কেবল একজন যোগ্য মানুষকে কোনো একটি একাডেমির মহাপরিচালক পদে দেখলেই, প্রতিষ্ঠানটি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে এমনটি মনে করার কারণ নেই। প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞের বড় বাস্তবতা প্রশাসনিক দিক এবং পরেরটা সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মের দেখভাল আর উপস্থাপন।
Published : 05 Nov 2024, 05:59 PM
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনগুলোর মধ্যেও রদবদল এবং নতুন মেরুকরণ দৃশ্যমান হতে থাকে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বাংলা একাডেমি এবং শিল্পকলা একাডেমির মতো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন নির্বাহী প্রধান বেছে নেওয়া হয়েছে এবং নতুন এই সব নিয়োগ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদের নিয়োগও প্রশংসিত হয়েছিল নানা তরফ থেকে। তবে নাটকের নিবেদিত এই মানুষটিকে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ। নাটকের চর্চা, পাঠদান এবং গবেষণায় দেশ-বিদেশে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সমাদৃত হয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ইংরেজি সাহিত্য এবং নাট্যকলা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। দেশের ভেতরে নাট্যনির্দেশনাকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করার জন্য দু-একজনের নাম নিতে হলে তার নাম গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারণ করবার প্রয়োজন রয়েছে।
ওই রকম একজন মেধাবী মানুষ শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব নিয়েছেন, যিনি কথায় না শুনিয়ে কাজ দেখিয়ে প্রমাণ করবেন, তিনি পেরেছেন— এমনটাই আমার মতো অনেক অভাজনের পর্যবেক্ষণ। তিনি এমন এক সময়ে দায়িত্ব নিলেন, তার আগে লিয়াকত আলী লাকী ছিলেন এই দায়িত্বে। যিনি নানা বিতর্ক আর বিরক্তির জন্ম দিয়ে গেছেন।
আমি এখানে ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ সামনে আনতে চাই। আদতে এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কতটুকু এখতিয়ার বা সুযোগ আছে দেশের সাংস্কৃতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের? কেবল একজন যোগ্য মানুষ হলেই কি, তিনি তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন? বেশি দূরে যেতে হবে না। লিয়াকত আলী লাকীর পূর্বে এই পদে ছিলেন কামাল লোহানী। শিল্পকলা একাডেমির ইতিহাসে এরকম যোগ্য, দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণাসমৃদ্ধ মানুষ এবং পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মহাপরিচালককে বেশিদিন কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অসহযোগিতা শুরু হয়েছিল সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লদের তরফ থেকেই।
এরপর ভদ্রলোক লাকী এলেন। তিনি ছিলেন একাধারে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিও। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তার জন্য সঙ্গত ছিল সভাপতির পদ ছেড়ে দেওয়া। তিনি তা না করে সভাপতির পদটিও আঁকড়ে ধরেছিলেন। এর মধ্যে পরিবর্তিত বাস্তবতায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন সভাপতি হিসেবে লাকী ইনাম দায়িত্ব নিয়েছেন। একইসঙ্গে ফেডারেশনের পুনর্গঠন বা সংস্কারের জন্যে নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক মামুনুর রশীদকে প্রধান করে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে শিল্পকলা একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক একাডেমির আইনকে যুগপোযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। দুটো উদ্যোগের পেছনেই ইতিবাচক কারণ আছে বলেই কতগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসতে চাই।
শুরুর প্রশ্নগুলো গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে ঘিরে। ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করা এই সংগঠন দেশের মঞ্চ নাট্যদলগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাবি করে আসছে। প্রায় সাড়ে চার দশকের ইতিহাসে দেশের নাটক চর্চাকে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে এবং নাট্যচর্চায় পেশাদারি উৎকর্ষ, বিকাশ এবং প্রসারের নিমিত্তে উল্লেখ করার মতো কোনো সাফল্য এই ফেডারেশনকে ঘিরে কি আমাদের সামনে আছে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলায় স্নাতক বা স্নাতকোত্তর করে একজন তরুণকে যদি অন্যবিধ পেশা বেছে নিয়ে রুটিরুজি চালাতে হয়, তাহলে নাট্যকলায় পড়ার মাজেজা কী? এই প্রশ্নটি নিয়ে থিয়েটার ফেডারেশন কার্যকর কোনো দাবিনামা যথাযথ জায়গায় উত্থাপন করেছিল কি বিগত সাড়ে চার দশকে?
আদতে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ দেশের গোটা সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছিল প্রায় এক ডজন করপোরেট ঠিকাদারি মোড়লের হাতে। সরকার বদলেছে, রাজনৈতিক হাওয়া বদলেছে, কিন্তু এদের নড়চড় হয়নি। বিগত সাড়ে চার দশকে সবথেকে উপেক্ষিত হয়েছে তরুণ সমাজ। এই সময়ে দুটি প্রজন্ম বের হয়ে আসবার কথা। খোদ রাজধানী ঢাকা প্রায় দুই কোটি মানুষের জনপদ। অথচ এর বিপরীতে উল্লেখ করার মতো মঞ্চনাটকের জায়গা কেবল মহিলা সমিতি এবং শিল্পকলা একাডেমি। দরকার ছিল গোটা নগর সংস্থার প্রতিটি ওয়ার্ডে নাটক মঞ্চায়ন ও প্রদর্শনীর জন্যে নিজস্ব আয়োজন থাকা। দুর্ভাগ্যের হলেও আমাদের নগরে ওই বিধিব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
এই পর্যায়ে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে আধুনিক নাট্যচর্চায় পেশাদারি বিকাশ কীভাবে সাধিত হয় তার কয়েকটা নমুনা সামনে নিয়ে আসতে চাই।
প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই আয়ারল্যান্ডের কথা। দেশটির রাজধানী ডাবলিনের কেন্দ্র এবং প্রান্তের শহরতলীর নাট্যশালাগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে বছর বছর নতুন নাট্যকার, নাট্যনির্দশক এবং অভিনেতা অভিনেত্রী তুলে ধরার মধ্যে।
অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসা রাষ্ট্র জর্জিয়ার বাটুমি নামক একটি শহরে প্রতিবছর দেশের নাট্যশালাগুলো নতুন নাট্যকারের প্রথম নাটক, নতুন নির্দেশকের প্রথম প্রযোজনা নিয়ে হাজির হয় নাট্যউৎসবে।
এবার নজর ফেরাতে চাই পাশের দেশ ভারতের দিকে। ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নিবন্ধিত নাট্যদল এবং নাটশালাগুলো নতুন নাটক প্রযোজনার নিমিত্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ পেয়ে থাকে। যা দিয়ে নির্দেশকসহ প্রায় পনেরোজন কলাকুশলীর রুটি-রুজির বড় একটা অংশের সংস্থান হয়ে যায়। এতে করে নাটকের পেশাদারি চর্চা ও বিকাশের পথ অবারিত থাকে। তাতে কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতবাদ চাপিয়ে দেবার ব্যাপার ঘটে না।
এখন আমার প্রশ্ন, আমাদের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন বছর বছর মোড়ল তোষণ ছাড়া উল্লেখ করার মতো এমন কী করেছে যা আমরা জানি না? প্রায় পাঁচ দশকে আমাদের নাট্যঙ্গন কি পঞ্চাশজন নতুন নাট্যনির্দেশক, নাট্যকার তুলে ধরতে পেরেছে? না পেরে থাকলে এর পেছনের গলদের দায় কি এই ফেডারেশন এড়াতে পারে?
গত আড়াই দশকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের খপ্পরে পড়ে দেশের যাত্রাশিল্প বিলুপ্তির পথে। অথচ এর পুনরুদ্ধার এবং বিকাশের জন্যে কার্যকর লাগসই কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এটিকে শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা বিভাগের ‘লেজ’ হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে। অথচ খোদ যাত্রাশিল্পের জন্যে দরকার একটি স্বতন্ত্র যাত্রা উন্নয়ন সংস্থা বা যাত্রা উন্নয়ন একাডেমি। এ ব্যাপারে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন কখনো কি কোনো প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে?
এরপরের প্রশ্নগুলো শিল্পকলা একাডেমিকে ঘিরে। এখানে বলে নিতে চাই, কেবল একজন যোগ্য মানুষকে একাডেমির মহাপরিচালক পদে দেখলেই, প্রতিষ্ঠানটি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে এমনটি মনে করার কারণ নেই। প্রতিষ্ঠানের কর্মযজ্ঞের বড় বাস্তবতা প্রশাসনিক দিক এবং পরেরটা সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মের দেখভাল আর উপস্থাপন।
যেসব দেশে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পেশাদারি মানদণ্ড বজায় রেখে ভূমিকা রাখতে পারে, ওইসব দেশে অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চুক্তিভিত্তিক বহিরাগত যোগ্য মানুষদের নিয়োগের পরিবর্তে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পেশাদারি আমলা গড়ে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। আমলাদের কাজ আমলাদের দিয়েই করানো সঙ্গত। আমাদের দেশে তথ্যের জন্য, ডাক বিভাগের জন্য, রাজস্বের জন্য যদি আলাদা ক্যাডার থাকতে পারে তাহলে সংস্কৃতির জন্যে কেন নয়?
সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্বশাসন বলবৎ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের যোগ্য মানুষদের নিয়ে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র পরিচালনা বোর্ড থাকতে পারে। সংশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পরিচালনা বোর্ডের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবেন এবং বোর্ডের কাছে যাবতীয় কর্মযজ্ঞের জন্যে জবাবদিহি থাকবেন।
এই বিষয়গুলো যুগোপযোগী আইন দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। এখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্ত মন্ত্রী বা সচিব দেশের সংস্কৃতির জন্যে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে করণীয় বাতলে দিতে ভূমিকা রাখবেন। তবে শিল্পকলা একাডেমি বা অন্যান্য স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবেন না। অথচ আমাদের দেশে হয়ে আসছে এর উল্টো। আমাদের এই একাডেমি নামে স্বায়ত্বশাসিত বাস্তবে এর সভাপতি মন্ত্রী এবং সহসভাপতি মন্ত্রণালয়ের সচিব। এরকম স্বায়ত্বশাসন অনেকটা কাগজের বাঘ ছাড়া আর কিছু নয়।
বিদ্যমান বাস্তবতায় দায়িত্বের দিক থেকে আমাদের দেশের শিল্পকলা একাডেমি অন্যান্য কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশের সংস্কৃতি অধিদফতর বা আর্টস কাউন্সিলের সমপর্যায়ের। কিন্তু আমাদের একাডেমির কাঠামোগত দুর্বলত, কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা, লোকবল এবং এখতিয়ারের ঘাটতি রয়েছে ব্যাপকতর।
এসব বিষয় নিয়ে অনাগত দিনের নির্বাচিত সরকার জাতীয় সংস্কৃতি নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশের সাংস্কৃতিক বলয়কে আশাপ্রদ পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমির অগ্রগতি সাধনের পাশাপাশি আলাদা সংস্কৃতি অধিদফতর প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনায় নিতে পারেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই, দুনিয়ার জাতীয় সংস্কৃতি দফতর বা সংস্থার আন্তর্জাতিক সংগঠন The International Federation of Arts Councils and Culture Agencies (IFACCA)-তে আফ্রিকা, এশিয়া ইউরোপসহ অন্যান্য মহাদেশের অনেক দেশ সদস্য হলেও, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এর সদস্যপদ পাবার জন্যে উদ্যোগী হয়নি। শিল্পকলা একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারেন।
এই পর্যায়ে ইতোমধ্যে ঘটে যাওয়া মন খারাপের খবরটি সামনে নিয়ে আসতে চাই। একটি নাটকের প্রদর্শনী চলার মাঝপথে এসে মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়েছেন, একইসঙ্গে তিনি দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। অজুহাত হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন একাডেমির বাইরে অজ্ঞাত কিছু লোক বিক্ষোভ করছে এবং নাটক বন্ধের দাবি জানিয়েছে। এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে দেশের সংস্কৃতি, নাট্যাঙ্গন আর শিল্পকলা একাডেমির ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে আমরা কি তা কল্পনা করতে পারছি?
এহেন বাস্তবতায় অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ বরাবর আমার প্রশ্ন, শিল্পকলা একাডেমি এবং খোদ রাষ্ট্রের অবস্থা কি এতটাই নাজুক? রাজধানীর মধ্যে একটি জাতীয় একাডেমির নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্র ব্যর্থ নাকি অপারগ নাকি আন্তরিক নয়? নাকি একাডেমির তরফ থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অনুরোধ জানানোই হয়নি?
আরও পড়ুন
'নিত্যপুরাণ' নাটকের প্রদর্শনী ফেরত দেওয়ার দাবি নাট্যকর্মীদের
মাঝপথে নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ 'নিরাপত্তা' বিবেচনায়: জামিল আহমেদ
হঠাৎ বিক্ষোভে শিল্পকলায় মাঝপথে বন্ধ হল নাটকের প্রদর্শনী
'লাকীমুক্ত' গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
শিল্পকলাকে সচল করতে সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর দরকার: সৈয়দ জামিল