একান্ত ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে আমদানিকৃত উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রগুলোকে বাধ্যতামূলক বাংলাভাষায় ডাব করতে হবে।
Published : 23 Feb 2023, 11:23 PM
ভারত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দি উল্লেখিত না থাকলেও, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ৩৪৪ এর ২(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে হিন্দির ব্যবহারকে কেন্দ্রসরকারি পর্যায়ে “ক্রমবর্ধমান” রাখবার নির্দেশনা আছে। বৃহৎ এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানান প্রক্রিয়াতেই হিন্দি ভাষার ব্যবহার ক্রমবর্ধমান রাখবার প্রয়াস চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং সফট পাওয়ারের ক্ষেত্রে হিন্দির ব্যবহার ও সেই ব্যবহারে বলিউডের অবদান সর্বজনবিদিত। মাসদুয়েক আগে, ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ‘India’s Soft Power and Cultural Diplomacy: Prospects and Limitations” শিরোনামে[i]। এই বৈঠকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বিষয়ক সংস্থা Indian Council for Cultural Relations (ICCR)-এর বরাদ্দ দ্বিগুণ করা এবং এই সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্টকরণসহ আরও বেশকিছু পদক্ষেপ নেবার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায়, এই চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই ICCR এর প্রধান ড. বিনয় সহস্রবুদ্ধে ‘Hindi in the world: In the era of cultural-flattening, India must strengthen its linguistic traditions’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন[ii]। প্রবন্ধে ড. বুদ্ধে খুব সুনির্দিষ্টভাবে হিন্দি ভাষাকে বহির্বিশ্বের সাথে ভারতের সংযোগ/বিনিময় ভাষা হিসেবে উন্নীত করার ব্যাপারে তিনি তার মতামত ও স্বদিচ্ছার ব্যাপারে আলাপ করেন।
ঠিক এমনই একটি সময়ে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোকে হঠাৎ দেখা গেল হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি বিষয়ক খবর নিয়ে জেরবার হয়ে উঠতে। বাংলাদেশের একাধিক প্রধান গণমাধ্যম বিভ্রান্তিকর, অর্ধসত্য ও প্রায়শই মিথ্যা শিরোনাম করে এই প্রক্রিয়াতে জোর অবদান রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অসংখ্য গুজব ডালপালা মেলেছে হিন্দির আমদানি নিয়ে। চলচ্চিত্র বিষয়ক ১৯টি সমিতির নেতাগণ ‘প্রেক্ষাগৃহ বাঁচাবার’ সুমহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, তথ্যমন্ত্রণালয় বরাবর অনাপত্তিপত্র দিয়েছেন হিন্দি আনতে। বিদ্যমান আইনি জটিলতা, বাধ্যবাধকতা, ঐতিহাসিক পরম্পরা বা সম্ভাব্য রাজনৈতিক জটিলতার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো সচেতনতা প্রদর্শন না করে তথ্যমন্ত্রীও অদ্ভুত সব মন্তব্য করছেন। একটি সর্বব্যাপী ও চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে। শহীদ দিবসের প্রাক্কালে তৈরি হওয়া, এই অদ্ভুত অরাজক পরিস্থিতিটির আইনি ও তথ্যবিত্তিক বিশ্লেষণ তাই একান্ত প্রয়োজন। সেই চেষ্টাই প্রথমে করছি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন কী বলে?
বিদ্যমান আইনি বিধিগুলোকে বুঝতে হলে এই বিধানগুলো আজকের চেহারায় আসার ইতিহাসটা জানা জরুরি। বাংলাদেশের সিনেমা হলে হিন্দি-উর্দু সিনেমা ঢোকাবার প্রচেষ্টা নতুন নয়। এটার প্রথম চেষ্টা শুরু হয় বাংলাদেশের জন্মের পরপরই। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম উর্দু সিনেমা তৈরি ও আমদানি বন্ধ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কেবল ভারতীয় বাংলাভাষার ছবি আমদানি করতে চেয়েছিলেন। প্রবাদপ্রতিম পরিচালক আমজাদ হোসেনের ভাষ্যে:
"একদিন আমরা কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। তাকে জানালাম, এই সময়ে কলকাতার কিছু ক্ল্যাসিক বাংলা ছবি পেলে যেমন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিককুমার ঘটক, মৃণাল সেন- এ ধরনের পরিচালকদের কিছু ছবি যদি আমরা দেখি, তাহলে এ দেশের ছবির মান আরো উন্নত হবে। বঙ্গবন্ধু পাইপ টেনে বলেন, ওরা কি শুধু বাংলা ছবি দেবে? মনে হয় না, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করে দেখি। সেদিনের মতো আমরা চলে এলাম। দুই সপ্তাহ পর উনি ডাকলেন আমাদের। আমরা গিয়ে দেখি উনি উত্তপ্ত। ঘন ঘন পাইপ টানছেন। একটা চিঠি আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ো’। নীরবেই আমরা চিঠিটা পড়লাম। চিঠিতে লেখা আছে, শুধু বাংলা ছবি নয়, হিন্দি ছবিও নিতে হবে। হঠাৎ করে টান মেরেই চিঠিটা আমাদের হাত থেকে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর ছিঁড়ে কুচিকুচি করে চিঠিটা ফেলে দিয়ে বললেন, কী বলছিলাম? শুধু বাংলা ছবি ওরা দেবে না।[iii]"
এই মনোভাবের সত্যতা মেলে যখন দেখা গেল ১৯৭২ এর ২৪ এপ্রিল গৃহীত প্রথম আমদানি নীতিতে ইংরেজি বাদে সকল বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র আমদানি রহিত করা হয়েছে। একই সাথে সেই ৭২ সালেই গৃহীত সংবিধানের ২৩ অনুচ্ছেদে এও বলা হয় যে,
“রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন৷” [iv]
উল্লেখ্য যে, ৭২-এর সংবিধানের ৯ম অনুচ্ছেদে স্পষ্টকৃত যে এক নং রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি তার সাথে সংবিধানের এই ২৩ তম অনুচ্ছেদটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেখানে বলা হয়েছে-
“ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালী জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।”
বাংলাদেশের বর্তমান আমদানি নীতি ২০২১-২৪, যা ২০২৪ সালের ৩০ জুন অব্দি বলবৎ থাকবে, তাতেও এই মনোভাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়[v]। সর্বশেষ এই আমদানি নীতির ৩৬ ধারায় উল্লেখিত যে-
আমদানি নীতির ৩৬ (ক) ও (খ) ধারার মাধ্যমে চলচ্চিত্র আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকৃত চলচ্চিত্রের ভাষাগত মাধ্যমের গুরুত্ব স্পষ্ট করা হয়েছে, যা সংবিধানের ২৩ ধারায় উল্লেখিত ‘জনগণের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষণ’ এর অনুগামী। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত রাখা হয়েছে, যা কিনা বঙ্গবন্ধুর গৃহীত ১৯৭২-এর প্রথম আমদানি নীতি আদেশের অনুগামী। একইসাথে ৩৬ (গ) ধারার আওতায় বহুপাক্ষিক SAFTA চুক্তিভুক্ত দেশসমূহ থেকে বিদেশি চলচ্চিত্র যার ভাষিক মাধ্যম “বাংলা”, তা আমদানির পথ খোলা রাখার মাধ্যমে সংবিধানের ২৩ ধারায় উল্লেখিত “জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ” করা হয়েছে। যা কিনা, পূর্বে উল্লেখিত প্রয়াত পরিচালক আমজাদ হোসেনের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথোপকথনের মূলসুরের অনুগামী।
আইনি বিধানের এই বিবর্তন লক্ষ্য করলে খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ্যণীয় যে, রাষ্ট্র কর্তৃক চলচ্চিত্রকে ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং সেই সংস্কৃতির যে ভাষাগত ভিত্তি সেই ‘বাংলা’ ভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য ভাষাসমূহের তুলনায় বিধিগত ছাড় দেয়া হয়েছে। এবং এই আলোচনার জন্য যেটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি যে, বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা ব্যতিরেকে উপমহাদেশীয় ভাষাসমূহে নির্মিত চলচ্চিত্র আমদানি রোধ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে একটি রিট আবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ খাতে বাণিজ্যিকভাবে হিন্দি গান ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন উচ্চ আদালত, যে রায়টিও সংবিধানের ২৩ ধারাকে সমুন্নত করে[vi]।
সুতরাং, উপমহাদেশীয় অ-বাংলা চলচ্চিত্র আমদানি করা হলে তা বাংলাদেশের হালনাগাদ আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২৪-এরই কেবল খেলাফ হবে না বরং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ২৩ ও ৯ম ধারারও সম্ভাব্য লঙ্ঘন হবে।
হলগুলো কি সত্যিই সিনেমার অভাবে মরণাপন্ন?
বাংলাদেশে হল মালিকদের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়েছে যে অন্তত ৭০-৮০টি সিনেমা বাৎসরিক মুক্তি না পেলে তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়[vii]। এই সংখ্যক দেশি সিনেমা নেই বিধায়ই তাদেরকে হিন্দি সিনেমা আমদানি করতে দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রদর্শন ব্যবসার ইতিহাস কি এর সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে, নিচের গ্রাফটি দেখা যেতে পারে। গ্রাফটিতে ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশে চলমান হল সংখ্যার বিপরীতে বাৎসরিক মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা দেখানো হলো। স্বাধীনতার পর থেকে বাৎসরিক মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা এবং হল সংখ্যা সামঞ্জ্যস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেলেও, নব্বই দশকের সূচনালগ্নে বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা যায়। লক্ষ্যণীয় যে, নব্বই দশকের মধ্যলগ্নে আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রভাবে সিনেমা শিল্প ধাক্কা খেতে শুরু করে। চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যা নেমে আসে। এরপরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হল সারা দেশজুড়ে চালু ছিল। পাঠকের স্মৃতিতে থাকবে হয়তো– এই সময়টিকে বাংলা চলচ্চিত্রের সালমান শাহ যুগ বলা যেতে পারে। মোটামুটি একক কৃতিত্বে এসময় বাংলা চলচ্চিত্রকে টেনে নিয়েছেন তিনি। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে সালমান শাহর অকালমৃত্যুর পরে সিনেমা হল সংখ্যাও নিম্নমুখী হতে শুরু করে। এরপর হঠাতই ১৯৯৮ সাল থেকে আবারও সিনেমার সংখ্যা ও হল সংখ্যা উর্ধ্বমুখী হয়ে স্থিতাবস্থায় অবস্থান করতে শুরু করে। ১৯৯৮-২০০৭ অব্দি এই সময়টিতেই বাংলা সিনেমায় অশ্লীলতার জোয়ার আসে, যার প্রথমিক সূচনা হয় কতিপয় হল মালিকের মাধ্যমে[viii]। বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র হল মালিকেরা যেমনটি আশা করছেন, বাৎসরিক প্রায় ১০০টি চলচ্চিত্র মুক্তির চলটি কাটপিস যুগেই কেবল নিয়মিতভাবে দেখা যেত।
এই সময়ের মধ্যেই সিনেমা হলগুলো বিপুল লাভের মুখ দেখে এবং এই যুগের সমাপ্তি ঘটার সাথে সাথেই মুক্তিপপ্রাপ্ত বাৎসরিক সিনেমা সংখ্যা সহসাই ৫০-এর নিচে নেমে আসে এবং সিনেমা হলের সংখ্যা আবারও নিম্নমুখী হতে শুরু করে, যে ধারা এখনো চলমান। তবে, কয়েক বছরের মধ্যেই চলচ্চিত্র সংখ্যা আবারও উর্ধ্বমুখী হলেও, হলের সংখ্যা আর বাড়েনি। অর্থাৎ, সিনেমা তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হলগুলোতে দর্শকদের আর টানা যায়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অশ্লীল যুগের ব্যবসা পরিস্থিতিকেই কি হল মালিকগণ প্রেক্ষাগৃহ ব্যবসার স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নিচ্ছেন? কারণ, বাংলা চলচ্চিত্রের বাৎসরিক সংখ্যা অশ্লীল সময়কাল বাদ দিলে, বাদবাকি সময় যেমন ছিল বর্তমান সময়েও তেমনই রয়েছে (গড়ে ৬০-৬৫টি)। যদিও, বৈশ্বিক কোভিড মহামারী চলাকালীন সময়কালটি এক্ষেত্রে বোধগম্য ব্যতিক্রম। যাইহোক, দেখা যাচ্ছে যে উপাত্তগত দিক থেকে হল মালিকদের বাংলা সিনেমার অপ্রতুলতার যুক্তিটি খাটে না, যদি কাটপিস আমলকে বাদ দেয়া হয়। বাৎসরিক ৬০-৬৫টি সিনেমা মুক্তি দিয়ে যদি আশির দশকে ৬০০-এর অধিক হল চলতে পারে, তাহলে এখন ২০০ হলও চলতে পারছে না কেন? দায়ী কি সিনেমার মান, সিনেমা হলে অবকাঠামোগত ও সামাজিক পরিবেশ নাকি সিনেমার প্রচারের অপ্রতুলতা?
এরই প্রেক্ষিতে, Bengaliness Research Initiative (BRI) বাঙালিত্ব গবেষণা উদ্যোগ-এর পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিত্তিক একটি ছোটো জরিপ চালানো হয় বিভিন্ন ছোটো শহর ও মফস্বলভিত্তিক চলচ্চিত্রপ্রেমিদের মধ্যে। সর্বমোট ২৫০ জনকে একটি আবদ্ধ (ক্লোজ এন্ডেড) প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নটি ছিল:
“আপনাদের স্থানীয় প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান অবকাঠামো ও পরিবেশ অপরিবর্তিত থাকবে ধরে নিয়ে, নিচের কোন অপশনটি আপনার জন্য সর্বাপেক্ষা সঠিক?”
প্রদত্ত অপশনগুলো ছিল:
- ভালো সিনেমা এলে সপরিবারে দেখতে যাবো (অর্থাৎ, এই শ্রেণির দর্শক কেবল সিনেমার কন্টেন্ট/মান নিয়েই ভাবিত)।
- ভালো সিনেমা এলেও দেখতে যাবার মতো পরিবেশ নেই (এই শ্রেণির দর্শকদের কাছে সিনেমা হলে পরিবেশটাই প্রধান বিবেচ্য)।
- ভালো সিনেমা এলেও, তা জানবার উপায় নেই (এই শ্রেণির দর্শক প্রচারের অভাবে সিনেমা সম্পর্কে জানতে পারেন না)।
এরই প্রেক্ষিতে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো উপস্থাপিত হলো এই ইনফোগ্রাফটিতে। জরিপটিতে কেবল যেসকল শহর বিভাগীয় শহর নয়, সেগুলোর চলচ্চিত্রপ্রেমিদেরকেই অংশগ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ এই যে, বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান প্রায় ২০০ প্রেক্ষাগৃহের অধিকাংশই এসব শহরগুলোতে অবস্থিত এবং সর্বমোট জনসংখ্যাতেও এসব শহরের অংশগ্রহণ অধিক।
দেখা যাচ্ছে, মফস্বলের অধিকাংশ দর্শকের মতে, ভালো ছবি এলেও তারা হলমুখী হবেন না, কারণ হলের পরিবেশ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট নন। একই ধরনের ফলাফল সিলেট বিভাগের চলচ্চিত্র দর্শকদের ওপরে চালানো জরিপেও লক্ষ করা যায়, যেখানে ৫০%-এর অধিক দর্শক মত প্রকাশ করেন যে, দর্শক আকর্ষণ করতে হলে সিনেমা হলগুলোকে অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নততর হয়ে উঠতে হবে[ix]। সুতরাং, সিনেমা হলের মালিকদেরকে সিনেমা হলের অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে হবে। আধুনিক দর্শকের রুচির সাথে তাল মেলাতে হবে। সিনেমাকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের রেডি প্রোডাক্ট হিসেবে ধরে নিয়ে নিজেদের অবকাঠামোগত বিনিয়োগের দায়িত্বে ছাড় দিলে, ব্যবসায়িক সফলতা অর্জন কঠিনতর হবে। হলগুলোর অবকাঠামোগত স্মার্টনেস যে ব্যবসার পক্ষে সহায়ক তার প্রমাণ হচ্ছে, দেশে গত এক দশকে গতানুগতিক প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ক্রমনিম্নগামী হলেও সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বেড়েছে ৫গুণ।
সিনেমা হল বাঁচলেই কি বাংলা চলচ্চিত্র বাঁচবে?
একটি ডিম আগে না মুরগি আগে গোছের প্রশ্ন শোনা যায় প্রায়ই। হল ব্যবসায় লাভ না থাকলে হলের পরিবেশের উন্নয়ন হবে কী করে? অর্থাৎ হলগুলোকে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি করতে দিলে হলগুলো অবকাঠামোগত বিনিয়োগের সাহস পাবে, কারণ তাদের ধারণা, এতে করে হিন্দি ছবির দর্শকগণ হলে আসবে। ফলে হলের পরিবেশ ফিরবে এবং জনসাধারণ বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যেও হলমুখী হবেন।
এই তত্ত্বটিকে যাচাই করতে আবারও প্রথম গ্রাফটিতে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। লক্ষ্য করলে দুটো ঘটনা দেখতে পাবেন– ১. বাংলাদেশের ইতিহাসে একই সাথে হাজারের ওপর হল এবং বাৎসরিক ১০০টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে ১৯৯৮-২০০৭ এর কাটপিস আমলে অর্থাৎ এই সময়টি সিনেমা হলগুলোর জন্য সবথেকে ব্যবসাসফল সময়; ২. বাংলাদেশের ইতিহাসে সিনেমা হল সংখ্যা ও চলচ্চিত্র সংখ্যার দ্রুততম অবনমন ঘটেছে ২০০৭ সালের পর থেকে, অর্থাৎ সবথেকে ব্যবসাসফল সময়ের ঠিক পরপরই সবথেকে দ্রুততম পতন ঘটেছে। এটুকু তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, হলগুলো প্রায় এক দশক টানা ব্যবসাসফল হওয়া সত্ত্বেও, নিজেদের অবকাঠামো, প্রযুক্তি বা পরিবেশগত কোনোপ্রকার উন্নয়ন সাধন করেননি। উল্টো, এই ব্যবসাসফল সময়টিই মূলধারার বাংলা চলচ্চিত্র দর্শকদেরকে দীর্ঘমেয়াদে হলবিমূখ করে তুলেছে, যার ফলে পরবর্তীতে মাঝারিমানের এমনকি ভালোমানের চলচ্চিত্রও পর্যাপ্ত হল পায়নি। সুতরাং, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাচ্ছে যে সিনেমা হলগুলো বাঁচলেই যে বাংলা চলচ্চিত্র বাঁচবে– এই দাবির সত্যতা নেই। সেক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র চলচ্চিত্রকে শিল্প (Industry) হিসেবে গণ্য করে, সিনেমা হলগুলোকে নয়। হলগুলো নিছক উৎপাদিত পণ্যের প্রদর্শন করে; সুতরাং সংরক্ষণ বা সহায়তা যদি কারও প্রয়োজন পড়ে, তা হচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্র প্রদর্শকগণ নন।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হবে। স্প্যানিশভাষী মেক্সিকান চলচ্চিত্র নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মেক্সিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার ছিল। মধ্য-৯০তে উত্তর আমেরিকান মুক্ত বাজার অঞ্চল (নাফটা) চুক্তির মাধ্যমে মেক্সিকোতে প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্র থেকে একই ভাষাপরিবারভুক্ত ইংরেজি ভাষার হলিউড চলচ্চিত্র প্রবেশ করতে শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে ২০১০ সাল নাগাদ মেক্সিকোর চলচ্চিত্র বাজারে মোট ব্যবসার মাত্র ৬.১%-এ নেমে আসে মেক্সিকোর নিজস্ব চলচ্চিত্র [x]। সুতরাং, মেক্সিকোর হলগুলো দিব্যি ব্যবসা করলেও মেক্সিকান চলচ্চিত্র তলানিতে পৌঁছেছে। হল বাঁচলেই চলচ্চিত্র বাঁচবে– এই জাতীয় চটুল দাবির ব্যাপারে তাই সতর্ক থাকতে হবে।
করণীয় কী তবে?
প্রথমত, হল মালিক ও আমদানি-ইচ্ছুক মধ্যস্বত্তভোগী বা সমিতির নেতাভিত্তিক ঐক্যমতের ওপরে আস্থা না রেখে, পূর্ণ জরিপ এবং বিশ্লেষিত উপাত্তের ওপর নির্ভর করে ভীন্নভাষার চলচ্চিত্র আমদানির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষা হিসেবে বাংলার রাজনৈতিক মর্যাদা যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৫২-এর অভিপ্সা কিন্তু বাংলাকে মুখের ভাষা করা না বরং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া।
এখন তথ্যের ভিত্তিতে একান্ত ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি যদি করতেই হয়, সেক্ষেত্রে আমদানিকৃত উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রগুলোকে বাধ্যতামূলক বাংলাভাষায় ডাব করতে হবে। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুসারে আমদানির ক্ষেত্রে বাধা অপসারিত হতে পারে। হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির ক্ষেত্রে বাংলা ডাবিং বাধ্যতামূলক করলে বাংলাদেশেও দক্ষিণ ভারতের মতো একটি বৃহৎ ডাবিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে যা একটি সম্ভাব্য বৃহৎ কর্মসংস্থান হিসেবেও প্রতীয়মান হতে পারে।
আবার এর কোনোকিছুই না করে বিনাপ্রশ্নে হিন্দি আমদানি করাও যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়ভাষা হিসেবে হিন্দিকে স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। নীতিনির্ধারকগণ ভেবে দেখতে পারেন। এখন যেভাবে নানান আবোল তাবোল বকছেন, তারচে আর কতই বা খারাপ হবে ব্যাপারটা, বলুন?
তথ্যসূত্র:
[i] https://prsindia.org/policy/report-summaries/india-s-soft-power-and-cultural-diplomacy
[iii] https://www.bhorerkagoj.com/2020/09/06/ চলচ্চিত্র-শিল্প-বাঁচানোই/
[iv] http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-957/section-29375.html
[vi] https://www.kalerkantho.com/online/national/2015/07/10/243542
[vii] https://www.prothomalo.com/entertainment/ প্রেক্ষাগৃহ-সচল-রাখতে-কয়টা-সিনেমা-দরকার
[ix] http://www.ijbejournal.com/images/files/3218790965c5d3b4a93c8e.pdf
[x]https://www.theguardian.com/film/2013/may/01/mexico-film-industry-hollywood