ঘূর্ণিঝড়টা এড়াতে পারলে কতভাবেই না বেঁচে যাই!

আমাদের তো 'সুপার সাইক্লোনের' অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সেটি ঘটে গেলে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যি কঠিন হবে। এ মুহূর্তে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সেটা সামাল দেওয়া সহজ হবে না।

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 12 May 2023, 06:04 PM
Updated : 12 May 2023, 06:04 PM

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় 'মোখা' শেষ পর্যন্ত কত গতিবেগ নিয়ে কোথায় আঘাত হানবে, তা সুনিশ্চিত করে বলা কঠিন হলেও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এটি মোকাবেলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ১৯৯১ সালের পর এ অঞ্চলে বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানেনি। বেশি আঘাত হেনেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। ২০০৮ সালে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় 'নার্গিস' শেষ মুহূর্তে কক্সবাজার উপকূল পাশে রেখে আঘাত হানে মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে। তাতে এত বিপুল প্রাণ ও সম্পদহানি হয় যে, মিয়ানমারের লিখিত ইতিহাসে এটা বলা যায় রেকর্ড। প্রকৃতির খেয়ালে আমাদের কক্সবাজার অঞ্চল রক্ষা পেলেও প্রতিবেশি দেশটির জনসাধারণকে এর চরম মূল্য দিতে হয়। মিয়ানমার সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে তখন কথা তুলেছিল সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহল।

যাহোক, মোখা এবার শেষ পর্যন্ত কতটা প্রবল হয়ে ঠিক কোথায় আঘাত হানবে, তা সুস্পষ্ট না হলেও এর অভিঘাত মোকাবেলার প্রস্তুতি তো নিয়ে রাখতেই হয়। বাংলাদেশ সরকারকে এখন এটি করতে হচ্ছে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে এ অঞ্চলে ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানাটা বলা যায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মাথায় নিয়ে চলাটাও রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে কোথাও সেভাবে আঘাত না হানলে। এ সুবাদে কিছু বৃষ্টিবাদল হয়ে গেলে বরং ভালো। আমরা তো এপ্রিল-মে'র সময়টায় এবার আশানুরূপ বৃষ্টির দেখা পাইনি। পুরো দেশজুড়ে দফায় দফায় বইছে তাপপ্রবাহ। সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবেও নতুন করে ভ্যাপসা গরম পড়েছিল দেশে। এর মধ্যে তাপমাত্রা কিছুটা কমে এলেও সিংহভাগ এলাকায় এটা এখনও অসহনীয়। তাতে দৈনন্দিন জীবনে পড়ছে নানা বিরূপ প্রভাব। ডায়রিয়াসহ গ্রীষ্মকালীন অসুখবিসুখ বেড়ে গেছে বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধদের। হাসপাতালে চাপ বাড়ছে রোগীর। মূল্যস্ফীতির এ সময়টায় চিকিৎসা ব্যয় বাড়লে অধিকাংশ পরিবারে কী অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা তো সহজে অনুমেয়।

খোলা জায়গায় কাজ করে যাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়, প্রচণ্ড গরমে তাদের মোকাবেলা করতে হয় দুর্যোগময় পরিস্থিতি। রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে পরিবহন, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে এরা নিয়োজিত। তাদের কাছ থেকে সার্ভিস নিতেও জোগাতে হচ্ছে বেশি টাকা। আগের ভাড়ায় কেন টেনে নিয়ে যাবেন রিকশাচালক, মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে? রোদে পুড়তে থাকা মাঠে কেন তারা নামবেন পেকে আসা ধান কাটতে? এ সময়ে ভুট্টা উত্তোলনও হচ্ছে কোথাও কোথাও। আখ ক্ষেতের পরিচর্যায় শ্রমিক নিয়োগ করতে হচ্ছে। বেশ কিছু অঞ্চল থেকে খবর আসছে, পর্যাপ্ত শ্রমিক মিলছে না বিশেষত ধান কাটা এবং পরবর্তী কাজগুলো করানোর জন্য। স্বভাবতই মজুরি গেছে বেড়ে। এটা অবশ্য খারাপ খবর নয়। মজুরি বাড়লে এ শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, যেটা এ সময়ে খুব প্রয়োজন।

তবে যিনি ফসল ফলানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, তারও পোষাতে হবে। ধান-চালের ভালো দাম পেতে হবে তাকে। ধান ফলিয়ে ন্যূনতম একটা মুনাফা করতে না পারলে এ কাজে তিনি নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খাদ্য নিরাপত্তা। এজন্য কম খরচে রিপার ও হারভেস্টার মেশিনে ধান উত্তোলনের ব্যাপারটি সামনে আসছে দ্রুত। এতে ধান উত্তোলন, এমনকি সেটা সংগ্রহ করে বস্তাবন্দি করার কাজও দ্রুত সেরে ফেলা যাচ্ছে। প্রসঙ্গটা এলো এ কারণেও যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের শংকায় আমাদের তো অনেক ক্ষেত্রে কম পাকা ধানও দ্রুত কেটে ফেলতে হয়। ঘূর্ণিঝড় মোখা প্রবল শক্তি নিয়ে আঘাত হানতে পারে, এ আশংকায় কৃষি বিভাগ বলছে ৮০ ভাগ পেকে গেলেও ধান দ্রুত কেটে ফেলতে। যেখানে মোখা আঘাত হানবে বলে ধারণা, সেই কক্সবাজার অঞ্চলে বোরো ধানের কত শতাংশ এরই মধ্যে কেটে ফেলা সম্ভব হয়েছিল, কে জানে।

শংকাকে সত্য করে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানলে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশে বোরোসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হবে সন্দেহ নেই। যারা আগাম বোরো করেননি, তারা এ অসুবিধার মধ্যে পড়বেন। তবে এটা সুখবর যে, হাওরাঞ্চলে ধান কাটা বলতে গেলে শেষ হয়েছে। উজানেও এবার প্রবল বর্ষণ এবং তা থেকে আগাম বন্যা না হওয়ায় আমরা একটা সম্ভাব্য দুর্যোগ এড়াতে পেরেছি। তাতে উল্লেখযোগ্য বোরো ফসল রক্ষা করা গেছে। এদিকে অনেকে গ্রীষ্মকালীন সবজি ফলাচ্ছেন। তাপপ্রবাহে তারাও বিপাকে ছিলেন। এমন বৃষ্টিহীন বৈশাখ তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আর মোকাবেলা করেননি। এমন মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহে জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে বেশি। সবজির ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পাশাপাশি আবার খরচ বেড়ে যাচ্ছে আবাদের। এর প্রভাব গ্রীষ্মকালীন সবজির বাজারে এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বলে ধারণা। সবজির বেড়ে যাওয়া দামে কৃষক কতটা লাভবান হচ্ছেন, ওই প্রশ্নও রয়েছে। এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টি-বাদল হলে এবং তাতে তাপমাত্রা কমে এলে সবরকম শস্য উৎপাদনকারীরই লাভ। আর কৃষিখাত স্বাভাবিকভাবে কাজ করলে কিছুটা হলেও লাভ হবে সরকারের। তার পক্ষে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি মোকাবেলা তখন হয়তো কিছুটা সহজ হবে। অন্তত কঠিন হবে না।

এর আগে বিডিনিউজে প্রকাশিত নিবন্ধে কিছুটা আলাপ করেছিলাম কৃষিতে দু-দফায় বাড়ানো সারের দামের প্রভাব নিয়ে। গ্রীষ্মকালীন সবজিতে এর প্রভাব স্পষ্টভাবে থাকবে। তাপপ্রবাহ থেকে ফসল রক্ষায় যে বাড়তি সেচ দিতে হচ্ছে, তাতেও খরচ বাড়বে কৃষকের। ডিজেলের দামও তো উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হয়েছে। কৃষকের একটা বড় অংশ সার ও সেচ ব্যবহারে দক্ষ নয় বলে অবশ্য অভিযোগ রয়েছে। তারা নাকি জমি ও শস্য নির্বিশেষে এর অতিব্যবহার করে অপচয় ঘটান। এটা সত্য হলে সরকারের কৃষি কর্মকর্তাদের উচিত হবে কৃষকের উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দক্ষ করতে ভূমিকা রাখা। তাদেরও এর দায় নিতে হবে।

আমাদের সব প্রত্যাশা চুরমার করে দিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোখা যদি কক্সবাজার উপকূলেই আঘাত হানে, তাহলে কী হবে? এ ধরনের দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি সীমিত পর্যায়ে রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের অভিজ্ঞতা তো কম নয়। সেটা নিশ্চয়ই কাজে লাগানো হবে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী অঞ্চলে মৎস্যজীবী কম নেই। তারা সতর্ক সংকেত অনুযায়ী কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর সতর্ক সংকেত বোঝা ও মেনে চলাটা উপকূলীয় জনসাধারণের মধ্যে বেড়েছে বৈকি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে পাওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঠিকঠাক হওয়ার অভিজ্ঞতাও তাদের যথেষ্ট হয়েছে। পরিস্থিতি তেমন হলে ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষকে এনে তোলা হবে নিশ্চয়ই। এ সময়ে দরিদ্র পরিবারগুলো আগলে রাখতে চায় গবাদিপশু। আজকাল অনেকে তো কেবল কোরবানির হাটকে টার্গেট করে গরু-ছাগল পালন করেন। তৃণভূমি কমে আসায় সীমিত জায়গায় রেখে গবাদিপশু পালনও বেড়েছে। এতে বিনিয়োগ বেড়েছে মানুষের। সময়মতো আর ঠিক দামে বেচতে পারলে সেটা মুনাফাসহ উঠে আসতেও দেখা যায়। এমনিতেও দুধ ও মাংসের দাম বেড়েছে। খামারে বাছুর থাকলে তার বিক্রিও লাভজনক। ঘূর্ণিঝড়ের সময় গবাদিপশু রক্ষাও তাই হয়ে ওঠে বড় কাজ।

কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনে এ সময়ে অবশ্য পর্যটক তেমন নেই। গেল ঈদের ছুটিতে ভালো ব্যবসা হয়েছে কক্সবাজারসহ চালু পর্যটন স্পটগুলোয়। ওই সময়ে তাপমাত্রা সহনীয় থাকলে ব্যাপারটা আরও ভালো হতো বৈকি। এখন ওই অঞ্চলে যেসব শক্তপোক্ত হোটেল-মোটেল রয়েছে, তাদের তাৎক্ষণিক দায়িত্ব হলো ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে বিপদগ্রস্ত জনসাধারণকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় দেওয়া। নির্ধারিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলো অবশ্য শেষ ভরসা। সেগুলো আবার ঠিকমতো 'ম্যানেজ' করতে হবে। এ এক কর্মযজ্ঞ। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠোমোও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয়। এ সময়ে আবার চলছে এসএসসি পরীক্ষা। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা সহজ হবে না; তবে দায়িত্ব হয়ে উঠলে সরকারের সব বিভাগকেই তা পালনের চাপ নিতে হবে।

চলতি তাপপ্রবাহে কক্সবাজার অঞ্চলের লবণচাষীরা অবশ্য উপকৃত হয়েছিলেন। তাদের উৎপাদন বেড়েছিল বলে খবরে প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপ আচরণে সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এ হলো তারই দৃষ্টান্ত। এমন নিশ্চয় আরও আছে। কথা হলো, ঘূর্ণিঝড় মোখা সত্যি সত্যি বর্ণিত শংকা অনুযায়ী আঘাত হানলে এসব উপকূলবর্তী ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চিংড়ি ঘের ও হ্যাচারিগুলোও কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এদের পুনর্বাসনে সরকারকেই অগত্যা এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংককে। জানি না ঘূর্ণিঝড়ের নিত্য শংকায় থাকা এসব ব্যবসায়ী বীমা করেছেন কিনা। অবশ্য ঝড়ের সময় জোয়ার কতটা হয়, তার ওপর ক্ষয়ক্ষতি অনেকখানি নির্ভর করে।

মোখা প্রবল থেকে অতিপ্রবল হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখাচ্ছে এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত। আমাদের তো 'সুপার সাইক্লোনের' অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সেটি ঘটে গেলে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যি কঠিন হবে। এ মুহূর্তে দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে সেটা সামাল দেওয়া সহজ হবে না। সরকারের হাতে অর্থকড়ি তেমন নেই। রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ভালো নয়। তার হাতে চাল-গমের মজুদ সন্তোষজনক কিনা, সে প্রশ্ন উঠবে। দ্রুত সামনে চলে আসা এমন দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যও সবসময় বলা হয় খাদ্যশস্যের একটা জোরালো মজুদ রাখতে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকি নিয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক মানুষ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করতে হবে। আসছে বাজেটে এটা ফেলবে বাড়তি চাপ। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চাইতে হতে পারে।

কক্সবাজারে প্রবল কোনো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত মানে কিন্তু মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা বসতিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। তাদের জীবন এমনিতেই এলোমেলো। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায়ও এদের উপস্থিতি সৃষ্টি করেছে বাড়তি চাপ। নিজ দেশে তাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ অবস্থায় সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করাও সরকারের বাড়তি দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। তাদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা অবশ্য কম নয়। কিন্তু পরিস্থিতি তেমন হলে পুরো বিষয় সমন্বয়ের চাপ যাবে সরকারের ওপর দিয়ে। সামনেই আবার জাতীয় নির্বাচন। সিটি নির্বাচন নিয়েও একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এর মধ্যে প্রকৃতির খেয়ালেও যদি ঘূর্ণিঝড়টা এড়ানো যায়, তার চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না।