Published : 21 Sep 2022, 09:20 AM
প্রথমবারের মতো নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের খাতওয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা হলেও তা কবে নাগাদ হতে পারে, তা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
২০০৯ সাল থেকে দলগুলো অডিট রিপোর্ট জমা দিলেও ইসি এবং রাজনৈতিক দল, কোনো পক্ষই খাতওয়ারি বিবরণ প্রকাশ করেনি। তবে প্রধান কয়েকটি দল আয়-ব্যয়ের অঙ্কটা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে আসছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন এবার আয়-ব্যয়ের সেই খাতওয়ারি প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা নিয়েছে। সবার নিরীক্ষিত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম অডিট রিপোর্ট জমা নিয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন।
এবার দলগুলোর অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে কি না জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “অনেক দল তো ইসিতে অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর তথ্য জানিয়ে দেয়।
"দলের আর্থিক লেনদেনের তথ্য প্রকাশে আমাদেরও আপত্তি নেই। তবে এ বিষয়ে আইনগত দিকগুলো দেখে কমিশনে উপস্থাপন করা হবে। কমিশন সিদ্ধান্ত দিলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
অডিট রিপোর্টের বিষয়টি নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করে কমিশন সভায় উপস্থাপন করা হলে তা পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলে জানান ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
সেক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ কবে নাগাদ হতে পারে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে আরও।
রোববার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানান, দলের অডিট রিপোর্ট কমিশনে যাচাই-বাছাই করার মতো লোকবল নেই। তবে দলের অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করতে চান তারা।
এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “অডিট করার ক্ষমতা ইসির নেই। এটা যাচাই করার মতো লোকবলও নেই। তবে অডিট রিপোর্ট আইন অনুযায়ী প্রকাশ করব।”
কবে নাগাদ প্রকাশ করা হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে ইসি আলমগীর বলেন, “আমরা কিছু দলের জন্য টাইম বাড়িয়েছি। সবগুলোর একসঙ্গে প্রকাশ করব। আমরা নিয়ম অনুযায়ী প্রকাশ করে দিব।”
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলকে প্রতি পঞ্জিকা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিবন্ধিত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষা করিয়ে পরের বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দিতে হয়।
পরপর তিন বছর কমিশনে এ প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হলে নিবন্ধন বাতিলের এখতিয়ার রয়েছে ইসির।
এবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধিত ১৩টি রাজনৈতিক দল ২০২১ সালের আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এসব দল সময় চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে।
আর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ২৬টি দল ইতোমধ্যে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে।
এ হিসাব প্রকাশে কারও সম্মতি লাগবে কি না অথবা প্রতিবেদনগুলো ইসির পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষা করতে হবে কি না এবং এ সংক্রান্ত আইনি বিষয় পর্যালোচনা করে দেখবে নির্বাচন কমিশন।
যে ১৩ দল সময় চেয়েছে
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারেনি ১৩টি দল। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় এক মাস বাড়ানো হয়।
দলগুলো হলো- জাতীয় পার্টি (জেপি), বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), জাকের পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট)।
ইতোমধ্যে নির্ধারিত সময়ে জমা হওয়া প্রতিবেদনগুলো কমিশনে উপস্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।
নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন দিয়েছে যে ২৬ দল
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ কংগ্রেস।
কেটেছে আইনি বাধা
সবশেষ ২০২১ পঞ্জিকা বছরে আওয়ামী লীগের আয় হয়েছে ২১ কোটি ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৬৬ টাকা। এ দলের তহবিল থেকে ৬ কোটি ৩০ লাখ ১৯ হাজার ৮৫২ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
বিএনপির আয় হয়েছে ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৪৪৪ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৯৮ লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ টাকা। জাতীয় পার্টি আয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ৮৫ হাজার ১৫৪ টাকা, আর ব্যয় দেখিয়েছে ৮৪ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৪ টাকা।
দলগুলো আয়-ব্যয়ের হিসাব দিলেও ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী তৎকালীন এ টি এম শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি তা প্রকাশ করেনি।
দলের সম্মতি ছাড়া এ হিসাব প্রকাশ করা যাবে না বলে যুক্তি দিয়েছিল বিগত নির্বাচন কমিশনগুলো।
রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন চেয়ে ২০১৩ সালে তথ্য অধিকার আইনে ইসির কাছে আবেদন করেছিল বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
সেই প্রতিবেদন প্রকাশে ইসি অপরাগতা জানালে পরে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করা হয়। এ নিয়ে একাধিকবার নির্বাচন কমিশন ও তথ্য কমিশনে আবেদন করলেও তা নাকচ করা হয়।
২০১৪ সালের ১৬ জুলাই তথ্য কমিশন জানায়, তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এর ৯ (৮) অনুসারে তৃতীয় পক্ষের (রাজনৈতিক দল) কোনো গোপনীয় তথ্য তার মতামত ও সম্মতি ছাড়া অনুরোধকারীকে (আবেদনকারী) প্রদান না করার বিধান রয়েছে।
কমিশনের এই বক্তব্যের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৫ সালে ছয় নাগরিক হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। ২০১৬ সালে অডিট রিপোর্ট প্রকাশের পক্ষে রায় দেয় আদালত।
হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়, যে কোনো ব্যক্তি কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন দলের সম্মতি ছাড়াই তা প্রকাশ করতে পারবে।
২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন চালু হয়। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর দলগুলো অডিট রিপোর্ট দিয়ে আসলেও কয়েকটি দল প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে কমিশন সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে।
তবে কোনো দলের ক্ষেত্রেই টানা তিন বছর অডিট রিপোর্ট জমা না দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। সেকারণে পরপর তিন বছর অডিট রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ হলে নিবন্ধন বাতিলের বিধান প্রয়োগের প্রয়োজন পড়েনি ইসির।
আরও খবর
এক বছরে আওয়ামী লীগের আয় বেড়ে দ্বিগুণ
বিএনপির আয়ের চেয়ে ব্যয় দেড় কোটি টাকা বেশি
আর্থিক হিসাব দিতে ব্যর্থ দুই দলকে সতর্ক করল ইসি
আওয়ামী লীগসহ ১২টি দলকে ইসির সতর্কতা
রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতায় বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ে: টিআইবি
দলের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ইসির উদ্যোগ
রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশে ‘বাধা নেই’