ইসির এই পদক্ষেপ কি কঠোর অবস্থান দেখিয়ে আস্থা অর্জনের প্রয়াস, না কি একটি উপ-নির্বাচনেই ব্যর্থতার প্রকাশ?
Published : 13 Oct 2022, 01:45 AM
কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি নজিরবিহীন এক ঘটনায় একটি সংসদীয় আসনের গোটা নির্বাচনই স্থগিত করল।
সাত মাস বয়সী এই ইসির অধীনে এটাই ছিল কোনো সংসদীয় আসনের প্রথম নির্বাচন; আর সেখানেই তারা এই ঘটনা ঘটাল ঢাকায় থেকেই।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে বুধবার ভোটগ্রহণের মাঝপথে প্রথমে অর্ধশত কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করেছিল ইসি, এরপর পুরো নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানান সিইসি আউয়াল।
জাতীয় নির্বাচনের বছর খানেক আগে ইসির এই পদক্ষেপ কি কঠোর অবস্থান দেখিয়ে আস্থা অর্জনের প্রয়াস, না কি একটি উপ-নির্বাচনেই ব্যর্থতার প্রকাশ, তা নিয়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মহলে শুরু হয়েছে আলোচনা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন, এই ঘটনার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
নির্বাচন কমিশনে অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসা জেসমিন টুলীর চোখে, একটা নির্বাচন করতে না পারাটা সবার ব্যর্থতা।
“নির্বাচন বন্ধ করাটা সলিউশন না; ইলেকশন তুলে আনা হচ্ছে সলিউশন,” মন্তব্য করেন তিনি।
আবার নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমের মতে, অনিয়মের কারণে নির্বাচন বন্ধ করায় জনগণের কাছে ভালো বার্তাই যাবে। সবাই বুঝবে, ভোট ঠিকভাবে না হলে ইসি বন্ধ করে দেবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিএনপিবিহীন এই ভোটে অংশগ্রহণকারী জাতীয় পার্টি ইসির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে, গোলযোগহীন এই নির্বাচনে ভোট বন্ধ করার কারণ তাদের কাছে বোধগম্য নয়।
ডিসি-এসপিদের নিয়ে সভায় তাদের হৈ চৈয়ে ইসির বিব্রত হওয়ার মধ্যে এই নির্বাচন বন্ধ করার কারণ হিসেবে ভোটগ্রহণে অনিয়মের পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনে ‘চরম ব্যর্থতা’র কথাও বলেছে ইসি। এই ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা মূলত সরকারিই কর্মচারী।
চতুর্থ থেকে দশম সংসদ নির্বাচনে সম্পৃক্ত থাকা সাবেক ইসি কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জানান, একসঙ্গে পুরো সংসদীয় আসনের নির্বাচন ভোটের মাঝপথে বন্ধ করার নজির তার চোখে পড়েনি। আগেও এমন হয়েছে বলে তার জানা নেই।
গোপন কক্ষে ব্যাপক অনিয়ম, মাঝপথে বন্ধ হল গাইবান্ধার ভোটগ্রহণ
গাইবান্ধায় ভোট কেন স্থগিত হল, বুঝতে পারছেন না হানিফ
গাইবান্ধায় ভোট স্থগিতে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ, অন্যদের স্বস্তি
গোপন কক্ষের দুর্বৃত্ত ধরতে তৎপরতা, সিইসির ঘোষণা
ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যেতে চাওয়া বর্তমান ইসির আগে থেকেই দুর্ভাবনার বিষয় কেবল ছিল গোপন কক্ষে অবাঞ্ছিত ব্যক্তির উপস্থিতি।
গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনে গোপন কক্ষে অবৈধ লোকের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আগে থেকেই সতর্ক করেছিল নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি প্রতিটি ভোট কক্ষে বসানো হয় সিসি ক্যামেরা, তা আবার ঢাকায় নির্বাচন ভবনে বসেই তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
বুধবার সকাল ৮টায় ভোট শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে পরিদর্শন করে নির্বাচন কমিশনাররা।
সিইসি সকাল থেকে ভোটের পরিস্থিতি সিসি ক্যামেরায় দেখার বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন, “অনিয়ম যেটা দেখছিলাম– আমাদের সহকর্মীরা সকাল ৮টা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখেছি; কেউ কক্ষ ত্যাগ করেননি। তারা এটা প্রত্যক্ষ করেছেন যে অনিয়মগুলো মোটা দাগে হচ্ছিল।
“আমরা সবাই বসে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি, ভোট গ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেক কেন্দ্রে গোপন কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি।”
কী কী অনিয়ম নিজেদের চোখে দেখেছেন, সে কথা তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “অবৈধভাবে গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট দিতে সহায়তা বা বাধ্য করছে- এটা স্পষ্ট লক্ষ্য করা গেছে। যেটি নিয়ম নয়।.. গোপন কক্ষে অনধিকার প্রবেশ বা আইন ভঙ্গ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।”
তারপরেও আমরা দেখেছি, পোলিং এজেন্ট সম্ভবত তাদের অনেকের গায়ে যে পোশাক, সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি-ওড়না ছিল, যেটা নির্বাচন আচরণবিধির পরিপন্থি।”
নির্বাচনী এলাকার এক-তৃতীয়াংশ ভোট কেন্দ্রের ভেতরে পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ যাওয়ায় বেলা ২টায় বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্বাচন।
সিইসি বলেন, “নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আমরা পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি… সমগ্র নির্বাচনী এলাকা, গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। সে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে (রিটার্নিং কর্মকর্তাকে)।”
তবে অনিয়মে কারা জড়িত, তা জানতে তদন্ত করতে হবে বলে জানান তিনি।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা
জানিপপ চেয়ারম্যান কলিমুল্লাহ বলেন, “ভোট বন্ধের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এটাতে একটি পক্ষ মনে করবে এ ম্যাজিক দেখে বর্তমান ইসির ক্রেডিবিলিটি অর্জন হবে এবং এর উপর ভিত্তি করে বৈরী আচরণ যারা করছে, তারা সুড়সুড় করে চলে আসবে। আরেক পক্ষ রয়েছে- যারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিরোধী পক্ষ, যারা আজকের মতো এ ধরনের সঙ্কট হবে ভেবেছিল, তারা বলবে যে তাদের কথা প্রকটভাবে সঠিক হয়েছে।”
সার্বিকভাবে এটা নির্বাচন ব্যবস্থার ত্রুটি প্রকট করেছে বলে মনে করেন তিনি।
“গাইবান্ধা উপ-নির্বাচন আমাদের পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা যে ক্ষয়ে গেছে, খোলনলচে পাল্টানোর যে সময় এসেছে, তা প্রমাণ করে। যে কোনো মূল্যে জেতার যে প্রবণতা তা দেখা গেল।”
নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের ভিন্ন ভিন্ন মত আসায় তা আগামীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন কলিমুল্লাহ।
“এটা একটা বিশৃঙ্খলা। জেলা প্রশাসক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে-শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিল কেন বন্ধ করেছে। আবার রিটার্নিং অফিসার বন্ধ করেছে একটি কেন্দ্র, আর ৫০টি কেন্দ্র বন্ধ করেছে ইসি।”
সাম্প্রতিক মতবিনিময় সভায় নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের সঙ্গে ডিসি-এসপিদের যে হৈ চৈ হয়েছিল, তার প্রভাবও ভোটে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
“মাননীয় ইসির সঙ্গে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেটির একটি ফলাফল আজকে পাওয়া গেল।”
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলছেন, “এটা যেহেতু অনিয়মের প্রতিবাদে; এটা একটা ভালো উদ্যোগ। বন্ধ করায় জনগণের কাছে বার্তা যাবে- ইলেকশনে যদি অনিয়ম, জালিয়াতি হয় তাহলে নির্বাচন বন্ধ হতে পারে; ইসি ভোট বন্ধ করে। যারা প্রার্থী, দল তারাও সতর্ক হবে।”
গাইবান্ধার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “এভাবে চলতে থাকলে তো বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। ইসির নিজস্ব প্রশাসন নেই, পুলিশ নেই, আনসার নেই। কাজেই বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই।”
তিনি মনে করেন, একটা ছোট উপ-নির্বাচন হলেও তিনশ’ আসনের জাতীয় নির্বাচনে একই অবস্থা থাকবে না।
ইসির সঙ্গে ডিসি-এসপিদের বৈঠকে হৈ চৈ এর ঘটনা আগামী দিনে ভোটের জন্য তেমন প্রভাব না পড়লেও এখন থেকে নজর রাখতে হবে বলে মনে করেন আলীম।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়ায় আসল কাজ। কিন্তু নির্বাচন বন্ধ করে দিতে হল। একটি আসনের উপ নির্বাচন; সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল! এত আয়োজন, স্থানীয় প্রশাসন ছিল, আইন শৃঙ্খলাবাহিনী ছিল; সব কিছু করে বন্ধ করতে হলো। আসলে একটা নির্বাচন করতে না পারাটা সবার ব্যর্থতা।”
সাবেক ইসি কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ বলেন, যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় প্রিজাইডিং অফিসারই কেন্দ্রে ভোট বন্ধ করে দেয়। আরও বড় পরিসরে হলে রিটার্নিং কর্মকর্তা করে। কমিশন সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন অনিয়মের কারণে বন্ধ হলেও সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ হওয়ার নজির হল এবার।
নির্বাচন পরিচালনা শাখার এক কর্মকর্তা জানান, আরপিও এর ৯১ অনুচ্ছেদ নির্বাচন কাযক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন নতুন ভোটের তারিখ দেওয়া হবে শুধু। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রার্থীরাই থাকবে, শুধু ভোট হবে নতুন তারিখে।
৩০০ আসনে সিসি ক্যামেরা হবে?
সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলছেন, “আমরা ইতোমধ্যে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন ও কয়েকটি পৌরসভায় সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করেছি এবং আশানুরূপ ফল পেয়েছি। গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচনেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি। ফরিদপুর উপ-নির্বাচনেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।”
ভোটে অনিয়ম ও দুর্বৃত্তদের শনাক্তে সিসি ক্যামেরা ভূমিকা রাখছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সিসি ক্যামেরার ভূমিকা অন্যতম, এছাড়া ক্ষেত্র বিশেষে কর্মকর্তাদের পাঠানো মাঠ পর্যায়ের তথ্য, ইসির পর্যালোচনা, গণমাধ্যমের তথ্য-উপাত্তসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আইন-বিধি মেনে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।”
জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব বলেন, “সংসদ নির্বাচনের জন্য অনেক সময় বাকি। এব্যাপারে কমিশন পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবে।”
গাইবান্ধার উপ-নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র ছিল দেড়শর মতো। জাতীয় নির্বাচনে ৪০ হাজারেরও বেশি ভোট কেন্দ্র হবে, কয়েক লাখ ভোট কক্ষ থাকবে। এত কক্ষে সিসি ক্যামেরা বসানো এবং তার উপর নজর রাখা দৃশ্যত কঠিন বিষয় হবে।
আহসান হাবিব বলেন, “বাস্তবতা বিবেচনা করে দক্ষ লোকবল প্রাপ্তি, প্রযুক্তিগত সহায়তা, কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের সক্ষমতা, অর্থ বরাদ্দ, বিভিন্ন এলাকায় ব্যবহার সুবিধা-সব কিছুই দেখতে হবে। সময়ই বলে দেবে আমরা কি করতে পারব।”