মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় সকল প্রকার কট্টরপন্থী অসহিষ্ণু মতাদর্শিক ও ধর্মীয় বাধা এবং প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও মোকাবিলা করার কথাও বলেন তিনি।
Published : 11 Sep 2024, 08:57 PM
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে ‘নতুন দেশের’ আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সচল করতে সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর দরকার বলে মনে করেন একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এই লক্ষ্য পূরণে মহাপরিচালকের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা-পদসোপান ও জবাবদিহিতা পুনর্নির্ধারণ করার কথাও বলেছেন তিনি।
বিড়ত সরকারের সময় সৃষ্ট একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরতান্ত্রিক পরিচালনপদ্ধতি ও স্বভাব বদলে দিতে হবে বলেও জানান মহাপরিচালক।
আগামী দুই বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক সৈয়দ জামিল আহমেদকে শিল্পকলার মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জামিল আহমেদকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির পর মঙ্গলবার থেকে কাজে যোগ দেন তিনি।
বুধবার বিকেলে একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে শিল্পকলা নিয়ে তার কাজের লক্ষ্য তুলে ধরেন। এ সময় একাডেমির কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সংস্কার, পরিচালন-নীতি, আইন-প্রবিধানমালা বিষয়ে করণীয় নিয়ে তার পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
প্রয়োজন আইনের সংস্কার
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯ এর ধারা ২ থেকে ধারা ১৩ এর ৩ নং উপধারা পর্যন্ত কোথাও বস্তুত এই একাডেমি বলতে রাষ্ট্র কী মনে করে এবং এর ভিশন (রূপকল্প) কী, তা স্পষ্ট হয় না বলে জানান নতুন মহাপরিচালক।
আইনের ফাঁক গলে একাডেমি কিভাবে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত ও পর্যবসিত হবার ঝুঁকিতে পড়ে তাও ব্যাখ্যা করেন জামিল আহমেদ।
শিল্পকলা আইনের সংস্কারের দাবি তুলে তিনি বলেন, “২০২৪-এর রক্তস্নাত জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়কে একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে, এক ক্রান্তিক্ষণ রূপে বিবেচনা করা যায়।
“এমন একটি সময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান আইনের ৪ থেকে ১৩ নং ধারা পর্যন্ত স্থগিত বা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তার দিকে সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তাই, একাডেমির ভিশনকে পুনরায় নির্ণয় করার প্রয়োজনীয়তা এখন এই নতুন সময়ের নতুন দাবিতে পরিণত হয়েছে।”
উদাহারণ টেনে জামিল আহমেদ বলেন, “গতকাল যেমন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সচিবদের বৈঠকেও সকল স্তরে সংস্কার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের তাগিদ লক্ষ্য করা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা এবং ছাত্র-নাগরিক সমাজের মধ্যে হাজির সেই তাগিদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নতুন রূপকল্প নির্ণয় করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।”
বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নে জামিল আহমেদ দৃঢ়ভাবে বলেন, “ইসলামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো বিরোধ নেই। সেই বিরোধিতার দর্শন ও বাস্তবতার জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরও সবল বেগে পরিচালিত হতে হবে।”
সংস্কার সেল গঠনের তাগিদ
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দৃষ্টান্ত অনুসরণে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংগঠক-সাংস্কৃতিক উদ্ভাবকদের ফেলো রূপে গণ্য করে চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে যথার্থ অর্থে 'একাডেমি' রূপে গড়ে তুলতে কাজ শুরু করারও তাগিদ দেন তিনি।
এজন্য প্রয়োজনে খণ্ডকালীন এক বা একাধিক পরামর্শক-উপদেশক-গবেষক নিয়োগ দিয়ে অতি দ্রুত একটি সংস্কার সেল গঠন করার কথাও বলেন তিনি।
জিডিপির কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দাবি
সংস্কৃতি খাতে জিডিপির কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে আর্থিকভাবে সক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রয়োজন স্বীকার করে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলেন জামিল আহমেদ।
“একাডেমির বাজেট বাড়িয়ে জেলা ইউনিটগুলোকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসিত এককে পরিণত করতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
“স্থানীয় বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলির প্রদর্শন, পুনঃসৃজন ও উদ্ভাবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। কারণ, লোকজ শিল্পী ও জনগণের পরিসর রূপে জেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলিকে গড়ে তুলবার আর কোনো বিকল্প নেই।”
মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় সকল প্রকার কট্টরপন্থী অসহিষ্ণু মতাদর্শিক ও ধর্মীয় বাধা এবং প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও মোকাবিলা করার কথাও বলেন তিনি।
শিল্পকলা যেন রাষ্ট্রের তল্পিবাহক না হয়
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারি যথেচ্ছাচারমূলক ইচ্ছা পূরণের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হবার দুষ্টচক্র থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে বের করে আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি উল্লেখ করে জামিল আহমেদ বলেন, “বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে গঠিত জনগণের সাংস্কৃতিক ইচ্ছাকে উপলব্ধি করে একাডেমিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজন সর্বাত্মক জরুরি তৎপরতা।
“বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে এই দেশের জনগণের বহুত্ববোধক সাংস্কৃতিক ইচ্ছার কাছে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান রূপে গণ্য করতে হবে এবং এর মহাপরিচালককে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হবে ও জবাবদিহিতা করতে হবে।”
স্বচ্ছ প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ
দায়িত্ব নেয়ার পর তিনটি বিষয়কে প্রথম ধাপে লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছেন বলে জানান মহাপরিচালক।
তিনি বলেছেন, “প্রশাসন ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব সব জেলায় শিল্পকলা একাডেমিকে দ্রুত চালু করাটাই এখন আমার প্রথম ধাপের লক্ষ্য।”
জামিল আহমেদ বলেন, দুর্নীতির অসৎ প্রক্রিয়া অনুসন্ধান, দুর্নীতির কারণ চিহ্নিতকরণ ও নিশ্চিহ্নকরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
একজন ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার স্বল্পকালীন সময়ে নিয়োজিত করে আর্থিক দুর্নীতির খাত ও কারণগুলো চিহ্নিত করা হবে বলেও জানান নতুন মহাপরিচালক।
জামিল আহমেদ বলেন, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই কেবল একাডেমির নতুন অভিযাত্রা সূচনা করা সম্ভব। শিল্পকলা একাডেমিকে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামুলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে ব্যয় বিভাজন ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে।”
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, রাজধানী কেন্দ্রিকতা শুধু নয়, জেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে সক্রিয় করে কার্যক্রম গতিশীল করার লক্ষ্যে অ্যাকাউন্ট অ্যাসিট্যান্টসহ বেশ কিছু পদ সৃষ্টি করা হবে।