আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটিতে ভোট হবে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে; সেটি অংশগ্রহণমূলক করতে ইসির পাশাপাশি সরকারের উদ্যোগ চান এক বিশ্লেষক।
Published : 04 Feb 2023, 12:22 AM
বিএনপির পদত্যাগী উকিল আব্দুস সাত্তার ও হিরো আলম নিয়ে যতটা সরব ছিল ভোটের আলোচনা, ততটাই নিরুত্তাপ ছিল ছয় উপ নির্বাচনের বাকি সবকিছু; ভোটাররাও ছিলেন অনেকটাই নীরব যে কারণে ভোটও পড়েছে কম।
গাইবান্ধা- ৫ উপ নির্বাচনে সিসি ক্যামেরায় অনিয়ম দেখে বাতিলের পর বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের আমলে ভোটের দিকে কিছুটা নজর ফিরলেও সবশেষ ছয় আসনের নির্বাচনে তার অনেকটাই মিলিয়ে গেছে।
অনেকেই বলছেন, ১১ মাসের মধ্যে কুমিল্লা, রংপুর সিটি করপোরেশন ও গাইবান্ধা- ৫ উপ নির্বাচন করে বর্তমান কমিশন আস্থা-গ্রহণযোগ্যতায় যেভাবে এগোচ্ছিল, এবার ভোটারদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় তা অনেকটাই ফিকে হতে শুরু করেছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) সাবেক পরিচালক আব্দুল আলীমও বলছেন তেমনটিই।
এই নির্বাচন বিশ্লেষকের মতে, “মোটাদাগে এ কমিশনের অধীনে কুমিল্লা ও রংপুর সিটির ভোট ভালো গ্রহণযোগ্য হয়েছে। গাইবান্ধা উপ নির্বাচন অনিয়মের কারণে বন্ধের পর কঠোর অবস্থানে ভালো হয়েছে। যদি তুলনা করি, ছয় উপ নির্বাচনের পর ইসির অগ্রসরমান অবস্থান কিছুটা হলে পিছিয়েছে।"
কমিশনের শুরুর দিকে নির্বাচন নিয়ে অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ, সব দলকে ভোটে আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রোডম্যাপ ঘোষণা এবং ইভিএম ও সিসি ক্যামেরায় ভোটের মধ্যে আগের নির্বাচনগুলোতে কঠোর অবস্থান দৃষ্টি কেড়েছিল।
অন্যদিকে সমাবেশ থেকে নাটকীয়তা তৈরি করে সংসদ ছাড়ার ঘোষণার পর বিএনপির সাংসদদের পদত্যাগে শূন্য হওয়া ছয় উপ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটের প্রার্থীদের সমঝোতার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আবহ ছিল কম। ভোটারদের তুলনামুলক কম উপস্থিতিতে নির্বাচনও হয়েছে অনেকটা ঢিলেঢালা।
এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনের ভোটের পরিবেশের দিকে এবার দৃষ্টি সরাচ্ছেন সবাই।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন থাকবে। সেই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
ছয় উপ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার তুলনামুলক কম ছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোথাও কোথাও ভোটের পরিবেশও ছিল ভিন্ন। বিশেষ করে বাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ভিন্ন আঙ্গিকে বা ভিন্ন চরিত্রের নির্বাচন হয়েছে।
স্বতন্ত্র এক প্রার্থী ‘নিখোঁজ’ এবং বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ক্ষমতাসীনদের পরোক্ষ সমর্থনের ঘটনা আলোচনায় রাখে এ আসনের উপ নির্বাচনকে।
“বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনে উপ নির্বাচনে স্বভাবতই দলটি থাকছে না। সেক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক ভোটও হয়নি। ছয় আসনে সমঝোতা হয়েছে, সব আসনে ক্ষমতাসীন দল প্রার্থী দেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনও হয়নি। এতে জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে আগ্রহও ছিল না। সব মিলিয়ে এটাকে লেজিটিমেট ইলেকশন বলতে পারি না। লেজিটেমেসি না থাকলেও লিগ্যাল; কিন্তু গ্রহণযোগ্য একথা বলা যাচ্ছে না,” যোগ করেন তিনি।
চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের শুরুতে হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এর আগে পাঁচ সিটির নির্বাচন হবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির দাবি
দলের ছেড়ে দেওয়া ছয় আসনের উপ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ৫ শতাংশের বেশি ছিল না বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তিনি বলেন, “এই উপ নির্বাচনগুলোতে ভোটারের সংখ্যা কোথাও তাদের (ইসি) হিসাব মতে ১৫ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি হয় নাই। আর আমাদের (বিএনপি) হিসাব মতে- এটা ৫ শতাংশের বেশি হয় নাই।“
অপরদিকে এ উপ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বুধবার তিনি বলেন, "মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাকি মাগুরার দাদা হয়েছে, দাদা হবে। দাদাও হয়নি, নানাও হয়নি, মাগুরাও হয়নি, নির্বাচন হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটু হাতাহাতি হয়েছে। এছাড়া সব কয়টি নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।“
ভোট পড়েছে কত, কম কেন?
বুধবার ঠাকুরগাঁও-৩, বগুড়া-৪ ও ৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছে ২৮. ৪৬ শতাংশ বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।
এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ১৬. ৪৬ শতাংশ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ৪৬. ২৯ শতাংশ, বগুড়া- ৪ আসনে ২৩. ৯২ শতাংশ, বগুড়া-৬ আসনে ২২. ৩৪ শতাংশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে ৩৪.৭৯ শতাংশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে ২৯. ৮ শতাংশ ভোট পড়ে।
বর্তমান ইসির অধীনে ফরিদপুর- ২ আসনে উপ নির্বাচনে ২৬. ২৭ শতাংশ ও গাইবান্ধা- ৫ উপনির্বাচনে প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পড়ে।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা জানান, ঠাকুরগাঁও ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভোটার উপস্থিতি ভালো ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ও বগুড়ায় একটু কম।
উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি না থাকায় বগুড়ায় ভোটার কম এসেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও একই ব্যাপার।
“উপনির্বাচনে ভোট কাস্টিং একটু কমই হয়। সংসদ সদস্যদের মেয়াদকাল খুব কম, ধরেন আট মাস- নয় মাস। এই অল্প সময়ের জন্য আসলে ভোটাররা ইন্টারেস্ট বোধ করে না।”
হিরো আলম ও আসিফ ছিল আলোচনায়
এবারের উপ নির্বাচনে বগুড়া চার আসনে হিরো আলম আট শতাধিক ভোটে হেরে যাওয়ার পর ‘ভোট চুরি নয়, ফলাফল চুরি হয়েছে’ মন্তব্য করেছেন।
বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি বিজয়ী, আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সরকারের সময় সুষ্ঠু ভোট আশা করা যায় না। আশ্চর্যের বিষয় হিরো আলমকে দেখে তারা ভয় পায়। ভোটাররাও এটা মেনে নিতে পারছে না।”
ইভিএম নিয়েও প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “মারবে একজায়গায়, যাবে অন্য জায়গায়। ইভিএমও সঠিক নয়।”
নির্বাচন কমিশন তার বক্তব্য খতিয়ে দেখে অভিযোগের ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, হেরে যাওয়ার পর এ ধরনের অভিযোগের প্রবণতা বরাবরই হয়ে থাকে। কমিশন তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন ফল পাল্টানোর অভিযোগের ভিত্তি নেই। রেজাল্ট সঠিক রয়েছে।
অপরদিকে ভোটের আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফ আহমেদ নিখোঁজ হলে উকিল আব্দুস সাত্তারের ছেড়ে দেওয়া এ আসনের ভোট আবার আলোচনায় আসে। ভোটের পর তার খোঁজও মিলেছে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত এ প্রার্থী বলেছেন, চাপ নিতে না পেরে তিনি নিজেই আড়ালে ছিলেন।
নির্বাচন কমিশন এ ধরনের কাণ্ডকে পরিকল্পিত ও কৌশল বলে মন্তব্য করেছে।
এর আগে এ আসন ছেড়ে দেওয়ার পর বিএনপির পদত্যাগী উকিল সাত্তার স্বতন্ত্র হিসেবে আবার মনোনয়নপত্র জমা দিলে এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিলে আলোচনা তৈরি হয়। বিএনপিও বহিষ্কার করে সাত্তারকে।
অংশীজনরা কী বলছেন
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
তিনি বলেন, “সংসদ নির্বাচনের আগে এখন অংশীজনদের বোঝাতে হবে, মানুষের কাছে যেন বার্তা যায়-কমিশন তাদের কঠোর অবস্থান ধরে রাখতে সমর্থ হবে সামনে।”
তা না হলে জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির ভোটও ছয় উপ নির্বাচনের মত হবে বলে ধরে নেবে মানুষ, মন্তব্য তার। এ থেকে বেরিয়ে আসতে নির্বাচন কমিশনেরও তেমন কিছু করার নেই বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিশ্লেষক বলেন, “অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে অমীমাংসিত বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। ইসিকে আইন-বিধি অনুযায়ী এ উদ্যোগে সহায়তা করতে হবে।”
বুধবার ভোট শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মাঠ প্রশাসনে ইসির নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আগামী সংসদ নির্বাচন অর্থবহ করার প্রত্যাশা রাখেন।
তিনি বলেন, “কাঙ্ক্ষিতমাত্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা না হলে ছয় উপ নির্বাচন নিরুত্তাপ হতে পারে। ভোটার উপস্থিতিও তুলনামুলক কম হয়েছে। প্রশাসনের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ, নির্ভর করতে হবে। আমরা আমাদের নিষ্ঠা, দক্ষতা, সততা এবং যে মনোবল সেটা দিয়ে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অর্থবহ ও ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করবো। আমাদের চেষ্টা, আমাদের প্রয়াস অব্যাহত থাকতে হবে।“
আরও পড়ুন:
ভোটের পরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আসিফের খোঁজ দিল পুলিশ
উপ নির্বাচনে ভোটার ৫% এর বেশি নয়, দাবি ফখরুলের
সরকার আমাকেও ভয় পায়, আশ্চর্য: হিরো আলম
হেরে গেলে এমনই বলে: হিরো আলমকে নিয়ে ইসি
১৫-৩০% ভোট পড়তে পারে, অনুমান সিইসির
সব দলকে ভোটে পাওয়ার আশায় আছি, ইইউকে সিইসি