হলফনামার তথ্য যাচাই করে না নির্বাচন কমিশন, যদিও বলা আছে মিথ্যা তথ্যে প্রার্থিতা বাতিল হবে। সম্পদের অর্জিত মূল্য উল্লেখ করলেও তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না, আয় বৃদ্ধির কারণও জানান না কেউ
Published : 16 Dec 2023, 12:05 AM
স্বর্ণের ভরির দাম লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেলেও মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা পড়া প্রার্থীদের হলফনামায় দামের যে হিসাব দেখানো হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে গত কয়েক বছরে কেউ মূল্যবান এই ধাতুটি কেনেননি।
কারও হিসাবে ভরিপ্রতি দাম পড়ে ১৫ হাজার টাকার নিচে, কারও ক্ষেত্রে তা তিন হাজার টাকার কম, কারও ক্ষেত্রে এক হাজার টাকার নিচে। ১০০ টাকা বিঘা জমির হিসাবও দেওয়া আছে।
হলফনামার ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে, তা হল এই দরে আসলে কি জমি বা স্বর্ণ পাওয়া যায়?
এসব প্রশ্নে প্রার্থীরা আবার বলছেন, আইন অনুযায়ী অর্জনকালীন মূল্যের কথা বলা আছে, তারা সেই মূল্যই উল্লেখ করছেন। একজন আয়কর আইনজীবীও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, বাংলাদেশের যে আইন, সে অনুযায়ী সম্পদ অর্জনের পর তা বিক্রি করার আগ পর্যন্ত যে দরে কিনেছেন, সেটিই তার দাম হিসেবে ধরতে হবে।
হলফনামায় মোট আটটি তথ্য দিতে হয়। এর মধ্যে আছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, ফৌজদারি মামলার তথ্য, অতীতে সাজা হয়েছিল কি না, তার আয় ও সম্পদ কত ইত্যাদি।
কারও ক্ষেত্রে আয় বা সম্পদ বাড়লে তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে হয় না। ফলে কারও আয় বা সম্পদ বাড়লে সেটি কেন এবং কীভাবে বাড়ল, সেই প্রশ্নের জবাব আসলে ভোটাররা কখনও পায় না। গণমাধ্যমের প্রশ্নে কেউ কেউ বক্তব্য দিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনের আগে প্রার্থীদেরকে ফোনে পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
হাসিনার সম্পদ দশ বছরে দ্বিগুণ, খালেদার আয় বেড়ে ছয় গুণ
আবার কারও অস্থাবর সম্পদ বা জমির মূল্য দেখানো হলেও জমিটি কবে কেনা হয়েছে, সে বিষয়েও তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে সে সময় জমির এই দর ছিল কি না, সেটি যাচাইয়েরও সুযোগ নেই।
প্রার্থীরা সত্য তথ্য দিচ্ছেন কি না, তা যাচাই করা হয় না। ভোটের প্রচারে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এসব নিয়ে কথা বলেছেন– এর উদাহরণও নেই। সে কারণে নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে সোচ্চার ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যাখ্যা ছাড়া এই উপস্থাপনা আসলে ভোটারদের জন্য বিশেষ কোনো বার্তা নিয়ে আসে না।
ভোটারদের মনে বিভ্রান্তি
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পড়ে এসব হলফনামার বিষয়ে বুঝতে পারছেন না মিরপুরের বাসিন্দা জাহিদ পাটোয়ারী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দেশের একজন নাগরিক সরকারের কাছ থেকে লটারির মাধ্যমে জমি পেলে নিঃসন্দেহে তিনি অনেক সৌভাগ্যবান। তবে ওই জমির নামমাত্র সরকারি মূল্য দেখালে কী লাভ হয়?”
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় ‘চোখ থাকবে’ দুদকের
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাহিদ বলেন, “৩০ বছর আগে স্বর্ণের দাম ছিল ৬ হাজার টাকা এবং ৬০ বছর আগে এক বিঘা জমির দাম ১০০ টাকা হতেও পারে। কিন্তু বর্তমান সম্পদের হিসাব করতে গিয়ে অর্জনকালীন সময়ের মূল্য দেখানো আমার কাছে সঠিক মনে হয় না।”
‘দায়সারা তথ্য’
কারও কারও ক্ষেত্রে সম্পদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রকৃত তথ্য গোপন হয়েছে কি না, সে বিষয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন আছে।
আইন অনুযায়ী হলফনামায় ভুল বা মিথ্যা তথ্য দিলে তার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু হলফনামা যাচাই করে প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার উদাহরণ নেই। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সংক্ষিপ্ত সময়ে এসব তথ্য যাচাইয়ের সক্ষমতাও নির্বাচন কমিশনের নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে শুদ্ধাচার চর্চার জন্যই সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়। কিন্তু এসব তথ্যে যাচাই বাচাই না করার ফলে এটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না।”
তার ধারণা, হলফনামায় তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক বলে অনেকটা দায়সারাভাবে তথ্য দিয়ে দেন, যাতে বাস্তবতার প্রতিফলন আসলে দেখা যায় না।
বছরে ‘সাড়ে ৫ কোটি টাকা’ আয় করেন সাকিব
বহু প্রার্থীর ক্ষেত্রে বছরে আয়ের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে তার সম্পদের হিসাব মেলানো কঠিন। কয়েক লাখ টাকা আয় করে বহু কোটি টাকার সম্পদ কীভাবে গড়া হয়েছে, সেগুলোর বিষয়েও প্রশ্ন আছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “হলফনামায় যেসব সম্পদ দেখানো হয়েছে সেগুলো তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা দেখা হয় না। যেসব তথ্য দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সৎ এবং যথার্থ কি না সেগুলোও যাচাই করা হয় না। প্রার্থীর এর বাইরে আরও সম্পদ আছে কি না তাও দেখা হয় না এবং কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য কোনো তথ্য গোপন করা হচ্ছে কি না তাও যাচাই করে দেখা হয় না।”
জমির বিঘা একশ টাকা
পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের হলফনামায় ২০ বিঘা জমির দাম ২ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বিঘার দাম দেখানো হয়েছে ১০০ টাকা।
বাংলাদেশের কোথাও এই দামে জমি পাওয়া যায় না, সেটা নিশ্চিত। তাহলে মকবুল তা কীভাবে পেলেন?
হলফনামায় মিথ্যা লিখলে ভোটের পর ইসির ‘করার কিছু থাকে না’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মকবুল হোসেন বলেন, “স্বাধীনতার আগে আমাদের চলনবিল অধ্যুষিত এলাকায় মাঠের জমিগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকত। সেভাবে ফসল উৎপাদন হত না। ওই সময় ৪০/৫০ টাকা থেকে একশ টাকা বিঘা জমি পাওয়া যেত।
“এখানে অর্জনকালীন সময়ের কথা বলায় আমরা এভাবে উল্লেখ করেছি, যা ২০০৮ সালের নির্বাচনেও হলফনামাতে উল্লেখ করেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি নির্বাচনেই এ বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছে।”
প্লটের চেয়ে ফ্ল্যাটের দাম বেশি
নড়াইল-২ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাশরাফি বিন মুর্তজা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন, সেখানে পূর্বাচলে থাকা ৫ কাঠা জমির দাম উল্লেখ করেছেন মাত্র ৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ ঢাকার পূর্বাচলের সরকারি আবাসিক প্লটে প্রতিকাঠা জমির দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ টাকা করে।
মাশরাফিই কিন্তু ঢাকার মিরপুরে ২ হাজার ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম দেখিয়েছেন ১ কোটি ৮ লাখ টাকা।
মাশরাফির আয় কমে অর্ধেক, পাঁচ বছরে গড়েননি নতুন সম্পদ
একটি ফ্ল্যাটের চেয়ে পূর্বাচলের ৫ কাঠা জমির দাম কম হয় কীভাবে- এই প্রশ্নে মাশরাফি বিন মুর্তজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পর জমিটি সরকার থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম ২০০৬ সালে। দলের সবাইকেই জমি দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমার খরচ ছিল স্রেফ রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত খরচটুকু। সেসবই উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। রাজউকে খোঁজ নিলেই বিস্তারিত সবকিছু দেখতে ও জানতে পারবেন।"
৪৭ লাখ টাকায় ছয় তলা বাড়ির বিষয়ে তিনি বলেন, “জমিটা কিনেছিলাম ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলে আসার পর। সেখানেও জায়গার যে মূল্য ও এই সংক্রান্ত খরচ, সেসবই উল্লেখ করা হয়েছে। আমার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেই হলফনামায় দেওয়া হয়েছে। সবক্ষেত্রেই নিয়ম মানা হেয়ছে।
“তাছাড়া জমিটা তো আমার স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলাম, কাগজে উল্লেখও আছে যে, 'গিফটেড টু ওয়াইফ।' এছাড়া ব্যাংক থেকে একটি ঋণের উল্লেখও আছে হলফনামায়। সেই ঋণ থেকেই মূলত বাড়ির কাজ এগিয়ে চলছে।"
স্বর্ণের ভরি ১৩ হাজার টাকা
ঢাকা-৮ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম তার স্ত্রীর কাছে থাকা ২৫ ভরি স্বর্ণের দাম উল্লেখ করেছেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি ভরির দাম দাঁড়ায় ১৩ হাজার টাকা। অথচ বর্তমান বাজার মূল্য এক লাখ টাকার বেশি।
মাশরাফির মতই নাছিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হলফনামায় সম্পদ বিবরণীতে চাওয়া হয়েছে অর্জনকালীন সময়ের মূল্য। আমরাও হলফনামায় সেভাবেই সম্পদের তথ্য সন্নিবেশ করেছি। যখন এই স্বর্ণ কেনা হয়েছিল, তখন দাম এমনই ছিল।”
এমন প্রার্থীও আছেন, যার হলফনামায় স্বর্ণের হিসাব করলে পাওয়া যায় তিন হাজার টাকার নিচে এমনকি এক হাজারের নিচে, এমন উদাহরণও বিরল নয়।
আইন কী বলে
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে সময়ে সম্পদটি অর্জিত হয়েছে, সেই সময়ের ক্রয়মূল্য দেখাতে হবে।
“ধরুন, ১৯৭১ সালে একভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১২০ টাকা, ১৯৭৪ সালে ছিল ৩৭৫ টাকা। এখন স্বর্ণের দাম ভরি প্রতি প্রায় লাখ টাকা। কিন্ত এখন প্রার্থী হলে কোনো ব্যক্তি সেই সময়ের অর্জিত মূল্যই দেখাবেন স্বর্ণের। আর উত্তাধিকারী হয়ে পেলে সম্পদের মূল্য দেখাবেন শূন্য।”
আয়কর ফরমে (আইটি ১০ বি ও ১০বিবি) বিধান অনুযায়ী এ সম্পদের তথ্য হলফনামায় দিতে হয় বলে জানান তিনি।
ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুফি মোহাম্মদ আল মামুনও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের অর্ডার অনুযায়ী বাংলাদেশের যে কোনো জমির দলিলে যে মুল্য উল্লেখ করা হয় সেটাই মূল্য হিসেবে ধরা হবে। ওটাই আইন।
“যেমন আপনি কোনো একটা জমি কিনলেন ১ কোটি টাকায়, কিন্তু দলিলে লিখালেন জমির মূল্য ১ লাখ টাকা, তার সঙ্গে ১৫ শতাংশ রেজিস্ট্রেশন খরচ যুক্ত করে দাঁড়াবে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ আপনার ১ কোটি টাকার ওই সম্পদ এক লাখ ১৫ হাজার টাকা হয়ে গেল। আপনি যখন সরকারকে কর দিতে যাবেন তখন সম্পদ হিসাব করতে গেলে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা হবে।”
জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধনের সময় দাম কম দেখানো একটি সহজাত প্রবণতা হিসেবেই ধরা হয়। সে কারণে কর আদায়ের জন্য জমির মৌজা রেট বেঁধে দিয়েছে সরকার।
হলফনামা নিয়ে নির্বাচন কমিশন কী করে
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় রিটার্নং অফিসাররা তা দেখেন। তখন আপত্তি থাকলে তা নিষ্পত্তি করা হয়।
তিনি বলেন, “কমিশন যতটুকু করতে পারে সেটি হল তার আয়কর রিটার্ন, তিনি ঋণ বা বিল খেলাপি কি না, তার সাজা আছে কি না, সেই বিষয়গুলোর তথ্য দেখেন।
“মনোনয়নপত্র যাচাইবাছাইয়ের সময় ব্যাংকের প্রতিনিধিরা থাকেন, তারা তথ্য দেন। এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু হলফনামার তথ্য নির্বাচন কমিশন স্বপ্রণোদিত হয়ে যাচাই করবে না।”
হলফনামার অসত্য তথ্য নিয়ে জানানোর এখনই সময়: ইসি
কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে তাকে আদালতে যেতে হবে বলে জানান তিনি।
প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে গেলেও হলফনামায় অসত্য তথ্য প্রমাণিত হলে আদালতের আদেশে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
হলফনামার তথ্য উন্মুক্ত থাকায় অসত্য তথ্য দেওয়ার বিষয়ে বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে।
তবে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উদাহরণ নেই। আর প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণার পর মামলা হলেও সংসদের মেয়াদ থাকতে সেগুলো নিষ্পত্তির উদাহরণ খুবই কম।
নবম সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-৫ আসনে ৭৬ হাজারের বেশি ভোটে হারার পরও সংসদে বসতে পেরেছিলেন বিএনপির মাহমুদুল হাসান।
নির্বাচনের পর ওই আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির আবুল কাশেমের প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা করেছিল উচ্চ আদালত।
ভোলা-৩ আসনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের মো. জসিম উদ্দিনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলেও পরে তার প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর উপনির্বাচনে সেখানে জয়ী হন আওয়ামী লীগের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন।
কতটুকু কার্যকর
হলফনামার তিনটি কপি প্রার্থীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এর একটি মনোনয়নপত্রের সঙ্গে রাখা হয়, একটি রিটার্নিং অফিসারের অফিসের বাইরে টাঙ্গিয়ে দিতে হয় এবং একটি একজন কর্মকর্তার কাছে রাখতে হয়, যাতে আগ্রহী কেউ ফটোকপি করতে চাইলে ফেরত দেওয়ার শর্তে নিতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, আদালতের আদেশে হলফনামার এসব তথ্য ব্যাপক প্রচারের কথা রয়েছে। যাতে ভোটাররা সচেতন হয়ে প্রার্থী বাছাইয়ে ভূমিকা রাখে।
তিনি বলেন, “বাস্তবে ভোটাররা হলফনামার এসব তথ্য নিয়ে মাথা ঘামান না। যে উদ্দেশ্যে হলফনামার তথ্য জানানোর সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল, তার পূর্ণ প্রতিফলন দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ভূমিকাই বেশি। তাহলে ভোটার ও সবার উপকার হবে। কিন্তু তারাও এগুলোকে গুরুত্ব দেন না।
কী কী তথ্য দিতে হয়
প্রার্থীকে হলফনামার মাধ্যমে ৮ ধরনের তথ্য ও কাগজপত্র জমা দিতে হয়।
অর্জিত সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা;
প্রার্থীর বিরুদ্ধে বর্তমানে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না, তার সঠিক তথ্য;
অতীতে প্রার্থীর বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো ফৌজদারি মামলার রেকর্ড আছে কি না, থাকলে তার রায় কী ছিল;
পেশা;
আয়ের উৎস বা উৎসগুলো কী কী;
প্রার্থীর নিজের ও অন্যান্য নির্ভরশীলদের পরিসম্পদ ও আয়ের বিবরণী (আইনজীবীর মাধ্যমে প্রত্যয়ন করলেও গ্রহণযোগ্য হবে);
এর আগে জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন কি না এবং থাকলে ভোটারদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা অর্জন সম্ভব হয়েছিল;
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে প্রার্থী একক বা যৌথভাবে বা তার ওপর নির্ভরশীল সদস্যের নেওয়া ঋণের পরিমাণ।
ভুল তথ্য দিলে কী হয়
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে, হলফনামার মাধ্যমে প্রার্থী তথ্য না দিলে বা দাখিলকৃত হলফনামায় কোনো অসত্য তথ্য দিলে বা হলফনামায় কোনো তথ্যের সমর্থনে সার্টিফিকেট, দলিল দাখিল না করলে রিটার্নিং অফিসার নিজ উদ্যোগ অথবা কোনো ব্যক্তির উত্থাপিত আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করতে পারবেন এবং কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন।
এছাড়া হলফনামা দাখিল না করলে বা আদেশের বিধানবলী যথাযথভাবে প্রতিপালন না করলে ইসি বাছাই পর্যায়ে [আরপিও ১৪(৩)(সি)] সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
তাছাড়া হলফনামায় প্রদত্ত কোনো তথ্য মিথ্যা বা ভুল প্রমাণিত হলে তা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
যাছাইয়ের সময় ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়ায় জটিলতা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনে কোনো প্রার্থী যদি হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেন, ভোটের আগে ধরা পড়লে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা যেতে পারে; কিন্তু ভোটের পর এমন তথ্য পেলে ইসির করার কিছু থাকে না। যদি প্রতারণা করে, প্রতারণার মামলা হবে। এই ধারার শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আদালত। আদালত ব্যবস্থা নিয়ে জানালে ইসি ব্যবস্থা নেবে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনার আলমগীর ইতোমধ্যে বলেছেন, “মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় কেউ চ্যালেঞ্জ করলে ইসি তা যাচাই করে দেখে। যাচাইয়ে যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। এই ক্ষমতা ইসির আছে।”
তবে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম ২ ও চট্টগ্রাম-৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে লিখেছিলেন, 'শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই'।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করার পর তখন কমিশনের পক্ষ থেকে সংসদ সচিবালয়ের কাছে বিএনপির প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য চান। কারণ, তিনি আগেও সংসদে ছিলেন এবং উচ্চশিক্ষিত সালাউদ্দিন কাদেরের বিষয়ে তথ্য সংসদ সচিবালয়ে ছিল।
কিন্তু তথ্য গোপন করলেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ভোটে অংশ নেন, চট্টগ্রাম-৬ আসনে তিনি হারলেও জেতেন চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে।
আরও পড়ুন:
মন্ত্রী-এমপিদের হলফনামায় রিজভীর মনে ‘আলাদিনের চেরাগের’ স্মৃতি
১৫ বছরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আয় বেড়ে ১১ গুণ
২ বছরে তৈমুরের সম্পদ বেড়েছে ৮ গুণ, স্ত্রীর ৬৬ গুণ
১০ বছরে ইনুর অর্থ বেড়েছে ৫২ গুণ, স্ত্রীর ২৫