হিন্দি সিনেমা দেখাতে হলে মানতে হবে শর্ত।
Published : 11 Apr 2023, 06:12 PM
কয়েক মাস ধরে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা শেষে একগুচ্ছ শর্ত বেঁধে দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র আমদানির অনুমতি দিল সরকার।
এর ফলে দেশের হলগুলোয় হিন্দি সিনেমা দেখাতে আর কোন বাধা থাকছে না।
তবে শর্ত হল, প্রথম বছরে দশটি উপমাহাদেশীয় সিনেমা দেশে আনতে হলে সমান সংখ্যক বাংলাদেশি সিনেমা রপ্তানি করতে হবে। হলে দেখানোর আগে বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পেতে হবে। এছাড়া আরও কিছু শর্ত রাখা হয়েছে সিনেমা আনার ক্ষেত্রে।
মঙ্গলবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুল ইসলামের স্বাক্ষরে এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি হয়েছে।
সেখানে বলা হয়, উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র আমদানি সংক্রান্ত সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়।
“বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামতের ভিত্তিতে বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪-এর ২৫ (৩৬) (গ) উপ-অনুচ্ছেদের শর্ত প্রতিপালন করে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র রপ্তানির বিপরীতে সাফটা ভুক্ত দেশ থেকে উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র আমদানি করার জন্য নিম্নোক্ত শর্ত সাপেক্ষে পরীক্ষামূলকভাবে নির্দেশক্রমে অনুমতি প্রদান করা হল।”
শর্ত
· বাংলাদেশের বৈধ চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশকগণ উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র আমদানি করার সুযোগ পাবেন।
· উপমহাদেশীয় ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র বাংলা সাবটাইটেলসহ পরীক্ষামূলকভাবে শুধু দুই বছরের জন্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করার সুযোগ থাকবে।
· প্রথম বছর ১০টি বাংলাদেশি চলচ্চিত্র রপ্তানির বিপরীতে সমান সংখ্যক চলচ্চিত্র আমদানি করতে পারবে।
· আমদানিকৃত উপমহাদেশীয় ভাষার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের আগে অবশ্যই বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সনদ গ্রহণ করতে হবে।
· এই আদেশ বলে আমদানি করা চলচ্চিত্র বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল আযহা ও দূর্গা পুজার সপ্তাহে প্রদর্শন করা যাবে না।
ভাষার মাসে হিন্দি সিনেমা: নিছকই ব্যবসা?
‘ফেব্রুয়ারির শুরুতেই’ বাংলাদেশকে পাঠান দেখাতে চান হল মালিকরা
দেশে পাঠান মুক্তি: ‘বাংলা সিনেমার ভালো’ দেখছে জাজ মাল্টিমিডিয়া
হিন্দি সিনেমা মুক্তির অনুমতি দেওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সিনেমা হল মালিক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত। অনেক দিনের চেষ্টার পর এটি সম্ভব হয়েছে।”
তবে চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম মনে করছেন, ভারতীয় সিনেমা আমদানির অনুমতির মধ্য দিয়ে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সংকটের সমাধান হবে না।
দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে সুরক্ষা দিতে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতীয় সিনেমা আমদানি নিষিদ্ধ। দশককাল আগে একবার সরকার অনুমতি দিলেও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের বিরোধিতার মুখে পিছু হটে।
এবারে হিন্দি সিনেমা হলে দেখানোর দাবি ওঠে গত ২৫ জানুয়ারিতে বলিউডের তারকা শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ সিনেমা মুক্তির পর।
সে সময় হল মালিকরা চাইছিলেন ফেব্রুয়ারির শুরুতেই দর্শকদের পাঠান দেখাতে।
চলচ্চিত্র শিল্পের দুর্দিনে এরপর প্রদর্শক সমিতি প্রেক্ষাগৃহগুলোতে আবার ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখানোর দেন-দরবার শুরু হয়। তাতে অন্য কয়েকটি সংগঠনও সমর্থন জানায়। একাত্মতা জানায় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের মোর্চা সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদ। তাদের কথা ছির শর্তসাপেক্ষে হিন্দি সিনেমা আমদানির করা যেতে পারে।
দেশে উপমহাদেশীয় ভাষার সিনেমা আমদানির পক্ষে মত দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও।
তিনি বলেছিলেন, “আমিও নির্দিষ্ট পরিমাণ আমদানির পক্ষে, অবাধ আমদানিতে আমাদের শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতীতেও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমার কাছে ভারতীয় হিন্দি ছবি আমদানির দাবি উপস্থাপন করা হয়েছিল, পরে শিল্পী সমিতি আপত্তি জানিয়েছিল।”
তথ্যমন্ত্রী এও জানিয়েছিলেন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব সংগঠন সম্মত হলে বছরে ১০টি হিন্দি সিনেমা আমদানির অনুমতি সরকার দেবে।
ভারতীয় সিনেমা আমদানি বিতর্ক
তিনটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র আমদানি করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয় ২০১০ সালে। ২০১০ সালে ‘ইনউইন এন্টারপ্রাইজ’ বাংলাদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করলে তার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠন একাট্টা হয়।
এরপর এক যুগ ধরে নানা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এর এক পক্ষ মনে করেন ভারতীয় সিনেমা দেশের চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করে দেবে।
আবার হল মালিকেরা মনে করেন, বলিউড সিনেমা মুক্তির মধ্য দিয়েই দর্শক ফিরবে প্রেক্ষাগৃহে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াবে। সেই বিতর্কের মধ্য দিয়েই এবার সরকার ভারতীয় সিনেমা আমদানির অনুমতি দিয়েছে।
হিন্দি সিনেমা আনলে অবস্থা হবে নেপালের মতো: জায়েদ খান
বাংলাদেশে কেবল দুটি দেশের চলচ্চিত্র আমদানি নিষিদ্ধ– ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর পাকিস্তান সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করে। এরপরে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম উর্দু সিনেমা তৈরি ও আমদানি বন্ধ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কেবল ভারতীয় বাংলাভাষার ছবি আমদানি করতে চেয়েছিলেন।
তবে বাংলাদেশে আমেরিকার ইংরেজি চলচ্চিত্র নিয়মিতই আসছে, তবে তার প্রদর্শনী সিনেপ্লেক্সের মধ্যে সীমিত থাকে। ফলে দেশের প্রেক্ষাগৃহে বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিরুদ্ধে আন্দোলনটিও মূলত বলিউড সিনেমা বা হিন্দি সিনেমাকে ঘিরে আবর্তিত।
এবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ফলে ভারতীয় সিনেমা তথা বলিউড সিনেমা দেশে মুক্তির পথ তৈরি হলো।
প্রতিক্রিয়া
‘যেনতেন’ সিনেমা আমদানি করে যেন সিনেমার বাজার নষ্ট না করা হয় তার ব্যাপারে তৎপর থাকার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন সিনেমা হল মালিক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস।
তিনি বলেন, “এর আগেও আমরা দেখেছি সাফটা চুক্তির আওতায় কলকাতার এমন কিছু সিনেমা আনা হয়েছে, যেগুলো এখানকার প্রেক্ষাগৃহে চলেনি। আমরা চেষ্টা করব হিন্দি ভালো সিনেমা এনে দেশের দর্শকদের দেখাতে। এতে সিনেমা হল আবার প্রাণ ফিরে পাবে বলে আশা করি।”
চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম গ্লিটজকে বলেন, “এই বিষয়টি নিয়ে তো অনেক বলেছি। বলে তো লাভ হয়নি। এখন দেখা যাক, ভারতীয় সিনেমা আমদানির ফলে কী লাভ হয়?
“তবে আমি এখনো মনে করি, নিজেদের ভালো সিনেমা বানাতে হবে এবং নিজেদের ভালো সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা জটিলতা মুক্ত করতে হবে।“
দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দেশের সিনেমা দিয়েই দাঁড়াতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই নির্মাতা।