সিনেমা হল: ছিল ১২৩৫টি, ২ যুগ পেরিয়ে কমে এখন ১২০টি

আশির দশকে দর্শকদের চাপে রাত ১২টার পরও শো চালাতে হয়েছিল পুরান ঢাকার মানসী সিনেমা হলে। দর্শকরা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় ধুঁকতে থাকা মানসীর আলো নিভে গেছে চিরতরে।

সাইমুম সাদ গ্লিটজ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Dec 2021, 06:52 PM
Updated : 9 Dec 2021, 06:52 PM

১৯৩৬ সালে পুরান ঢাকার বংশালে প্রতিষ্ঠিত প্রেক্ষাগৃহটি ৮০ বছরের পথচলায় ইতি টানে ২০১৯ সালে; সাইনবোর্ড পাল্টে মানসী কমপ্লেক্স নামে এখন বিপণী বিতান হয়েছে।

সিনেমা হল না থাকলেও সেই রাস্তাটি এখনও মানসীর নামের পরিচিত সবার কাছে।

শুধু মানসী নয়; শাবিস্তান, সিনেমা প্যালেস (রূপমহল), লায়ন, মুন, মল্লিকা, গুলিস্তান, রাজমনির মতো সিনেমা হল বিলুপ্ত হলেও সেই নামগুলো এখনও রয়ে গেছে।

‌প্রেক্ষাগৃহ মা‌লিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চল‌চ্চিত্র প্রদর্শক স‌মি‌তি জানিয়েছে, ১৯৯৮ সালে ১২ শ’ ৩৫‌টির মতো সিনেমা হল ছিল দেশে। দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ১২০টিতে নেমেছে। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে এখন চালু আছে ৬০টির মতো হল।

সম্প্রতি মানসীর সামনে গিয়ে দেখা গেল, এক সময়ের ৭৫৫ আসনের সিনেমা হলটির দ্বিতল ভবনে নানা ধরনের ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশের ৪০টির মতো দোকান চালু রয়েছে।

দ্বিতীয় তলায় গিয়ে পাওয়া গেল মার্কেটের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলমকে; ৬৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি মানসী সিনেমা হলেরও ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বাবা সোলাইমানও মানসী সিনেমা হলে কাজ করেছেন।

চাঁদপুর জন্ম নেওয়া খোরশেদ বাবার পথ ধরে মানসী সিনেমা হলে বুকিং প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬৮ সালে; হল বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ‍ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলেন।

খোরশেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সিনেমা হল রমরমা ছিল। মহিলা-পুরুষ গ্রুপ বাইন্ধা আইত। পরিবারে পরিবারে কম্পিটিশিন চলতে, কে কোন সপ্তাহে সিনেমা দেখাবে। খুব দ্রুত টিকেট শেষ হয়ে যেত। পরের শোতে আসতে হত। বাধ্য হয়ে রাত ১২টার পরও শো চালাতে হত।”

নানা কর পরিশোধ করেও তখন প্রেক্ষাগৃহ মালিকের হাতে টাকা থাকত বলেন জানান তিনি।

কাদের সিনেমার দর্শক বেশি ছিল-এ প্রশ্নের জবাবে খোরশেদ বলেন, “শাবানা, ববিতা, বুলবুলদের সিনেমা বেশি চলত। শাবানার ‘তুফান’ টানা এক বছর চলেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই মোটামুটি জমজমাট ছিল হলটি। বেশিরভাগ শো হাউসফুল থাকত।”

মানসী কমপ্লেক্সের সামনে কথা হল সাইফুল ইসলাম নামে পুরান ঢাকার এক  বাসিন্দার সঙ্গে, যিনি বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমাটি মানসী হলে ১৪ বার দেখেছেন।

তিনি বলেন, “মানসী হলে ছবি দেখার জন্য আমাদের লম্বা লাইন দিয়ে টিকেট কাটতে হত। অনেক সময় দ্বিগুণ দামে ব্ল্যাকে টিকেট কাটতাম আমরা। মানুষ তো এখন আর সিনেমা দেখে না। ছবিও হয় না তেমন।”

সেই সময়ে মানসীতে ১০-১২ জনের একটি দল ব্ল্যাকে বা কালোবাজারে টিকেট বিক্রি করতেন; দেড় টাকায় টিকেট কিনে তিন টাকায় বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ওই সময় কালোবাজারে টিকেট বিক্রি সিনেমা হলগুলোর সামনে স্বাভাবিক দৃশ্যই ছিল।

সেই দলের একজন মনু মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, টিকিট বিক্রি করে প্রতিদিন ২০০ টাকা রোজগার করতেন তিনি।

মনু মিয়া, যিনি এক সময় মানসী সিনেমা হলের সামনে টিকেট বিক্রি করতেন।

নব্বইয়ের দশকের পর দর্শক কমতে থাকায় সেই পেশা ছেড়ে সবজি বিক্রি করা শুরু করেন তিনি। এখনও সবজি বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছেন ৫৫ বছর বয়সী মনু।

পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে টিকিট ‘ব্ল্যাক’ করতেন-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, পুলিশের বিষয়টি তাদের ‘সর্দার’ দেখতেন। তাদের কাজ ছিল শুধু টিকেট বিক্রি করে সর্দারকে টাকা দেওয়া। সেখান থেকে অর্থ পেতেন তিনি।

মনু মিয়া বললেন, “দর্শকের তখন চাহিদা খুব বেশি ছিল। দর্শক ঝাঁপাইয়া পড়ছিল। জোয়ান বয়সে ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করা শুরু করেছিলাম। সেই টাকায় সংসার চালাতাম। কিন্তু পরে সিনেমার অবস্থা খারাপ হওয়ায় আর কুলাতে পারিনি। এখন তো মানুষ আর সিনেমা দেখে না।”

মানসী সিনেমা হলের দর্শক সংখ্যা কমতে কমতে কতটা কমেছিল, তার একটা ধারণা দিলেন ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম।

তিনি বললেন, “আমি একদিন ডিসিতে একটা টিকিট বিক্রি করেছি, শোভনে পাঁচটা। ডিসির লোকটা নিচে নেমে এসে আমাকে বলল, ‘দাদা আমার একলা একলা ভয় করে। নিচে (নিচতলার শোভন) বসে সিনেমাটা দেখি’।”

“বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ও স্টাফদের বেতনও পরিশোধ করা যাচ্ছিল না হলের টাকায়। উল্টা মালিকের নিজের পয়সা দিয়ে চালাতে হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে দোকান করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে যাতে কিছু পয়সা উপার্জন করা যায়,” বলেন খোরশেদ।

একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হলেও ঢাকার বলাকা, মধুমিতা, আজাদ, চিত্রামহলসহ আটটির মতো সিনেমা হল এখনও টিকে আছে।

চিত্রামহল সিনেমা হল এখনও টিকে আছে।

কেন পর্দা নামছে হলের?

প্রদর্শক স‌মি‌তির উপ‌দেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বি‌ডি‌নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘অশ্লীল’ সিনেমার প্রকোপে হল থে‌কে দর্শক‌দের মুখ ফি‌রি‌য়ে নেওয়া, ভা‌লো সি‌নেমা নির্মাণ না হওয়া, সিনেমার পাই‌রে‌সির কার‌ণে ব্যবসায় মন্দার কার‌ণে ‌একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়েছে।

চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ঢুকে যাওয়ায় এই শতকের শূন্য দশকের শেষভাগে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শক হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন; তার বিপরীতে ‘কাটপিস’-এর জন্য আরেকটা শ্রেণির দর্শক হলে আসতে থাকে।  

সিনেমায় অশ্লীলতা ও পাইরেসি রোধে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। সেই টাস্কফোর্সের অভিযানে অশ্লীল সিনেমা বন্ধ হলেও ‘সুস্থ ধারার’ দর্শকদের আর ফেরানো হয়নি বলে মনে করেন প্রযোজক সমিতির নেতা খোরশেদ আলম খসরু।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখন এক শ্রেণির দর্শক ‘কাটপিস’ দেখার জন্য বড় একটা দর্শক হয়ে গিয়েছিল। কাকরাইল, এফডিসিতে অভিযান করে বন্ধ করা হয়েছিল। ওই টাইপের ছবি আর হয়নি। এখন ভালো ছবি হচ্ছে।

“তবে ওই কাটপিসের দর্শকরা হলে গিয়ে আর কাটপিস পায় না। ফলে তারা আর হলে যায় না। আর সুস্থধারার দর্শকরা, ওদেরও কিন্তু আর ফেরাতে পারিনি। তারা মনে করে, এখনও অশ্লীতা আছে। ফলে একটা বড় ধরনের শূন্যতা হয়ে গেল।”

কালোবাজারে টিকেট বিক্রেতা মনু মিয়াও মনে করছেন, অশ্লীলতার কারণে অনেক দর্শক পরিবার নিয়ে এখন আর হলে যায় না।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “আগে আমার মা-বোনরে নিয়া হলে সিনেমা দেখছি, এখন পরিবার নিয়ে আর দেখি না। যুগ খারাপ হয়ে গেছে গা। ছবিতে যেসব সিনসিনারি করে মায়ালোক দেইখা লজ্জা পায়। আগে তো আমি মা-বোনরে নিয়ে ফ্রি মাইন্ডে বইয়া ছবি দেখছি। ছবি দেইখা মায়েও হাসে, আমিও হাসি। এখন ছবি দেইখা ঘিন্না করে। যে অবস্থা দেখি ছবির!”

খসরু জানান, দর্শকরা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকায় প্রযোজক-পরিচালকরাও সিনেমা নির্মাণ কমিয়ে দিল। আগে বছরে যেখানে ১২০টির বেশি সিনেমা নির্মাণ হতো এখন সেখানে ৩০টির মতো সিনেমাও নির্মাণ হয় না।

সিনেমা হল বন্ধ হয়ে এখন হয়েছে মুন কমপ্লেক্স। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

‘এখন মোবাইলে সিনেমা দেখে’

দর্শকদের হল বিমুখতার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা প্রযুক্তির অগ্রগতিকেও তুলে আনছেন। বিশেষ করে ভিসিআর, কেবল টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপে বিনামূল্যে সিনেমা দেখার দ্বার খুলে যাওয়ায় দর্শকরা এখন আর অর্থ খরচ করে সিনেমা হলে যেতে চান না বলে মনে করছেন মানসীর ব্যবস্থাপক খোরশেদ।

তিনি বলেন, “সিনেমা হল প্রথম ধাক্কা খাইল ক্যাসেটে ছবি দেখার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর। এক একটা প্রযুক্তি আসছে একেক ধাপে চলে গেছে। মানুষ এখন মোবাইলে ছবি দেখে, পয়সা লাগে না। ফলে আর হলে আসে না।”

পুরান ঢাকার মুন সিনেমা হল ভেঙে গড়ে উঠা বহুতল ভবনের নিরাপত্তাকর্মী নুরু হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন, তিনি মুন সিনেমা হলে শৈশব থেকেই সিনেমা দেখেছেন। “শঙ্খনীল কারাগার, শান্ত কেন মাস্তান, বেদের মেয়ে জোসনা দেখেছি মুনে। মান্না, ডিপজলের সিনেমা বেশি দেখতাম। পরে হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর হলে যাওয়া হয়নি। বাসায় সিনেমা দেখি।”

কীভাবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখন মোবাইলের মেমোরি কার্ডে ছবি তুলে রাতে বাসায় গিয়ে দেখি।”

মনু মিয়ারও অভিযোগ মোবাইল ফোন নিয়ে। তিনি বলেন, “মোবাইলে ছবি হয়ে গেছ, যুগও বদলাইয়ে গেছে। পয়সা ছাড়া মোবাইলে মানুষ ছবি দেখে, পয়সা খরচ করে মানুষ হলে কেন ছবি দেখব?

“সিনেমা হল ধরা খাইছে যখন ডিশ বাইর হইয়া গেছে গা, মোবাইলে ছবি বাইর হইছে গা। ছবি যখন মোবাইলে অ্যাভেইলেবল হয়ে গেল গা তখন থেকে আমি ব্ল্যাকে টিকেট বন্ধ করে দিছি।”

বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ওটিটি প্লাটফর্মেরও জনপ্রিয়তা বেড়েছে কয়েক বেড়েছে। আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স, জি-ফাইভ, হইচইয়ের মতো ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতে পছন্দের কনটেন্ট খুঁজে নিচ্ছেন দর্শকরা।

মিরপুরে সনি সিনেমা হলের জায়গায় হয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্স।

সিনেপ্লেক্সে কারা সিনেমা দেখছেন?

একের পর এক সিনেমা হল যখন বন্ধ হচ্ছে তার বিপরীতে স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার সিনেমাস ও মধুবন সিনেপ্লেক্সের মতো সিনেপ্লেক্স চালু হয়েছে বাংলাদেশে।

তবে সিনেপ্লেক্স দেশের সাধারণ দর্শকদের জন্য উপযোগী নয় বলে মনে করেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। এটাকে ‘এলিটদের’ বিনোদনের মাধ্যম বলছেন কেউ কেউ। কারণ হিসেবে সিনেপ্লেক্সের টিকিটের দামের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যয়ের অসঙ্গতির কথা তুলে আনছেন তারা।

প্রযোজক নেতা খসরু বলেন, “সিনেপ্লেক্স কখনোই গণমানুষের হল না। আমাদের বিনোদনের যারা দর্শক, এরা সিনেপ্লেক্সে যাবে না।

“যে লোকটা রিকশা চালায়, শ্রমিক-দিনমজুর, তাদের আয়ত্তের বাইরে এই সিনেপ্লেক্স। সিনেমা হল লাগবে; তারাই কিন্তু সিনেমার স্টেক হোল্ডার। অনেকের বাড়িতে টিভি নাই। বিশ টাকা দিয়ে সিনেমা হলে ছবি দেখবে। আমরা যতই আধুনিক করি, গণমানুষের জন্য হল দরকার।”

লায়ন টাওয়ারে আগে ছিল সিনেমা হল। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

উত্তরণ কীভাবে?

হল মালিকরা বলছেন, ভালো সিনেমা নির্মাণ হলে হয়তো আগামীতে দর্শকরা হলে ফিরতে পারেন। কিন্তু দর্শক না থাকায় বড় আয়োজনের সিনেমা নির্মাণের ঝুঁকিও নিচ্ছেন না প্রযোজকরা।

দুইয়ের ঘোরাটোপে আটকে থাকা চলচ্চিত্রাঙ্গনে আশার আলো নিয়ে এসেছে সিনেমা হলের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল।

স্বল্প সুদে সিনেমা হল মালিকরা ঋণ নিয়ে বন্ধ থাকা হলগুলো খুললে ও হলের পরিবেশ উন্নত করলে দর্শক ফেরার আশায় আছেন হল মালিকরা। ইতোমধ্যে সেই তহবিলের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।

অন্যদিকে, ভালো সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারের অনুদান দেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এলেও পেশাদার প্রযোজক ও পরিচালককে অনুদান দেওয়ার অনুরোধ করছেন খসরু।