কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।
Published : 25 Apr 2024, 01:01 PM
সক্রেটিস। একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। বিশ্বে যত বড় বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম সক্রেটিস। এই দার্শনিককে চেনেন না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর।
ইউরোপের দেশ গ্রিসে তার জন্ম। এথেন্সকে বলা হয় ‘সভ্যতার আঁতুরঘর’। এথেন্সের কোণায় কোণায় কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের ছাপ রয়েছে। এথেন্স শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান অ্যাক্রোপোলিস।
বিশ্বের যত পর্যটকই গ্রিস ভ্রমণ করেন, এথেন্সের অ্যাক্রোপোলিসে ছুটে যান। এখানেই রয়েছে দার্শনিক সক্রেটিসের কারাগার, সেখানে কেটেছিল তার জীবনের শেষ দিনগুলো। এটি দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভিড় থাকে সারা বছর।
সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে তার শিষ্য প্লেটোর লেখনিতেই সক্রেটিস সম্পর্কে জানা যায়। সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
প্লেটোর বর্ণনামতে, সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস, যিনি পেশায় একজন স্থপতি ছিলেন (অন্য মতে, ভাস্কর) এবং মায়ের নাম ফিনারিটি, যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম জ্যানথিপ। সংসার জীবনে তাদের তিন ছেলে-সন্তানের জন্ম হয়।
অভাবের সংসার বলে খুব একটা সুখী ছিলেন না সক্রেটিস। সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলতে তিনি বেশিরভাগ সময় দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তার নাক নাকি ছিলো ‘থ্যাবড়া’। দেখতেও নাকি তেমন সুশ্রী ছিলেন না। তবে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তর্কে ছিলেন তুখোড়। তর্ক করে কেউ তাকে হারাতে পারতো না। তার প্রিয় বাক্য ছিলো, ‘নিজেকে জানো’।
‘তরুণদের ভুলপথে চালিত করা’, ‘ধর্মের অপব্যাখ্যা’ এবং ‘দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার’ মতো অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। সক্রেটিস এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিলেন, যা দীর্ঘ ২ হাজার বছর ধরে পশ্চিমী সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু প্রাচীন গ্রিসের শাসকরা সক্রেটিসের তত্ত্বগুলো মানতে চাননি।
সক্রেটিস ছিলেন এক মহান শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার কোন নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিল না। যেখানেই যাকে পেতেন তাকেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি মানব চেতনায় আমোদের ইচ্ছাকে নিন্দা করেছেন, কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগে নিজেও আনন্দিত হয়েছেন।
এথেন্সের তৎকালীন আরাধ্য দেবতাদের নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলতেন সক্রেটিস। তার বিরুদ্ধে অত্যাচারী শাসকদের ‘সমর্থনেরও’ অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও বলা হয় যে, সক্রেটিস নির্দোষ হলেও মুখ বুজে বিচারকদের রায় মেনে নিয়েছিলেন।
মৃত্যুর আগে কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় কারারক্ষীরাও তার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারা তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বিনয়ের সঙ্গে না করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমাকে কাপুরুষ ভাববে’।
পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে সক্রেটিসের নাম উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। তিনি তার নিজ দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেননি। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার প্রভৃতি যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সঙ্গে বিনামূল্যে দর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন।
সোফিস্টদের মতো শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণকে ঘৃণা করতেন তিনি। দার্শনিক আলোচনার প্রতি তার এত বেশি ঝোঁক ছিল যে, তিনি প্রায়শই বলতেন, “নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াই আমার অভ্যাস, আর এজন্যই এমনিতে না পেলে পয়সা-কড়ি দিয়ে হলেও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথি সংগ্রহ করতাম।”
তিনি নিজেকে কখনও সোফিস্টদের মতো জ্ঞানী ভাবতেন না। তিনি বরং বলতেন, “আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি, আর সেটি হলো এই যে, আমি কিছুই জানি না।”
জ্ঞান, শিক্ষা দিয়ে তিনি এথেন্সের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার প্রিয় শিষ্য প্লেটো প্রচার করতে থাকেন গুরুর শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু দেশটির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সক্রেটিসের এ খ্যাতি মেনে নেয়নি। পছন্দ করেনি তার শিক্ষা-দর্শন।
এক পর্যায়ে তারা অভিযোগ করেন, সক্রেটিস নাকি যুব সমাজকে ‘বিপথগামী’ করছেন। এ অভিযোগে তাকে ঢোকানো হলো কারাগারে। কিন্তু এতেও তাকে থামানো যায়নি। তাই সিদ্ধান্ত হয় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার। সত্য ও জ্ঞানের প্রতি অবিচল সক্রেটিসকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত অভিযোগে হেমলক বিষপানে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সক্রেটিস নিজ হাতে বিষাক্ত হেমলকের রস পান করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার নশ্বর দেহটা এথেন্সের মাটিতে মিশে গেলেও তার আদর্শ ও চিন্তা যুগ যুগ মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা যুগিয়েছে। মৃত্যুর আগে তাকে পালানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি পালাননি। হেমলক বিষপান করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মাথা পেতে নিয়েছিলেন।
সক্রেটিস সত্যিই দোষী ছিলেন কিনা, সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালতে ফের নতুন করে বিচারব্যবস্থার আয়োজন করা হয়েছিল। এদিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ২ হাজার ৪১৫ বছর পর গ্রিসের একটি আদালত জানালো, ‘সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন’। সেই বিচারেই সক্রেটিসকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় দিয়েছে ওই আদালত।
সক্রেটিসের সমর্থনে তার আইনজীবী বলেন, “কোনো ব্যক্তির অভিমত অপরাধ হতে পারে না। সক্রেটিস সত্যের সন্ধান করতেন। আর তা করতে গিয়েই তিনি তার নিজস্ব মত তুলে ধরতেন। তবে আমার মক্কেলের একটাই দোষ, তিনি উসকানিমূলক কথা বলে মানুষকে খ্যাপাতেন। আর সবসময় বাঁকা বাঁকা কথা বলতেন। যেমন তিনি বলতেন, ‘দেখাও তোমাদের গণতন্ত্র কতটুকু খাঁটি ও বিশ্বাসযোগ্য’ ইত্যাদি। কিন্তু তিনি আরও বলেন যে, সাধারণ মামলাকে জটিল করার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দেওয়াটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।”
সক্রেটিসের হয়ে এই মামলায় ফ্রান্সের এই বিখ্যাত আইনজীবী সওয়াল করেন। উল্টোদিকে গ্রিস-সহ বেশ কয়েকটি দেশের আইনজীবীরা সক্রেটিসের বিরোধিতা করেন। এই মামলার বিচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়।
দীর্ঘ বাদানুবাদের পর সক্রেটিসের আইনজীবীর যুক্তিতেই সিলমোহর দেন বিচারকরা। ২০১৬ সালে নিউ ইয়র্কের একটি আদালতেও সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
সক্রেটিসের কয়েকটি উক্তি: ‘বিস্ময় হলো জ্ঞানের শুরু।’, ‘টাকার বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভালো।’, ‘জ্ঞানের শিক্ষকের কাজ কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর জেনে দেখানো যে জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিল।’, ‘বন্ধু হচ্ছে দুটি হৃদয়ের একটি অভিন্ন মন।’, ‘পোশাক হলো বাইরের আবরণ, মানুষের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে তার জ্ঞান।’, ‘নিজেকে জানো।’, ‘তুমি কিছুই জান না, এটা জানা-ই জ্ঞানের আসল মানে।’, ‘তুমি যা হতে চাও তা-ই হও।’, ‘কঠিন যুদ্ধেও সবার প্রতি দয়ালু হও।’, ‘মৃত্যুই হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ।’
সক্রেটিস বেঁচে থাকলে হয়তো পৃথিবী আরো অনেক মহৎ জ্ঞান পেতো।