চাই সফল উত্তোলন, জোরালো মজুদ ও সুরক্ষা

এবার বোরো উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা কি অর্জন করা যাবে? গেলবার লক্ষ্যমাত্রার কিছুটা কম অর্জিত হয়েছিল। এবার শেষতক কী দাঁড়াবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে বোরো আমাদের প্রধান ধান-চাল উৎপাদনকারী মৌসুম হয়ে উঠেছে কালক্রমে। মোট চালের ৫০ শতাংশেরও বেশি পাই আমরা বোরো থেকে।

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 2 May 2023, 06:35 AM
Updated : 2 May 2023, 06:35 AM

দেশের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটা এখন শেষ পর্যায়ে বলেই ধারণা। ঢল কিংবা প্রতিকূল ঝড়বৃষ্টির আশংকায় হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বলা হয়েছিল দ্রুত ধান উত্তোলন করতে। এপ্রিলে দীর্ঘ সময়জুড়ে এবার মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাদের। তাতে উত্তোলনের আগমুহূর্তে বোরোর ফলন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, তা কৃষি সংশ্লিষ্টরাই বলতে পারবেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও ধান কেটে ঘরে তোলার খবর মিলছে– বিশেষত আগাম বোরো যারা রোপণ করেছিলেন। অসহনীয় তাপদাহ আর নেই অধিকাংশ অঞ্চলে। তাতে ধান উত্তোলন অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। যেমন তাপপ্রবাহ ছিল, তাতে ভালো মজুরি দিয়েও লোকজনকে নামানো যাচ্ছিল না মাঠে। অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া যখন একটু সহনীয়, তখন ধান কাটতে নেমে অনেকে আবার পড়ছে বজ্রসহ বৃষ্টিতে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন কৃষিশ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মারা গেছেন বজ্রপাতে।

তবু বোরো উত্তোলনটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেলেই হয়। মে মাসের মধ্যভাগে ঘূর্ণিঝড়ের একটি পূর্বাভাস রয়েছে, যদিও তা যথেষ্ট সমর্থিত নয়। তবে এ সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের রেকর্ড রয়েছে এ অঞ্চলের নিকট অতীতে। তাই সতর্ক থাকা ভালো। প্রতিকূল ঝড়বৃষ্টি, বিশেষত শিলাবৃষ্টিতে বোরোর ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের জন্য তা হবে বড় আঘাতস্বরূপ। কৃষিক্ষেত্রে এদের সংখ্যাই তো বেশি এবং ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এ কৃষকদের সিংহভাগ আবার ধারকর্জ করে আবাদে গিয়ে থাকে আর তাই বেশিদিন ফসল ধরে রাখতে অক্ষম। অনেকে আবার বর্গাচাষী। তাদের ক্ষতিও অসহনীয় হবে। কৃষি বিভাগকে তাই যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে এদের পাশে থাকতে হবে। ধান কাটায় যন্ত্রের ব্যবহার ক্রমে বাড়ছে। প্রয়োজনে এ সুবিধা জোগাতে হবে তাদের। শ্রমিকের অভাবেও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ফসল উত্তোলনে দেরি হয়ে যায়।

এবার বোরো উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা কি অর্জন করা যাবে? গেলবার লক্ষ্যমাত্রার কিছুটা কম অর্জিত হয়েছিল। এবার শেষতক কী দাঁড়াবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে বোরো আমাদের প্রধান ধান-চাল উৎপাদনকারী মৌসুম হয়ে উঠেছে কালক্রমে। মোট চালের ৫০ শতাংশেরও বেশি পাই আমরা বোরো থেকে। এটা আবার উপকরণনির্ভর। সেচ ও সার বেশি লাগে এতে। খরচ স্বভাবতই বেশি। কৃষকের খরচ যেমন; সরকারের ভর্তুকিও কম নয়। এটাকে তাই যত সফল করা যায়, ততই মঙ্গল। খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে দেখলেও।

তাপদাহ চলতে থাকায় মৌসুমের শেষ সময়টায় বোরোতে এবার সেচ বাবদ বেশি খরচ করতে হয়েছে। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো হয়েছিল বেশ কয়েকমাস আগে। সম্প্রতি আবার বাড়ানো হয় ইউরিয়াসহ চাররকম সারের দাম। দ্বিতীয় দফায় এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব বোরোতে নেই বলে দাবি করা হচ্ছে। ততদিনে ধান পেকে আসার সময় হয়ে এসেছে নাকি। তবে এক বর্ধিত সেচের কারণেই বোরোর উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। কৃষিতে মজুরি অন্তত হ্রাস পায়নি। কীটনাশকের দামও বাড়তি বলে চলমান পরিস্থিতিতে আন্দাজ করা যায়। এ অবস্থায় বোরো উত্তোলন সফল করলেই হবে না– এর লাভজনক দাম পেতে হবে কৃষককে। এক্ষেত্রে সরকার একটা ভূমিকা নিয়ে থাকে সংগ্রহ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে। উত্তোলন মৌসুমের শুরু থেকে কয়েকমাস পর্যন্ত সরকার ধান-চাল সংগ্রহ বা কেনার ঘোষণা দেয়। কৃষকের বিনিয়োগসহ নানা দিক বিবেচনায় দামটা এমনভাবে স্থির করতে চাওয়া হয়, যাতে তার হাতে একযোগে ধান আসার সময়টায় দাম পড়ে না যায়। সব মৌসুমে ধানের মূল ক্রেতা স্বভাবতই বেসরকারি খাত। তাদের হাতে উৎপাদক কৃষক যাতে ঠকে না যায়, সেজন্যই এ সংগ্রহ অভিযান।

এর অন্যান্য উদ্দেশ্যের কথাও আমাদের জানা। সরকার চায় তার হাতে চালের একটা উল্লেখযোগ্য মজুদ রাখতে, যাতে যেকোনো পরিস্থিতিতে সেটা কাজে লাগানো যায়। বছরজুড়ে ধান-চালের সিংহভাগ মজুদ যাদের হাতে থাকে, তাদেরকে সদাচরণের বার্তাও দিতে চায় সরকার– বোরো ও আমন সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করে। সরকারকে তো কিছু খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও লাগাতারভাবে পরিচালনা করতে হয়। চলমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে এর চাহিদা বাড়ছে বৈকি। হাতে গমেরও একটা মজুদ রাখতে চায় সরকার। প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যা ও চাহিদা বিচারে চাল-গমের কতটা মজুদ রাখা নিরাপদ? এ নিয়ে বিতর্ক কিন্তু নতুন নয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, দেশে গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক চলছে। কৃষিখাতেও আছে এটা। তাতে লাগসই নীতি-কৌশল নিয়ে আস্থার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না।

পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তুলতে সরকার চাল আমদানিও করে চলেছে। বেসরকারি খাতও এটা করছে। গেল মার্চ পর্যন্ত চাল আমদানি সহজ করতে সরকার প্রায় বিনাশুল্ক নীতি অবলম্বন করছিল। এর আওতায় আমদানি হওয়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল এখনও পাইপলাইনে বলে জানা যাচ্ছে। জরুরি এ খাদ্যপণ্যের আমদানি নিশ্চিত করতে অন্যান্য পণ্য, এমনকি শিল্পের উপকরণ আমদানি নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা গেছে। দেশে বিদেশি মুদ্রা, বিশেষত ডলারের সংকট চলছে অনেকদিন ধরে। এর দাম বেড়েছে অনেক। তাতে যেকোনো পণ্যের আমদানি হয়ে উঠেছে কমবেশি ব্যয়বহুল। ইউক্রেইন যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্ববাজারে চাল-গমের মতো পণ্যের বাজারও চড়া কিংবা অস্থির। তাই ব্যাপক শুল্ক ছাড় দিলেও আমদানি করা চালের দাম তেমন কম পড়ছে না। দেশের খুচরা বাজারে চালের দামের ওপর এর বড় কোনো প্রভাব পড়ছে না তাই।

আবার দেখা যাচ্ছে, ধান-চাল উত্তোলন মৌসুমেও চালের দাম কমছে না। এর ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা রোধ হচ্ছে বড়জোর। এতে আবার বোঝা যায়, চাহিদা ও জোগানে একটা ঘাটতি নিশ্চয়ই আছে। চাল উৎপাদন ও এর চাহিদা বিষয়ে যেসব তথ্য সরকারিভাবে পরিবেশিত হয়, তার বিশ্বাসযোগ্যতা এক্ষেত্রে হয়ে পড়ে প্রশ্নবিদ্ধ। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যে দাবি একসময় করা হতো, তা অবশ্য এখন আর সেভাবে করা হচ্ছে না। না করাই ভালো; কেননা আমাদের তো চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এরই মধ্যে গত এক বছরে মোটা ও চিকন চালের দাম বেড়েছে ১৮-২০ শতাংশ। একটা দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্যের এতটা দাম বৃদ্ধি দুশ্চিন্তার বিষয় বৈকি।

বেশি দামে চাল বিক্রি হয়ে কৃষক লাভবান হলে তা অবশ্য ভালো। আমদানি করা চালের পরিমাণ কিন্তু এখনও কম। তাই এর দাম বেড়ে কৃষক লাভবান হলে দেশের কৃষকেরই লাভ। কিন্তু সেটা আদৌ হচ্ছে কিনা, হলে কতখানি– এটা এক জরুরি প্রশ্ন। কৃষক অবশ্য অবিভাজ্য সত্তা নয়। ধনী কৃষকও রয়েছে এবং তাদের ধান-চাল ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি। বেশি দামের আশায় খাদ্যশস্য ধরে রাখার ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত রয়েছে লাভবান হওয়ার প্রশ্ন। এ ক্ষমতা চালকল মালিকদের সবচেয়ে বেশি। এখন তো অটো রাইস মিলের যুগ। এর মালিকদের জোটবদ্ধতাও দেখবার মতো। তাদের নিয়োজিত লোকেরা কৃষকের একেবারে দরজায় এসে ধান কিনে নিয়ে যায়। পরে ওই ধানের চালই হয়তো কৃষককে কিনতে হয় বেশি দামে। চালের বাজারটা আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে চালকল মালিকরা। ধনী কৃষক তাদেরই গোত্রীয় কিংবা অনুসারী। করপোরেট হাউসগুলোও চালের বাজারে ঢুকে নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকায় শামিল হতে চাইছে।

সরকার ধান-চাল সংগ্রহের ঘোষণা দেয় বটে; তবে আসলে সংগ্রহ করে চাল। কৃষকের কাছ থেকে দক্ষতার সঙ্গে কিনে নিয়ে ধান ভাঙিয়ে চালকল মালিকরাই তা জোগায় সরকারকে। কৃষক সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে এসে ধান বিক্রিতে নিরুৎসাহিত অনেক আগে থেকেই। বেসরকারি খাত তাকে অপেক্ষাকৃত ভালো দামও জুগিয়ে থাকে। সরকার নির্ধারিত দামকে ‘আকর্ষণীয়’ করার কথা তাই বলা হয়ে আসছে। ধান-চাল সংগ্রহের অন্যান্য সমস্যা ‘অ্যাড্রেস’ করার কথাও বলা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। অন্যান্য দেশের এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থেকেও তো শিক্ষা নেওয়া যায়।

সরকার এবার বোরো ধান-চাল সংগ্রহের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা গেল আমন মৌসুমের চেয়ে যথাক্রমে ৩ ও ৪ টাকা বেশি। ধান ৩০, চাল ৪৪ টাকা। এক্ষেত্রে বর্ধিত উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে চালের বিদ্যমান দাম নিশ্চয়ই বিবেচ্য হয়েছে। ৫০ টাকার কমে খুচরা বাজারে মোটা চাল মিলছে না অনেকদিন ধরে। সরকার নির্ধারিত দামেও বোঝা যায়, বোরো উত্তোলনের পরও চালের দাম কমার সম্ভাবনা কম। কিছুটা বেড়েও যেতে পারে। সামনে আউশ ও আমন মৌসুমে প্রকৃতির সহায়তার কারণে সেচ চাহিদা হয়তো কমবে; কিন্তু সার বাবদ খরচ কমবে না। তিন মৌসুম মিলিয়ে চাল ‘যথেষ্ট’ উৎপন্ন হলেও এর উপকরণ ব্যয়ের কারণেই দাম কমার সুযোগ তাই খুব সীমিত। নিকট-বিকল্প বলে বিবেচিত আটার দাম আরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে চালের চাহিদা আরও বাড়ার কথা। এ কারণেও তাত্ত্বিকভাবে চালের দাম কমার সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত।

এ অবস্থায় সরকারকে দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ভর্তুকি ও বিনামূল্যে চাল বিতরণ করে যেতে হবে। সেজন্য তার হাতে জোরালো মজুদ থাকা চাই। প্রয়োজনে আমদানির মাধ্যমে হলেও সেটা নিশ্চিত করে মানুষের মনে জোগাতে হবে স্বস্তি। বাজারকে প্রভাবিত করার মতো মজুদ না থাকলেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রাপ্য মেটানোর সামর্থ্য যেন তার থাকে। পাশাপাশি এদের রুজি-রোজগার বাড়ানোর দিকে সযত্ন মনোযোগ থাকলে পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন হবে না। আগামী অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকার আরও জোর দেবে বলে জানিয়েছে। এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নও দেখতে চাইব।