Published : 08 Mar 2025, 04:27 PM
স্বাস্থ্যকর খাবার চাইলে নিজে তৈরি করুন। তবে এটি সব সময় সত্য নাও হতে পারে।
রান্নার সময় উপকরণের গুণমান এবং মসলা নিয়ন্ত্রণ করার পরেও কিছু ভুল পুষ্টিকর খাবারকেও বিষাক্ত খাবারে পরিণত করতে পারে।
তাই রান্নার বিভিন্ন পর্যায়ে রাঁধুনিকে এসব সাধারণ ভুল চিহ্নিত করতে হবে।
সুপরিচিত পুষ্টিবিদ এবং রন্ধনশিল্পীরা ‘ইটদিস নটদ্যাট ডটকম’য়ে এমন কিছু রান্নার ভুল এড়ানোর কৌশল জানিয়েছেন।
নন-জিএমও খাবারকে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো মনে করা
‘জেনেটিকালি মডিফাইড ফুড (জিএমও)’ নিয়ে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। অনেকেই জিএমও ধরনের খাবার এড়িয়ে চলতে চান। মনে করা হয় যে নন-জিএমও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, কিন্তু এটা সবসময় সত্য নয়।
লস অ্যাঞ্জেলেস ভিত্তিক রন্ধনশিল্পী জুলিয়ান বুড্রোও বলেন, “নন-জিএমও খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
তিনি ব্যাখ্যা দেন, “নন-জিএমও মানে শুধু এটুকুই যে এতে কোনো জেনেটিকালি মডিফাইড উপাদান নেই। এর মানে এই নয় যে এটি স্বাস্থ্যকর।”
এক্ষেত্রে, অনেক সময় নন-জিএমও খাদ্য পেস্টিসাইড বা পোকা নিধনের ওষুধ, অ্যাডিটিভস এবং সংরক্ষক দিয়ে পরিপূর্ণ থাকে; যা খাবারের গুণগত মান কমাতে পারে।
তাই খাদ্য নির্বাচন করার সময় উপাদানের তালিকা এবং পুষ্টির তথ্য অবশ্যই পড়া উচিত। শুধুমাত্র নন-জিএমও লেখা দেখেই খাবারের স্বাস্থ্য গুণমান নির্ধারণ করা উচিত নয়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: পেস্টিসাইড এবং রাসায়নিক উপাদানগুলোর কারণে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: নন-জিএমও সিল দেওয়া খাবার নির্বাচন করার আগে, উপাদানগুলো সতর্কভাবে পর্যালোচনা করতে হবে এবং প্রাকৃতিক, খাদ্য বেছে নিতে হবে।
‘ফেইক মিট’ বা কৃত্রিম মাংসের বিকল্প ব্যবহার করা
আরেকটি ভুল হল, মাংসের বিকল্প হিসেবে ‘ফেইক মিট’ (মাংসের কৃত্রিম বিকল্প) ব্যবহার করা।,
উদ্ভিজ্জ খাদ্য তালিকায় মাংসের বিকল্পের দিকে ঝুঁকতে পারেন অনেকে, তবে মার্কিন শেফ জোসেফ ভ্যানওয়াগনারের মতে, “এই ধরনের বিকল্প অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। প্রক্রিয়াজাত মাংসের বিকল্পে অতিরিক্ত চর্বি, শর্করা এবং ফ্যাট থাকে, যা হজম ব্যবস্থাকে ব্যাহত করতে পারে, মেটাবলিজম ধীর করে দিতে পারে এবং ক্যালোরির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।”
অনেকেই মনে করেন যে এসব মাংসের বিকল্প স্বাস্থ্যকর। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের খাবার প্রাকৃতিক খাবারের চেয়ে অনেক বেশি ক্যালোরি এবং চর্বি বহন করে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অতিরিক্ত ফ্যাট এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম এবং বিপাক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: প্রাকৃতিক প্রোটিন যেমন- গাছ থেকে উৎপাদিত খাবার, শস্য, বাদাম ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে।
তেল বা মাখন অতিরিক্ত ব্যবহার করা
তেল এবং মাখন অতিরিক্ত ব্যবহার করাও একটি বড় ভুল। এগুলো খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত ব্যবহার করলে ক্যালোরি এবং চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পুষ্টিবিদ মিন্ডি রথ বলেন, “তেল বা মাখন ব্যবহারের পরিমাণ পরিমাপ করা উচিত।” তিনি আরও বলেন, “অভিন্ন বা অ্যাভাকাডো তেলের মতো স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করা ভালো।”
টরোন্ট ভিত্তিক পুষ্টিবিদ আনার আলিদিনা, তেল ব্যবহারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “এক টেবিল-চামচ তেলে প্রায় ১২০ ক্যালোরি এবং ১৪ গ্রাম চর্বি থাকে, যা খুব সহজে শরীরের জন্য অতিরিক্ত চর্বি গ্রহণের কারণ হতে পারে।”
তেল ব্যবহারের পরিমাণ কমানোর জন্য আলিদিনা কিছু পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, “রোস্টিং বা বেইকিংয়ের জন্য সিলিকন বেইকিং ম্যাট বা পার্চমেন্ট পেপার ব্যবহার করতে পারেন।”
এছাড়া, তেল ছাড়া স্যতে করার জন্য পানি বা স্যুপ ব্যবহার করাও একটি ভালো বিকল্প হতে পারে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অতিরিক্ত চর্বি গ্রহণ উচ্চ কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: পরিমাপ করে তেল এবং মাখন ব্যবহারে জোর দিতে হবে। বাজার করার সময়ে অলিভ অয়েল বা অ্যাভাকাডো অয়েলের মতো স্বাস্থ্যকর তেল কিনতে হবে। তেলের পরিমাণ কমানোর জন্য সিলিকন বেইকিং ম্যাট বা পার্চমেন্ট পেপার ব্যবহার করতে পারেন।
নন-স্টিক প্যান ব্যবহার করা
নন-স্টিক প্যান ব্যবহার করা অনেক সহজ। তবে এমন প্রলেপ দেওয়া পাত্র উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার করার ফলে রাসায়নিক উপাদান নিঃসৃত হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
এই রাসায়নিকগুলোকে ‘ফরেভার কেমিক্যালস’ বলা হয়। কারণ তারা সহজে ভেঙে যায় না। ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। যেমন- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, ক্যান্সার এবং হৃদরোগ।
যুক্তরাষ্ট্রের নিবন্ধিত পুষ্টিবিদ জেমি জনসন বলেন, “ননস্টিক প্যানগুলোতে ‘ট্যাফলন’য়ের প্রলেপ থাকে যা। এই ‘ফরেভার’ রাসায়নিক অতি তাপের কারণে খাবারে প্রবেশ করতে পারে যদি পাত্রে কোনো দাগ থাকে।
বিকল্প হিসেবে কাস্ট আয়রন, সিরামিক বা স্টেইনলেস স্টিলের প্যান ব্যবহার করা ভালো।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: রাসায়নিকের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের সমস্যা এবং অন্যান্য গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: কাস্ট আয়রন, সিরামিক কোটেড বা স্টেইনলেস স্টিলের প্যান ব্যবহার করতে হবে, যা নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত।
নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা
খাবার তৈরির সময় উপকরণের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নমানের তেল বা প্রক্রিয়াজাত উপকরণ ব্যবহার করা স্বাস্থ্যকর নয়।
শেফ জোসেফ ভ্যানওয়াগনার বলেন, “খারাপ মানের ফ্যাট বা চর্বি এবং অত্যাধিক প্রক্রিয়াজাত বীজের তেল ব্যবহার করা একটি সাধারণ রান্নার ভুল। নিম্নমানের তেল এবং প্রক্রিয়াজাত তেল খাবারে ব্যবহার করলে সেটি শুধুমাত্র অস্বাস্থ্যকর নয় বরং খাবারের স্বাদও নষ্ট করে।”
এই রন্ধনশিল্পী আরও যোগ করেন, “এগুলো থেকে ভালো স্বাদ এবং পুষ্টির কোনো উপকারিতাই পাওয়া যায় না।”
বরং তিনি উচ্চমানের উপকরণ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। যেমন- অলিভ অয়েল, অ্যাভাকাডো অয়েল এবং নারিকেল তেল।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: প্রক্রিয়াজাত তেল এবং নিম্নমানের উপকরণ পুষ্টির অভাব এবং খাবারের স্বাদ কমাতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: উচ্চমানের অলিভ অয়েল, অ্যাভাকাডো অয়েল, নারিকেল তেল অথবা ভালো মানের মাখন ব্যবহার করতে হবে। এই তেলগুলোতে ফ্যাটি এসিড এবং পুষ্টিগুণ থাকে।
কাস্ট আয়রন প্যানের সঠিক পরিচর্যা না করা
কাস্ট আয়রন প্যানের সঠিকভাবে পরিচর্যা না করলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই পাত্র রান্নার জন্য দুর্দান্ত হলেও পরিষ্কার এবং সিজনিং না করা হলে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
শেফ জুলিয়ান বলছেন, “কাস্ট আয়রন প্যান পরিষ্কার করার পর, হালকা তেলে সিজনিং করা উচিত, যাতে এটি দীর্ঘদিন ভালো থাকে।”
সঠিকভাবে সিজন না করলে এটি মরিচা ধরতে পারে, যা পরে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: ভুলভাবে পরিচর্যা করলে প্যানের মধ্যে ব্যাকটেরিয়া এবং ময়লা জমে যেতে পারে, যা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: কাস্ট আয়রন প্যান ব্যবহার করার পর সঠিকভাবে পরিষ্কার ও সিজনিং করতে হবে। এটি দীর্ঘস্থায়ী এবং স্বাস্থ্যকর প্যান হিসেবে কাজ করবে।
ভ্রান্ত ফুড লেবেলের প্রতি মনোযোগ দেওয়া
ফুড লেবেলগুলো অনেক সময় বিভ্রান্তিকর হতে পারে। অনেক খাদ্য লেবেলে ‘ভেগান’, ‘কিটো’, ‘জিএমও মুক্ত’ ইত্যাদি বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। তবে এগুলো সবসময় স্বাস্থ্যকর নয়।
শেফ জুলিয়ান বলেন, “এই লেবেলগুলো আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে। আর আমরা ভাবি যে এগুলো স্বাস্থ্যকর। তবে প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের খাবার প্রক্রিয়াজাত এবং এতে পুষ্টির অভাব হতে থাকতে পারে।”
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: এই ধরনের বিভ্রান্তিকর লেবেলগুলো স্বাস্থ্যকর খাদ্য সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে।
কীভাবে পরিহার করবেন: খাদ্যের উপাদান এবং পুষ্টির তথ্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে তাজা এবং অর্গানিক উপকরণ বেছে নেওয়াতে মনোযোগী হতে হবে।
সবজি অতিরিক্ত রান্না করা
সবজি শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে অতিরিক্ত রান্না করলে এর ভিটামিন এবং খনিজের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
পুষ্টিবিদ মিন্ডি রথ বলছেন, “যদি সবজি অতিরিক্ত রান্না হয়, এর রং গাঢ় হয়ে যায় এবং পুষ্টি কমে যায়।”
স্বাস্থ্য ঝুঁকি: অতিরিক্ত রান্না সবজির পুষ্টির মান কমিয়ে দেয় এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজের যোগান দেয় না।
কীভাবে পরিহার করবেন: সবজি কম রান্না করতে হবে। আর সবজির প্রাকৃতিক রং ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করা
অধিক তেল, মাখন বা লবণ ব্যবহার করা সাধারণ রান্নার ভুল। খাবারে অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার করলে শরীরের ওপর অত্যধিক চাপ পড়তে পারে।
লবণের অতিরিক্ত গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ এবং বৃক্কের সমস্যার কারণ হতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত সোডিয়ামের কারণে শরীরে পানি ধরে রাখা এবং পানিশূন্যতার মতো সমস্যাও তৈরি করে।
পুষ্টিবিদ আনার আলিদিনা বলেন, “খাবারে লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণ রান্না করার সময়ই এটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।”
লবণ কম ব্যবহার করার জন্য মসলা, ভিনেগার, লেবু, রসুন এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে রান্না করেই শুধুমাত্র সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা সম্ভব।
আরও পড়ুন
ননস্টিক পাত্র রান্নার জন্য কতটা নিরাপদ?
বেইকং সোডা দিয়ে যেসব জিনিস পরিষ্কার করা যাবে না
রান্নার পাত্র থেকে পোড়া দাগ ওঠানোর উপায়