গোপন কক্ষে ব্যাপক অনিয়ম, মাঝপথে বন্ধ হল গাইবান্ধার ভোটগ্রহণ

অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে একাধিক ব্যক্তির গোপন কক্ষে প্রবেশ, একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা সিসি ক্যামেরায় দেখার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2022, 08:41 AM
Updated : 12 Oct 2022, 08:41 AM

ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে যাওয়ায় গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

বুধবার সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর পর বেলা সোয়া ২টার দিকে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সামনে এসে এ ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কশিমনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, “নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ায় আমরা পরিশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি… সমগ্র নির্বাচনী এলাকা, গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকার ভোট কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি। সে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে (রিটার্নিং কর্মকর্তাকে)।

“ওখানে এখন আর ভোট হচ্ছে না। পরবর্তীতে বিধি বিধান অনুযায়ী কি করতে হবে দেখব। কমিশন বসে সিদ্ধান্ত নেব।”

কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই ছিল তাদের প্রথম সংসদীয় আসনের উপ নির্বাচন; ভোট শেষ হওয়ার আগেই তা বন্ধ করতে হল।

সিইসি বলেন, “এখানে মানবিক যে আচরণ তা দেখিয়ে দিচ্ছে, একই রঙের পোশাক পরে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এসব করছে। এটা সুশৃঙ্খল ভোটের পরিপন্থি। এরাই ডাকাত, এরাই দুর্বৃত্ত।

“যারা আইন মানেন না, তারা দুর্বৃত্ত। আমরা যদি সংস্কৃতি ডেভেলপ করতে না পারি, নির্বাচন কমিশন এখানে বসে বসে সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে? এটা সম্ভব না।”

Also Read: ভোটকেন্দ্রের ভেতরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে: সিইসি

Also Read: গাইবান্ধায় ৪৪ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত

Also Read: ভোট চলছে গাইবান্ধায়

ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এ আসনের ১৪৫ কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট চলার কথা ছিল বিকাল ৪টা পর্যন্ত। সবগুলো কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা বসিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল কেন্দ্রের পরিস্থিতি।

গোপন কক্ষে অবৈধভাবে একাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনা সরাসরি দেখার পর বেলা ১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় অর্ধশত কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। অনেক কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে সাংবাদিকদের জানান সিইসি।

বেলা ১২টার দিকে সাংবাদিকদের সামনে এসে সিইসি বলেন, “আমার কাছে মনে হচ্ছে, অবশ্যই ভোট কেন্দ্রের ভেতরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেছে। কিছু অনিয়ম… গোপন কক্ষে অনধিকার প্রবেশ বা আইন ভঙ্গ করে ভোট দিয়ে দিতে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি।”

এদিকে প্রায় তিন লাখ ৪০ হাজার ভোটারের এ আসনের এমপি হতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন পাঁচজন প্রার্থী। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া বাকিরা বেলা ১২টা বাজার আগেই একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

এমন পরিস্থিতিতে বেলা ২টার দিকে তিন নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীরকে নিয়ে বৈঠকে বসেন সিইসি। অপর নির্বাচন কশিমনার আনিছুর রহমান কমিশনে ছিলেন না।

ওই বৈঠকের পরই নির্বাচন ভবনে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে এসে ভোট বন্ধের ঘোষণা দেন সিইসি।

তিনি বলেন, “আমরা সবাই বসে ভোট পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি, ভোট গ্রহণে অনিয়ম হচ্ছে এবং অনেক কেন্দ্রে গোপন কক্ষে অবৈধ অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করেছি।”

কী কী অনিয়ম নিজেদের চোখে দেখেছেন, সে কথা তুলে ধরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “অবৈধভাবে গোপন কক্ষে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট দিসে সহায়তা বা বাধ্য করছে- এটা স্পষ্ট লক্ষ্য করা গেছে। যেটি নিয়ম নয়।

“তারপরেও আমরা দেখেছি, পোলিং এজেন্ট সম্ভবত তাদের অনেকের গায়ে যে পোশাক, সেখানে প্রতীক ছাপানো ছিল। মেয়েদের একই রকমের শাড়ি-ওড়না ছিল, যেটা নির্বাচন আচরণবিধির পরিপন্থি।”

সিইসি বলেন, “অনিয়ম যেটা দেখছিলাম– আমাদের সহকর্মীরা সকাল ৮টা থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেখেছি; কেউ কক্ষ ত্যাগ করেননি। তারা এটা প্রত্যক্ষ করেছেন যে অনিয়মগুলো মোটা দাগে হচ্ছিল।”

Also Read: গাইবান্ধায় ভোট কেন স্থগিত হল, বুঝতে পারছেন না হানিফ

Also Read: গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচন: আওয়ামী লীগ ছাড়া সব প্রার্থীর ভোট বর্জন

ঢাকার নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে সিসি ক্যামেরায় ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখতে দেখতে প্রথমে তিনটি কেন্দ্র, এরপরে ১৬টি কেন্দ্রে, তৃতীয় দফায় ১২টি; চতুর্থ দফায় নয়টি এবং তারপর আরও তিনটি– এভাবে মোট ৪৩টি ভোট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দিয়ে বেলা সাড়ে ১২টায় পর্যবক্ষণ কক্ষ ত্যাগ করেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও তারপরও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যান।

সিইসি বলেন, “আমরা লক্ষ্য করলাম- কতগুলো কেন্দ্রে সিসিটিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল। যার ফলে আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারছিলাম না। উনারা কিছু কিছু কেন্দ্রে আরও সাতটি মিলিয়ে- মোট ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করেছি। রিটার্নিং অফিসারও একটি কেন্দ্রের ভোট কেন্দ্র বন্ধ করেছেন।”

ভোটের এই চিত্র দেখার পর এ নির্বাচনের ভবিষ্যত নির্ধারণে বৈঠকে বসেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না, তাহলে যে কোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণ বা নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে।

সিইসি বলেন, “আমরা কমিশনের সব সদস্য মিলে বিষয়টি পর্যালোচনা করলাম, বিশ্লেষণ করলাম। আমরা নিশ্চিত হলাম, ৫০টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ হয়ে গেলে বাকি কেন্দ্রগুলোর পরিবেশ, ফলাফল-সব বিবেচনা করলেও আসলে সঠিক মূল্যায়নটা হবে না। তাতে কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয় যে ভোট বন্ধের মত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে।”

কমিশনের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমাদের কাছে মনে হয়েছে, ভোটগ্রহণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, একটি পক্ষ বা একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভাবিত করতে পারছে। আমাদের দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হচ্ছে না। ৫১টি ভোট কেন্দ্র বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আইন কানুন পযালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, ৯১ অনুচ্ছেদে যে দায়িত্ব ইসিকে দেওয়া হয়েছে, ইসির কাছে এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে নির্বাচন সঠিকভাবে হচ্ছে না। যে কোনো কেন্দ্রে বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট কমিশন বন্ধ করে দিতে পারবে।”

ইসির ওই সিদ্ধান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়ে ভোট বন্ধের নির্দেশ দেন সিইসি। পরবর্তী করণীয়, প্রার্থিতা বাতিল, ভোটের নতুন তারিখ নির্ধারণ বা নতুন করে তফসিল ঘোষণার বিষয়গুলো আলোচনা করে পরে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেন তিনি।

এ অভিজ্ঞতা আগামীতে কাজে লাগনোর প্রত্যয় জানিয়ে সিইসি বলেন, “এটা নিয়ে আমরা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারব এবং আগামীর দিক নির্দেশনা পাব। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ইভিএম কাজ করছে না– এরকমটা তারা মনে করেন না। পরিস্থিতি প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।

অনিয়মের সঙ্গে কারা জড়িত জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “তদন্ত ছাড়া, অনুসন্ধান ছাড়া বলা যাবে না। কাদের কারণে হয়েছে এখনও সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।”

গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজী হাবিবুল আউয়ালের কমিশন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের আট শতাধিক নির্বাচন করেছে।

নির্বাচনী সহিংসতা বা অনিয়মের কারণে এক বা একাধিক কেন্দ্রের ভোট বাতিলের ঘটনা বহুবারই ঘটেছে। তবে পুরো নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের নজির খুব বেশি নেই।  

সবশেষ কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১৫ সালে নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার ভোট বাতিল করেছিল।