‘একদিন হুট করে শুনবেন মধুমিতা বন্ধ হয়ে গেছে’

দর্শক খরায় তালা ঝুলেছে মধুমিতা সিনেমা হলে, সেই তালা কি আর খুলবে?

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2022, 04:57 AM
Updated : 26 Nov 2022, 04:57 AM

ঢাকায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মধুমিতা সিনেমা হলে এখন ঝুলছে তালা, সেই তালা আবার খুলবে কি না, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

“কবে যেন হলটাই বন্ধ করে দিতে হয়। একদিন হুট করে শুনবেন মধুমিতা বন্ধ হয়ে গেছে,” বলছিলেন প্রেক্ষাগৃহটির মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ।

তার ভাষ্যে, ভালো সিনেমা নেই বলে দর্শক নেই, ফলে হল চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে।

গত ১৮ নভেম্বর থেকেই মধুমিতা সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ; এখন সিনেমার বদলে ফুটবল বিশ্বকাপের শেষের দিককার খেলাগুলো দেখানোর ইচ্ছা নওশাদের। তিনি জানিয়েছেন, খেলা দেখানোর অনুমতির জন্য টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালের ১ ডিসেম্বর ‘মধুমিতা’র যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঢাকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিলে প্রায় তিন বিঘার উপরে নিজস্ব ভবনে গড়ে ওঠা এই হলটি পুরোপুরি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ১ হাজার ২২১ জন দর্শক একসঙ্গে বসে ছবি দেখতে পারেন এখানে।

আধুনিক বলে একসময়ে জনপ্রিয় এই প্রেক্ষাগৃহটি ৫৫ বছরে পা রাখবে আগামী ১ ডিসেম্বরে। তার ক’দিন আগেই প্রেক্ষাগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে নওশাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “এই হলটা নিয়ে কত স্মৃতি আমাদের!”

তাহলে একেবারে বন্ধ হওয়ার শঙ্কা কেন? যেখানে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ দেশি সিনেমার জোয়ার তুলেছে।

ইফতেখার বললেন, “পাঁচ-সাত বছর ধরে খরা চলছে। ’পরাণ’, ‘দিন: দ্য ডে’ এবং ‘হাওয়া’ আসাতে লোকজন কিছুটা আসা শুরু করেছিল। ‘পরাণ’ আর ‘হাওয়া’ চার সপ্তাহ করে চলছে। ‘দিন: দ্য ডে’ চলেছে দুই সপ্তাহ। আর আবার ‘পরাণ’ চালিয়েছি।

“এরপরের ছবিগুলো বিলো স্ট্যান্ডার্ড। এগুলো চালানো শেষ। ভালো ছবি নেই। দর্শক হলে আসছে না। বিদ্যুৎ বিলই উঠছে না। বাধ্য হয়ে ছবি চালানো বন্ধ।”

Also Read: সিনেমা হল: ছিল ১২৩৫টি, ২ যুগ পেরিয়ে কমে এখন ১২০টি

করোনাভাইরাস মহামারী পেরিয়ে কর্মচারী সংকট ও ছাঁটাইয়ের পথেও হাঁটতে হয়েছে এই হল মালিককে।

ইফতেখার বলেন, “মাসে আমাদের তিন-চার লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। কর্মচারীর বেতন দিতে হয়। বেতন না পেয়ে অনেক কর্মচারী চলে গেছে। আমরাও কিছু কমিয়েছি। আগে যেখানে ১০ জন কর্মচারী কাজ করত, এখন সেটা চার-পাঁচজন দিয়ে করাতে হচ্ছে।”

তার মতো অনেক হল মালিকই কর্মচারী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান ইফতেখার।

এর মধ্যে বেশ কিছু সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তাতেও কি দর্শক খরা কাটেনি- প্রশ্নে তিনি বলেন, “এগুলো সব নিরীক্ষাধর্মী সিনেমা। সাধারণ দর্শক দেখে না। সিনেপ্লেক্সগুলো সকালে চালায়। দর্শক বাড়লে এরপর বিকালে শো দেয়।

“সিনেপ্লেক্স চালাতে পারে। তাদের চার-পাঁচশ সিট। আমাদের ১১-১২শ সিট। যদি দর্শক না আসে, আমরা কি করে এসব ছবি চালাই?”

হলের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “অনেকে বলে হলের পরিবেশ নেই। ভালো ছবি না আসলে পরিবেশ ভালো হবে কী করে?”

‘ভালো’ সিনেমা ছাড়া দিন বদলাবে না বলেই মনে করেন ইফতেখার।

তিনি বলেন, “এক সময় কিন্তু এইসব পরিবেশেই দর্শক উপচে পড়েছে। কারণ তখন ভালো সিনেমা ছিল। ভালো আর্টিস্ট ছিল। জসিম ভিলেন থেকে হিরো হয়েছেন। তার ছবি দেখতে দুই গুণ, তিন গুণ টাকা দিয়ে ব্ল্যাকে টিকেট কেটেছে দর্শক। জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, ফারুক, রাজ্জাক, আলমগীররা ছিলেন। আরও কত বড় বড় আর্টিস্ট ছিল।”

ঢাকাই সিনেমার নায়ক শাকিব খানেরও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়েও হতাশা ঝরে এই চলচ্চিত্র প্রদর্শকের কথায়।

“এখন কয়টা আর্টিস্ট আছে? বাপ্পি আর সিয়াম ছাড়া কে আছে? শাকিব খান অনেক বছর সিনেমাকে টেনে নিয়ে গেছে। এখন সিনেমা করেই না। সে একের পর এক কন্ট্রোভার্সির জন্ম দিচ্ছে।”

অনেকে বলে হলের পরিবেশ নেই। ভালো ছবি না আসলে পরিবেশ ভালো হবে কী করে?
ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ

নওশাদের কথা হলো নতুন শিল্পীরা পরিশ্রম করে উঠে আসলেই সিনেমার গতি ফেরা সম্ভব।

তার ভাষ্য, “নিশো-মেহজাবীন টিভিতে একটা জায়গা করে নিছে। তারা ফিল্মে আসতেছে না। ফিল্মে তাদের মতো ভালো কিছু লোক দরকার। নতুন নতুন শিল্পীদের উঠে আসতে হবে। তাদের পরিশ্রম করতে হবে। জায়গা করে নিতে হবে। তবেই না সিনেমার একটা গতি হবে।”

‘ভালো গল্প’ নিয়েও কাজ করতে হবে বলে জানান মধুমিতা হল মালিক।

“গল্প ভালো হলে শিল্পীও বিষয় না। পরাণ, হাওয়াতে শিল্পী বলতে যাদের বুঝি তেমন কেউ ছিল না। তারপরও মানুষ দেখেছে। নির্মাণ আর গল্পের কারণে। আমাদের কনটেন্টের বড় অভাব।”

কলকাতার সিনেমা পেলে হল ‘বাঁচতো’ মন্তব্য করে ইফতেখার বলেন, “একটা সময় বাইরের ছবি আসত। উত্তম-সুচিত্রার ছবি আসত। আমাদের কলকাতার ছবিও চালাতে দেয় না। কলকাতার ছবি চালাতে দিলেও বেঁচে যেতাম।

“সবগুলো টেলিভিশনে বাইরের সিনেমা চালাচ্ছে। বাড়িতে বসে টিভিতে বিদেশি ছবি দেখছে। মোবাইলে দেখছে। আমাদের হলে বসে দেখলে অসুবিধা কী?”

সিনেমা হলের দুর্দশায় পড়া নিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ আক্তার বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছেন। এটা হল মালিকরা নিচ্ছিল না। এখন নেওয়া শুরু করেছে। অনেকগুলো সিনেপ্লেক্স হবে।

“আমার মনে হচ্ছে সিনেমার উন্নয়নে কাজ শুরু হয়েছে। সিনেমার যে দুর্দিন ছিল, সে অবস্থা থেকে তুলতে একটু সংগ্রাম করতে হবে, একটু সময় লাগবে।”

ঋণের ব্যবস্থা হলেও নতুন বিনিয়োগ করা নিয়ে শঙ্কা কথা বলেন ইফতেখার।

“তারপরও আমরা সাউন্ড সিস্টেম আপগ্রেড করেছি। ৭.১ ডলবি সাউন্ড সিস্টেম সেট করেছি। ভালো সিনেমা হলে, দর্শক আসলে পরিবেশ আরও ভালো করতে পারতাম।”

“ভালো ছবি না হলে আমার ইনকাম কোথা থেকে আসবে, আমি ইনভেস্ট কোথা থেকে করব?” প্রশ্ন করেন তিনি।

ইফতেখার বলেন, “এর আগে সংস্কৃতিমন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘বছরে আপনাদের ১০-১২টা করে ছবি দিব।’ ১৮ সংগঠনের নেতারাও বিষয়টা মেনে নিয়েছিলেন। বছরে ১০-১২টা সিনেমা আসলেই কিন্তু হলগুলো বেঁচে যায়।”

দেশের নতুন করে নির্মিত সিনেপ্লেক্সের সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলেন, “সিনেপ্লেক্স আসছে ১৭ বছর। মধুমিতার বয়স ৫৫ বছর। এত বছর সিনেপ্লেক্স ছিল না। সিনেমায় যে অবদান সিঙ্গেল স্ক্রিনেরই।”