ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’

এ অভিনেতার প্রয়াণের দিনে তার অভিনীত ৬০টির বেশি সিনেমার মধ্য থেকে জনপ্রিয় কিছু সিনেমার সুলুকসন্ধান করেছে গ্লিটজ।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2023, 09:12 AM
Updated : 15 May 2023, 09:12 AM

‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’ গানের এই কলিটি মনের ভেতরে গুনগুনিয়ে উঠলেই যে মাঝির ছবি স্মৃতিতে ভাসে, সেই ‘সুজন’ আরও অনেক আগেই বাংলা সিনেমায় জ্বালিয়েছিলেন ‘আলোর মিছিল’। শুরুটা একাত্তরে, ‘জলছবি’ দিয়ে।

এরপরের পাঁচ দশক ধরে ‘সারেং বউ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমণি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘সাহেব’, ‘মিয়াভাই’, ‘নাগরদোলা’, ‘সুজনসখী’, ‘ঘরজামাই’, ‘ভাইভাই’, ‘সাহেব’, ‘কথা থাকে’, মাটির পুতুল’সহ ডজন ডজন জনপ্রিয় ও সফল সিনেমার নায়ক আকবর হোসেন পাঠান, যাকে এ দেশের মানুষ চেনে ফারুক নামে।

এ অভিনেতার প্রয়াণের দিনে তার অভিনীত ৬০টির বেশি সিনেমার মধ্য থেকে জনপ্রিয় কিছু সিনেমার সুলুকসন্ধান করেছে গ্লিটজ। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ফারুক চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। পরিচালনা করেছিলেন এইচ আকবর। এই নির্মাতার একটি সিনেমাই ফারুক করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে ফারুক আবার চলচ্চিত্র আসেন। ফারুকের অভিনয় জীবনে ১৯৭৩ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত দারুণ গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় ধরা হয়। কারণ ওই তিন বছরে ফারুক মুক্তিযুদ্ধের দুই সিনেমা ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’ এবং প্রেমের সিসেমা ‘সুজন সখী, ‘নয়নমণি’ করে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে ‘নায়ক রাজ রাজ্জাকের’ রাজত্বেও নিজেকে তরুণ নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে ‘সারেং বউ’ ও ‘লাঠিয়াল’ করেও প্রশংসা কুড়ান। পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। এ সিনেমায় নায়কের চরিত্র না পেলেও অভিনয়ে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছিলেন ফারুক। নায়ক ছিলেন সরকার ফিরোজউদ্দিন, নায়িকা ববিতা। সেখানে এক মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে পর্দায় আসেন ফারুক।

সিনেমায় তার বোন (সুলতানা) আত্মহত্যা করে প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতায়। ছোট হলেও ফারুকের চরিত্রটি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।

১৯৭৪ সালে নারয়ণ ঘোষ মিতার সিনেমা ‘আলোর মিছিল’-এ ববিতার বিপরীতে অভিনয় করেন তিনি। যদিও ছবিতে নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। সিনেমার ববিতার নায়ক হয়ে ছোট ছোট দৃশ্যে হাজির হয়েছিলেন ফারুক।

একই নির্মাতা ১৯৭৫ সালে ফারুককে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিয়ে আসেন ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায়। সেখানে ফারুকের বিপরীতে নায়িকা ছিলেন ববিতা। ওই সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' পেয়েছিলেন ফারুক।

সে বছরই মুক্তি পাওয়া অন্য একটি সিনেমা ফারুকের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেটি হল নির্মাতা খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’। সিনেমাটি মুক্তি পর দর্শকদের মুখে মুখে শোনা যেত, ‘সব সখীরে পার করিতে নিব আনা আনা’।

'মেলোড্রামাটিক' ওই সিনেমার কাহিনী ও সংলাপ লিখেছিলেন আমজাদ হোসেন। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে ওই সিনেমায় পারিবারিক কলহের জেরে ভেঙে যায় একটি যৌথ পরিবার। ছোটবেলার খেলার সাথী দুই চাচাতো ভাই-বোন আলাদা হয়ে যায়। বড় হয়ে আবার তাদের দেখা হয়। জন্ম নেয় প্রেম। তারপর পারিবারিক জটিলতা এবং মিলনাত্মক পরিণতি।

এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন ফারুক। নায়িকা কবরীও ছিলেন দারুণ ‘আবেদনময়ী’। এই ছবির গান ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

এই গানের সঙ্গে ফারুক ও কবরীর অভিনয় এবং পর্দা রসায়ন আজও স্মরণ করেন পুরানো দিনের দর্শকরা। সিনেমাটি সুপার হিট হয়। আর এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদেই চলচ্চিত্রে গ্রামীণ যুবকের চরিত্রে ফারুক ‘স্থায়ী’ আসন গড়ে তোলেন।

‘সুদর্শন ও প্রতিভাবান’ অভিনেতা ফারুক দর্শকের মন জয় করে নেন সহজেই। পরে ওই সিনেমার রিমেক হয় নব্বইয়ের দশকে। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ ও শাবনূর অভিনীয় ‘সুজনসখী’ও পেয়েছিল জনপ্রিয়তা।

৭৬ সালে আসে ফারুকের তিন তিনটি ছবি। তার মধ্যে আলোচিত ‘সূর্যগ্রহণ, ‘নয়নমণি’। ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমায় কিছুটা নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেন ফারুক।

তবে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’র বাণিজ্যিক সাফল্য ফারুককে নায়ক হিসেবে আরও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ববিতার বিপরীতে নায়ক ছিলেন তিনি। ‘নয়নমণি’ ববিতা-ফারুক জুটিকেও প্রতিষ্ঠিত করে।

দুবছর বিরতি দিয়ে ১৯৭৮ সালে ফের বাজিতাম করেন ফারুক। ওই বছরে মুক্তি পায় সিনেমা ‘সারেং বৌ ‘। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি নারীকেন্দ্রিক হলেও ‘কদম সারেং' চরিত্রে জীবনঘনিষ্ট অভিনয়ের জন্য সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান ফারুক।

সমালোচকদের ভাষ্য ছিল, ওই সিনেমায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ফারুক যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে 'ক্ল্যাসিক' হিসেবে গণ্য। সিনেমায় তার বিপরীতে ছিলেন কবরী। ‘সুজনসখী’র পর ‘সারেং বউ’ কবরী-ফারুককে বলিষ্ঠ জুটি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।

সে বছরই ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ সিনেমায় কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।এই সিনেমাটিও নারীকেন্দ্রিক, নায়িকা ছিলেন ববিতা। এ ছবিতে গ্রামীণ রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মায়ের তুলে দেওয়া বিষে মৃত্যু হয় মিলন নামে প্রতিবাদী যুবকের। মিলন চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন ফারুক। বিশেষ করে মৃত্যুর দৃশ্যে তার অভিনয় দর্শককে কাঁদায়। এছাড়া কবরীর পর ফারুক-ববিতা জুটিকেও নতুনভাবে গ্রহণ করে দর্শক।

১৯৭৯ সাল নায়ক ফারুকের জবীনে ‘অবিস্মরণীয়’ একটি বছর। সে বছর তার অভিনীত অনেকগুলো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। বিশেষ করে গ্রামীণ তরুণের আইকন হয়ে যান তিনি। গ্রামের সহজ সরল প্রতিবাদী যুবকের চরিত্রে ফারুকের বিকল্প কেউ ছিলেন না ওই সময়। এমনকি এখনও এই ধরনের চরিত্রে কোনো অভিনেতা তাকে অতিক্রম করতে পারেননি বলে অনেকের মত।

১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে ‘নাগরদোলা’, ‘কথা দিলাম’, ‘সাহেব’, ‘ছোট মা’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘ঘরজামাই’, ‘এতিম’, ‘ভাইভাই’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘মাটির পুতুল’সহ বেশ কটি ছবি বাণিজ্যিক সফলতা পায়।

পর্দায় ফরুক অভিনীত ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘তুমি আরেকবার আসিয়া'সহ ইত্যাদি গান লোকের মুখে মুখে ফেরে।

এমব সিনেমায় গ্রামের বেকার যুবক, পরিশ্রমী কৃষক, ট্রাকচালক, ট্রেনচালক, ইত্যাদি চরিত্রের মাধ্যমে তিনি সাধারণ দর্শকের মনের নায়কে পরিণত হন।

৭৯ সালে ফারুকের সিনেমাগুলোর নির্মাতা ছিলেন আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, স্বপন সাহা, কাজী জহির, প্রমোদ কার, জহিরুল হকসহ আর কয়েকজন। ওই দশকে তার নায়িকার নাম কেবল কবরী ও ববিতাতেই থেমে থাকেনি; সুচরিতা, রোজিনাসহ আরও অনেকে ফারুকের নায়িকা হয়েছেন ঘুরেফিরে।

ফারুক আশির দশক শুরু করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় নায়িকা শাবানার সঙ্গে ‘সখী তুমি কার’ সিনেমায়। শাবনার সঙ্গে ফারুকের সেটাই প্রথম কাজ। সেখানে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেও সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি।

একই বছরে সুচরিতার সঙ্গে অভিনয় করেন ‘ছক্কা পাঞ্জা’ সিনেমায়।  

ফারুক এর পরে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত টানা অভিনয় করেছেন। তার ‘জনতা এক্সপ্রেস’, যন্তর মন্তর’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘ঝিনুকমালা, ‘মায়ের আঁচল’ ইত্যাদি বাণিজ্যিক সাফল্য পায়। বিশেষ করে ১৯৮১ সালের ‘জনতা এক্সপ্রেস’ সিনেমায়  নিজের শিশু সন্তানকে বলি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের জীবন বাঁচিয়েছেন এমন এক ট্রেনচালকের ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেন ফারুক।

১৯৮৬ সালে ফারুকের নতুন কোন সিনেমা মুক্তি পায়নি। পরের বছর ৮৭ তে চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় করেন ‘মিয়া ভাই’।

দারুণ জনপ্রিয় ওই সিনেমার পর দর্শকমহল থেকে শুরু করে অনুজদের কাছেও তিনি ‘মিয়া ভাই’ নামে সমাদৃত হয়েছিলেন। যার ধারাবাহিতা ছিল আমৃত্যু।

নায়িকা রোজিনার সঙ্গে ১৯৮৮ সালে ফারুকের দুই সিনেমা ‘দাঙ্গা ফ্যাসদ’ ও ‘পালকী’ ব্যবসা সফল হয়।

নব্বইয়ের দশকের সব বছরে সিনেমায় নিয়মিত ছিলেন না ফারুক। ১৯৯১ সালে ববিতার সঙ্গে করেছিলেন ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’। চাষী নজরুল ইসলামের নির্মাণে ওই সিনেমা নন্দিত হয় সমালোচক মহলে।

এরপর চার বছরের বিরতি। ১৯৯৬ সালে জীবন সংসার সিনেমায় ফারকের সঙ্গে ছিলেন ববিতা এবং ওই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা সালমান শাহ ও শাবনূর।

খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় ফারুক ১৯৯৭ সালে ‘এখনও অনেক রাত’ নামের একটি সিনেমা করেন। সেখানে ফারুক তার একসময়ের দুই নায়িকা ববিতা ও সুচরিতাকে একসঙ্গে অভিনয়ে পেয়েছিলেন। 

নব্বই পরবর্তী সময়ে রূপালী জগত থেকে দূরে সরতে থাকেন ফারুক। তবে ২০০৬ এবং ২০০৮ সালেও  তিনি ‘কোটি টাকার কাবিন’ ও ‘ঘরের লক্ষ্মী’ নামের দুটি সিনেমা করেন।

এরপর থেকে ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক ব্যস্ততা এবং পরবর্তীতে রাজনীতির জন্য অভিনয়ে আর সেভাবে পাওয়া যায়নি ফারুককে।

ক্যারিয়ারে প্রথম থেকে ফারুক নজর কেড়েছিলেন নির্মাতা খান আতাউর রহমানের। যার হাত ধরে একটু একটু করে এগিয়েছিলেন তিনি। এরপর আমজাদ হোসেন, নারায়ণ ঘোষ মিতা, প্রমোদ কর, চাষী নজরুল ইসলামের মত পরিচালকরা তাদের সিনেমায় বেছে নেন ফারুককে।

দীর্ঘ অভিনয় জীবনে ফারুক কবরী ও ববিতা ছাড়াও শাবানা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষসহ সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে কাজ করেছেন। এমনকি আনোয়ারা এবং সুচন্দার মত দুই অভিনেত্রীর বিপরীতেও দুই সিনেমায় নায়ক ছিলেন তিনি। তবে ফারুক-কবরী জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ হিসেবে।

আর জনপ্রিয়তায় ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সেরা। তাদের পর্দার রাসায়ন এত চমৎকার ছিল যে পর্দার বাইরেও দুজনের প্রেম চলছে- এমন গুঞ্জনও আশির দশকের ফিল্মি ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হয়। যদিও তারা কেউই এ বিষয়ে কখনও মুখ খোলেননি।