“বাইরের মানুষ এটা সহজে নাও বুঝতে পারেন এবং দাবি তুলতেই পারেন, কিন্তু তাদের দাবিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে, যার দায় শিল্পকলার।”
Published : 04 Nov 2024, 08:22 PM
বন্ধ হওয়া 'নিত্যপুরাণ' নাটকের প্রদর্শনী সাত দিনের মধ্যে ফেরত দিতে শিল্পকলা একাডেমিকে সময় বেঁধে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীরা।
জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন খুলে দেওয়া, একাডেমির পরিষদে ‘আমলা নির্ভরতা’ কমানোর পাশাপাশি একাডেমি থেকে সাত দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার দাবিও তুলেছেন তারা।
সোমবার জাতীয় নাট্যশালার সামনে 'বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ' এর ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বটতলার নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা মোহাম্মদ আলী হায়দার।
গত শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় একদল মানুষের বিক্ষোভের পর 'নিত্যপুরাণ' নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধের ঘটনায় এই সমাবেশ আয়োজন করা হয়।
মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, “থিয়েটারের সংস্কৃতিতে নাটক বন্ধ হওয়া এবং করা উভয়েই অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হয়। বাইরের মানুষ এটা সহজে নাও বুঝতে পারেন এবং দাবি তুলতেই পারেন, কিন্তু তাদের দাবিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে, যার দায় শিল্পকলার।”
দেশ নাটক প্রযোজিত নিত্যপুরাণ নাটকের টিকেট বিক্রি শুরু হয় শনিবার বিকাল থেকে। এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে একদল লোক শিল্পকলার গেইটের সামনে দেশ নাটকের সদস্য এহসানুল আজিজ বাবুকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
পরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জামিল আহমেদ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করলে যথারীতি নাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা ফের সংগঠিত হয়ে নাট্যশালার গেইটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা গেইট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে মহাপরিচালক ‘দেশ নাটকের’ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেন।
পরদিন এক ব্রিফিংয়ে জামিল আহমেদ বলেন, দর্শকের ‘নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দেখে তার আশঙ্কা হয়েছিল, শিল্পকলা একাডেমিও ‘আক্রান্ত হতে পারে’।
এই ঘটনায় উদীচী, দেশ নাটক বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সেনা সদস্যদের সরিয়ে নেওয়ার দাবি
বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীদের সমাবেশে মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, “এহসানুল আজিজ বাবুর মত নাট্যাঙ্গনের বাইরে যার তেমন কোনো পরিচিতিই নাই, তাকে নিয়ে এতবড় মব সংগঠিত করা কেবল বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব না।”
সেনাবাহিনীর কারণে সাধারণ নাট্যকর্মীদের প্রবেশাধিকার শিল্পকলায় সীমিত হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে শিল্পকলা একাডেমির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে জাতীয় নাট্যশালার ৩টি মিলনায়তন, ৬টি মহড়া কক্ষ, সেমিনার কক্ষ, আর্কাইভ কক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদান করা সম্ভব হয়নি।
পরে গত ১১ অক্টোবর থেকে নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তন ও দুটি মহড়া কক্ষ নাটক মঞ্চায়নের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২ নভেম্বর ছিল ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার বিভিন্ন কক্ষে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরা অবস্থান করছেন।
নিত্যপুরাণ নাটকের নির্দেশক ও নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, “পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্ত হওয়া দরকার। দেশ নাটকের যে সদস্যের পোস্টকে ঘিরে এই ঘটনা ঘটেছে, তিনি খুব পরিচিত লোক নন। আন্দোলনের লোকজন তাকে চেনেনও না। তাহলে এর পেছনে কারা আছেন তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ যথেষ্ট আন্তরিক থেকে নাটকের প্রদর্শনী সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেছেন বলেও জানান মাসুম রেজা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাট্যকার সামিনা লুৎফা বলেন, “শিল্পকলাকে সকল দায়িত্ব নিয়ে 'নিত্যপুরাণ' নাটকের শো করতে দিতে হবে। তারা মিলনায়তন ভাড়া দিয়েছিলেন। তাদের নাটক করতে পারেননি।”
জনসাধারণের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সেনাবাহিনী থাকার কারণে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারছে না বলেও মনে করেন সামিনা লুৎফা।
অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক আজাদ আবুল কালাম বলেন, “শিল্পকলার দায়িত্বে এই নাট্যশালায় তিন দিনের একটি উৎসব করা উচিত এবং শিল্পকলাকে এর সকল ব্যয় বহন করতে হবে।”
বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি।
নাট্য গবেষক কামালউদ্দিন কবির, সাইদুর রহমান লিপনও সমাবেশে বক্তব্য দেন।
শিল্পকলার বিজ্ঞপ্তি
সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিল্পকলা একাডেমি বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সর্বাবস্থায় জনগণের, শিল্পচর্চার ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্বাস করে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করছে।
একাডেমির ভাষ্য, বাংলাদেশের হাজার বছরের নাটকের ইতিহাস আছে। নাটকের মাধ্যমেই সমাজের ত্রুটি বিচ্যুতি ও বিকল্প ধারণা তুলে ধরা সম্ভব। তাই যারা নাটক করতে চায় তাদের নাটক করতে দিতে হবে।
“নাটক দেখেই দর্শক বিবেচনা করবে তাদের নাটক তারা গ্রহণ করবে কি না। মতাদর্শ ও শিল্পকলার হাজার মালভূমির এই বাংলাদেশে সকল দলের নাটক করার বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সার্বিক সহযোগিতা রয়েছে।”
পূর্বের খবর
নাটক বন্ধ নিয়ে প্রেস সচিবের বক্তব্য 'ভুলভাবে উপস্থাপন': শিল্পকলা
মাঝপথে নাটক বন্ধ: মর্মাহত 'দেশ নাটক', উদীচী ও থিয়েটারকর্মীদের প্রতিবাদ
মাঝপথে নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ 'নিরাপত্তা' বিবেচনায়: জামিল আহমেদ