কান্না জড়ানো কণ্ঠে ববিতা বললেন ‘মানতে পারছি না’

গ্লিটজের সঙ্গে আলাপচারিয়াতায় সদ্য প্রয়াত নায়ক ফারুককে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেছেন ববিতা।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2023, 10:01 AM
Updated : 15 May 2023, 10:01 AM

‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’সহ বহু সিনেমা ‘হিট’ করেছিলেন দেশের চলচ্চিত্র জগতের সাড়া তোলা দুই অভিনয়শিল্পী আকবর হোসেন পাঠান ফারুক ও ফরিদা আক্তার ববিতা। ফারুকের মৃত্যুর খবরে ববিতা জানালেন, এই নায়কের প্রস্থান কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি।  

সোমবার সকালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ফারুকের। রক্তে সংক্রমণসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে যে হাসপাতালে ২০২১ সালের মার্চ থেকে চিকিৎসাধীন ছিলেন বাংলা সিনেমার এই নায়ক। 

ফারুকের মৃত্যুর খবর আসার পর তাকে নিয়ে গ্লিটজের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন ববিতা। পরে কিছুটা সামলে নিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেন। 

তার কথায় উঠে আসে দুই শিল্পীর পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধাবোধ ও শুটিংয়ের সময়ের নানা খুনসুটির অজানা গল্প। 

ভেবেছিলাম ফারুক ভাই ফিরে আসবেন 

“সকালে ফারুক ভাইয়ের মৃত্যু খবরটি জানার পর থেকেই আমি ভীষণ মর্মাহত। ৫/৬ দিন আগে ফারুক ভাইয়ের স্ত্রীর বোনের সাথে আমার দেখা হয়েছে। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ফারুক ভাইয়ের অবস্থা ভালোর দিকে। উনি দেশে চলে আসবেন। উনার পায়ে ব্লাড সার্কুলেশনের একটু সমস্যা হচ্ছে। এটা শুনে মনে হয়েছিল, ফারুক ভাই অমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। কিন্তু এখন তো সব শেষ হয়ে গেলো। 

“এটা মেনে নিতে পারছি না। ফারুক ভাইয়ের মৃত্যু খবরটি মেনে নিতে পারছি না। এখন তো আর কিছু বলার নেই। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলি, আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।“ 

একসঙ্গে প্রথম অভিনয় এবং অন্যান্য ছবি 

১৯৭৩ সালে নির্মাতা খান আতাউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’তে অনেকের সঙ্গে ফারুক ও ববিতা অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু এই দুজন প্রথম জুটি হয়ে আসেন মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সিনেমা ‘আলোর মিছিল’ এ। যেখানে ববিতার নায়ক হয়ে ছোট ছোট দৃশ্যে হাজির হয়েছিলেন ফারুক। 

ববিতা বলেন, “ফারুক ভাইয়ের সাথে তো অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছি। তবে উনার সাথে প্রথম যে সিনেমায় জুটি বেঁধে অভিনয় করি, সেটি হলো ‘আলোর মিছিল’। এটি দেশ স্বাধীনের পর পর করেছিলাম। পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। “ 

বেশ কিছু সিনেমার নাম স্মরণ করে ববিতা জানিয়েছেন, তারা একে অন্যকে নিজেদের সিনেমার জন্য নির্বাচন করতেন। 

“তারপর ‘লাঠিয়াল’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমণি’,’সুর্য সংগ্রাম’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘মিয়া ভাই’সহ বহু সিনেমায় আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি। ফারুক ভাইয়ের সিনেমায় আমাকে নিয়েছেন। আমি আমার সিনেমায় ফারুক ভাইকে নিয়েছি।“

সহকর্মীসুলভ সুসম্পর্ক এক সময়ে পারিবারিক সম্পর্কে পৌঁছেছিল বলেও জানান ববিতা। 

“আমরা যখন কাজ করেছি, তখন আমাদের মাঝে একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমরা একে অপরের সুখ-দুঃখের কথা শুনেছি, জেনেছি। ফারুক ভাই আমার বাড়িতে আসতেন ভাবীকে নিয়ে। আসার সময় ভাবী আবার রান্না করে নিয়ে আসতেন। যখন ফারুক ভাইয়ের কিডনির সমস্যা হয়েছিল, আমরা তিনবোন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। পারস্পরিক এই হৃদ্যতা আমাদের মাঝে ছিল।“ 

শুটিং দিনের স্মৃতি 

ববিতা বলেন, “একসঙ্গে কত কাজ করেছি। সেই সব শুটিং দিনের স্মৃতি তো বলে শেষ করা যাবে না। অনেক আনন্দের স্মৃতি আছে আমাদের। ফারুক ভাইয়ের সাথে তো বেশিরভাগ সিনেমা করেছি গ্রামে। 

মানিকগঞ্জ, ঝিটকা, নবগ্রামে আমরা অনেক শুটিং করেছি। তখন নানা মজার ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময় শুটিং না থাকলে আমি গিয়ে রান্না করতাম। তখন ফারুক ভাইকে নিয়ে সেই খাবার খেয়েছি। সবাই মিলে আমরা একটা পরিবার হয়ে শুটিং সেটে কাটিয়েছি।“ 

ফারুক পাখি শিকার করতেন জানিয়ে ববিতা জানালেন, দুজন একসঙ্গে শিকারেও গিয়েছেন তারা। 

“আমার আবার একটা এয়ার গান ছিল। আমি তখন ভাবতাম ফারুক ভাই শিকার করছে, আর আমি মেয়ে বলে পারছি না, তা-ই কি হয়? তখন আমিও আমার এয়ার গানটা নিয়ে যেতাম পাখি শিকার করতে।”

শুটিং সেটের সব কৈ মাছ খেয়ে ফেললাম 

“কাজী জহির সাহেবের ‘কথা দিলাম’ সিনেমাটির শুটিং করতে গিয়েছিলাম কলাকোপা বান্দুরায়। সেই সিনেমাটি সুপারহিট হয়েছিল। তখন তো কাজী জহির মানেই বেশ সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল। সেই সিনেমাটির শুটিং করতে গিয়ে গরু বা খাসির মাংস খুব একটা পেতাম না। ওটা সম্ভবত খ্রিস্টান এলাকা ছিল। তবে সেই শুটিং সেটে আমাদের খুব মাছ খাওয়াতেন।  

একদিন শুটিং সেটে একটা খাসি আনা হল, সেটি বেঁধে রেখে আমাদের প্রতিদিনই বলা হচ্ছে- তোমাদের এই খাসিটি জবাই করে খাওয়ানো হবে। আমি আর ফারুক ভাই তখন ওদের বললাম, এটা প্রতিদিন আমাদের দেখাও, কিন্তু জবাইও করো না রান্নাও করো না। “

এজন্য কীভাবে সবাইকে দুজন মিলে ‘জব্দ’ করেছিলেন সেই বর্ণনায় ববিতা বলেন, “তখন একদিন জিদ করলাম। সেদিন শুটিং সেটে অনেক সুন্দর কৈ মাছ রান্না হয়েছিল। আমরা আউটডোর শুটিং করেছিলাম নৌকাতে। সেই নৌকার মধ্যেই মাছের হাঁড়িটি ছিল। আমি আর ফারুক ভাই তখন ঠিক করলাম, যে আমাদের তো সেই খাসিটি জবাই করে খাওয়াচ্ছে না। আমরা আজকে প্রোডাকশনের সব কৈ মাছ খেয়ে ফেলব।  

“আমরা তখন সব কৈ মাছ খেয়ে ফেললাম। এটা চিন্তা করলে আমার খুব হাসি পায়। সবাই তখন বলাবলি করছে, মাছগুলো গেল কই। তখন তারা জানতে পারল আমি আর ফারুক ভাই সব কৈ মাছ খেয়ে ফেলেছি। এই যে মজাগুলো আমরা করেছি, এমন অসংখ্য স্মৃতি আছে আমাদের। “ 

শেষ দেখা 

গ্লিটজকে নায়কের সঙ্গে শেষবারের দেখার স্মৃতি তুলে ধরে ববিতা বলেন, “ফারুক ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে। সেখানেই উনাকে সবশেষ দেখেছিলাম। সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে আমি সেদিন ফারুক ভাইয়ের অনেক প্রশংসা করেছি। ওইদিনই আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।  

“২০১৬ সালে ৪১তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে যুগ্মভাবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন দারুণ জনপ্রিয় জুটি ফারুক ও ববিতা। যে জুটির পর্দারসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরে তাদের প্রেম চলছে এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।

আরও পড়ুন -

Also Read: ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’

Also Read: নায়ক ফারুকের মৃত্যুতে ফেইসবুক যেন শোকবই

Also Read: চিত্রনায়ক ফারুকের চিরবিদায়

Also Read: ফারুককে সিঙ্গাপুর নিতে চায় পরিবার

Also Read: ফারুক ‘ভালো আছেন’, গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ স্ত্রীর

Also Read: জন্মদিনে দোয়া চেয়ে কাঁদলেন ফারুক

Also Read: ঢাকা-১৭ তে নৌকার প্রার্থী ফারুক, আছেন এরশাদও