয়ে বিশাল একটা অংকের ডলার ফাইন দিতে হলো। তখনই মাত্র জানলাম ফ্লাইটের সময় বদলাতে গেলে ফাইন গুণতে হয় এবং ফাইনের অংকটা দেখে আমার একটা বাংলা প্রবাদ মনে পড়ে গেল- বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়।
আমি পড়ে গেছি অন্য পাশে, তাই তাদেরকে খুব একটা সাহায্যও করতে পারছিলাম না। রায়ান কোনোভাবেই তার মায়ের কোল থেকে নামবে না, কিন্তু প্লেন ছাড়ার সময় অবশ্যই তাকে প্লেনের সিটে বসতে হবে এবং সিট বেল্ট বেঁধে রাখতে হবে।
গিন্নি কোনোভাবে রায়ানকে তার সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নিজে হাত দিয়ে তাকে ধরে রাখলো, কিন্তু রায়ানের কান্না আর কোনোভাবেই থামলো না এবং সেটা চললো প্লেন থেকে না নামা পর্যন্ত। তাহিয়া প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে মেঘেদের ভেসে চলা দেখছিল আর আমার মোবাইলের ক্যামেরায় সেই দৃশ্য বন্দি করার কাজে ব্যস্ত ছিল। এভাবেই আমাদের প্লেন ভ্রমণ শেষ হলো।
ট্রেন থেকে নেমেই মেলবোর্ন শহরে যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট করতে হল। একটু পরপরই বাস আসছে, তাই আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। এই বাসগুলো দোতলা। নিচতলার নির্দিষ্ট র্যাকে আমাদের ব্যাগগুলো রেখে আমরা দোতলায় উঠে গেলাম, যাতে করে ভালোমত সাইট সিইং করা যায়। তারপর একসময় বাস চলতে শুরু করল।
সাউদার্ন ক্রস স্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার হাঁটাপথে রাস্তা মাত্র বিশ-বাইশ মিনিটের দূরত্ব। ভ্রমণের ক্লান্তির জন্য আমাদের দূরত্বটা বেশি লাগছিল। কিছুদূর হাঁটার পর আমরা একটা বিশাল পার্কের মতো জায়গা পার হলাম। তাহিয়া বলল, “বাবা, আমরা কাল সকালে এখানে বেড়াতে আসব।”
পার্কটা পার হয়ে একটা মার্কেটের সামনের পার্কিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হল। পরে জেনেছি, সেটা ছিল মেলবোর্নের বিখ্যাত সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের মার্কেট, নাম- কুইনস মার্কেট।
হোটেলে দুটো কক্ষ। ড্রইং রুমের শেষ প্রান্তে বারান্দা। তাহিয়া-রায়ান সেখানে গিয়ে খেলা শুরু করে দিল। পাশেই একটা টিনের দোচালা ঘর। তার উপর একটা চড়ুই বসে থাকতে দেখে তাহিয়া প্রশ্ন করলো, “এটা কী পাখি?” আমি বললাম, “এটা চড়ুই পাখি, এটা মানুষের ঘরে বাসা বাঁধে।”
অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর এই প্রথম চড়ুই পাখির দেখা পেলাম। বাংলাদেশি আরও একটা পাখি এখানে অনেক দেখা যায়-শালিক। এখানে বলে ‘ইন্ডিয়ান ময়না’।
সন্ধ্যা আমি বেড়িয়ে পড়লাম খাবারের খোঁজে। হোটেলের সামনের রাস্তায় কিছুদূর গেলেই একটা চিপা কানাগলি পড়ল। দৈর্ঘ্য বেশি না, কিন্তু দু’পাশের দেয়াল বিভিন্ন বর্ণের রঙে রাঙানো। একবার দেখলে বার বার তাকাতে ইচ্ছে করে। এখানকার কিশোররা বিভিন্ন দেয়ালে এমন রঙ করে থাকে, এটাকে এখানে ‘গ্রাফিতি’ বলে।
বাংলাদেশে যেমন দেয়ালে লেখা থাকে- এখানে পোস্টার লাগানো বা লেখা নিষেধ, ঠিক তেমনি এখানে অনেক দেয়ালে গ্রাফিতি না করার নির্দেশনা থাকে। তবে সেটা গ্রাফিতি করা তরুণ-তরুণীরা থোড়াই কেয়ার করেন।
আরও একটু এগুলেই সামনেই মেলবোর্নের বিখ্যাত টুইন টাওয়ার। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই টুইন টাওয়ার দুটোকে কেমন যেন অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছিল। তার মধ্যে একটার নির্মাণ কাজ তখনও শেষ হয় নাই, সেটাতে শুধুই একই বর্ণের কাঁচ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু অন্যটাতে ঢেউ খেলানো রঙিন আলোর ছটা দেখা যাচ্ছিল।
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর বামে মোড় নিয়ে কিছুদূর গেলেই গলির মাথায় একটা ম্যাকডোনাল্ড চোখে পড়লো। ম্যাকডোনাল্ডে গিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। ম্যাকডোনাল্ডের স্বয়ংক্রিয় মেশিনে একটা প্যাকেজ কেনার পর ডিফল্ট অপশন হিসেবে তলার দিকে একটা মেসেজ আসে ডোনেশনের জন্য। আমি সাবধানে সেটা এড়িয়ে খাবারের অর্ডার দিলাম।
আমার সবচেয়ে কাছাকাছি দাঁড়ানো মেয়েটা আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চাইলো। তখন আমি বুঝলাম ওরা আমার কথার মানে করেছে, “তুমি কি আমার সাথে একটা ছবি তুলবে?”
পরেরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে হেঁটে গিন্নিকে তার পরীক্ষা কেন্দ্রে দিয়ে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই ফ্লাগস্টাফ গার্ডেনে গেলাম, যার মধ্যে দিয়ে আগেরদিন সন্ধ্যায় পার হয়েছিলাম। এই জায়গাটার এক কোণায় বাচ্চাদের বিভিন্নরকমের খেলার সরঞ্জাম দেখে তাহিয়া-রায়ান দুজনই খেলতে নেমে গেল।
খেলা শেষ করে বাগানের মতো জায়গাটাতে এসে ওরা দুই ভাইবোন লুকোচুরি খেলা শুরু করলো। সেখানটাতে নাম না জানা অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ আছে। আমি সেগুলোর ছবি তুলে নিতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর ওখান থেকে চলে আসতে হলো। গুগল ম্যাপে দেখলাম পাশেই মেলবোর্ন সি লাইফ একুরিয়াম। সেখানে যেতে যেতে আমরা রাস্তার পাশের বাড়িগুলোও দেখছিলাম। বাড়িগুলোর পুরনো আমলের সদর দরজাগুলো আসলেই অনেক দৃষ্টিনন্দন। এগুলো দেখে ব্রিটিশ আমলের বাংলাদেশের বাড়িগুলোর দরজার কথা মনে পড়ে গেল।
আমরা ঘুরে ঘুরে সব দেখছিলাম। বিশেষ করে একটা জায়গা আছে যেখানে চারপাশে, এমনকি মাথার উপরেও পানি এবং সেখানে সাগরের সকল প্রকারের মাছ সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে আর আপনি তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। গা ছমছম করা অনুভূতি সেটা।
দেখা শেষ করে একটা জায়গা আছে যেখানে বিশ্রাম নেওয়া যায়। সেখানে সাদা কাগজে বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি এবং বিভিন্ন রঙের সিগনেচার কলম রেখে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চারা প্রতিকৃতিগুলো থেকে একটা বেছে নিয়ে সেটা রঙ করে পাশের স্ক্যানারে স্ক্যান করলেই সেটা পাশের পর্দায় ফুটে উঠছে।
সেই প্রাণীর প্রতিকৃতি শুধু পর্দায় দেখায় যাচ্ছে তা নয়, সেটা আবার জীবন্ত প্রাণীর মতো সাঁতার কেটেও বেড়াচ্ছে। তাহিয়া একটা সি হর্সের প্রতিকৃতিতে রং করে নিজের নাম লিখে সেটা স্ক্যান করতেই পর্দায় তাহিয়ার সি হর্স সাঁতার কাটতে শুরু করলো। দেখে তো তাহিয়া মহাখুশি!
ট্যাক্সি ড্রাইভার মাঝবয়সী আফ্রিকান ভদ্রলোক। হোটেল থেকে স্টেশন ট্যাক্সিতে কয়েক মিনিটের রাস্তা। এর মধ্যেই তার সাথে ভাব হয়ে গেল। অনেক গল্পও হল। তাই স্টেশনে পৌঁছে তার সাথে একটা ছবি তুলতে চাইলে উনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন।
এই ভ্রমণে আমরা পায়ে হেঁটে পুরো মেলবোর্ন শহর চষে বেরিয়েছিলাম। তাই একটা পুরনো কথায় আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম- কোনো জায়গা ভালোমতো দেখতে চাইলে পায়ে হেঁটেই দেখা উচিত। আমি নিশ্চত, এরপর আবার মেলবোর্ন গেলে আমাদের রাস্তা চিনতে মোটেও সমস্যা হবে না।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী
মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |