সবাইকে চিকিৎসা দিতে পারলেও ভর্তি নিয়ে টানাটানি; এমনকি খালি সব জায়গায় বিছানা পেতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
Published : 09 Aug 2023, 09:26 AM
রাত ১১টার দিকে মো. সাগরকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার মা হাজেরা বেগম। বললেন, ওই সময় জ্বর আরও বাড়লে তাকে আর বাসায় রাখার মতো অবস্থা ছিল না; অস্থির লাগছিল, বমি হচ্ছিল।
বাধ্য হয়ে কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ থেকে রোববার রাতের ওই সময়ে ২০ বছর বয়সী সাগরকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে আসেন মা হাজেরা। আগেই পরীক্ষা করানোতে ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে তা জানতেন। তখন অবস্থা ভালো ছিল দেখে বাসাতেই ছিলেন। তবে চার থেকে পাঁচ দিন ভোগার পর রোববার রাতের বেলা হুট করে অস্থিরতা শুরু হলে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালেই ছুটে এসেছেন।
সোমবার দুপুরে হাসপাতালে ঢোকার মুখে কলাপসিবল গেইটের কাছে ছেলের বিছানার কাছে বসা হাজেরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তাদের হাসপাতালে আসা ও জায়গা পাওয়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, “জরুরি বিভাগে আনার পর চিকিৎসক সাগরকে পরীক্ষা করে ও কাগজপত্র দেখে বলেন, ‘মেডিসিন বিভাগে গিয়ে দেখেন তো কোথাও বিছানা পাতার মতো জায়গা আছে কি না বা পান কি না। যদি পান তাহলে রোগীকে ভর্তি দিয়ে দিব। স্যালাইন দিলে রোগী সুস্থ হয়ে উঠবে'।“
চিন্তিত মা তখন মেডিসিন ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখেন রোগী আর রোগী, ভেতরে ঢোকার মতই জায়গা নাই- বিছানা পেতে রোগী রাখা তো দূরের কথা। পরে ভবনে ঢোকার কলাপসিবল গেইটের বাইরে দেখেন তিনজন রোগী আছেন। কথা বলে দেখলেন তারাও ডেঙ্গু রোগী। ভেতরে সিট না থাকায় সেখানেই শয্যা পেতেছেন। তিনিও সেখানে ছেলের জন্য সঙ্গে নিয়ে আসা বিছানা পাতলেন।
হাজেরা বলেন, “পরে জরুরি বিভাগে গিয়ে বললাম স্যার একটি জায়গা পেয়েছি ভর্তি দেন। সেই থেকে স্যালাইন চলছে। এখন ভালা আছে। বাসায় অস্থির করছিল, বমি আসছিল, কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছিল না।“
সাগরের মতো ঢাকার ওই অংশের কাছে-দূরের শত শত রোগী জ্বর নিয়ে এসে ভর্তি হয়েছেন মিটফোর্ডের এ হাসপাতালে। সিট না পাওয়ায় বারান্দায়, সিঁড়ির কাছে- যে যার মতো বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ উন নবী বললেন, জ্বর নিয়েই বেশি রোগী আসছেন এখন। যাদের দরকার তাদের তো ভর্তি করা হচ্ছে। আবার অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর বাসায় যাওয়ার উপযোগী হলেও যেতে চাচ্ছেন না, তখন বাধ্য হয়ে তাদের ভর্তি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, ৯০০ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছেন এক হাজার ৩৬০ জন। এদের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন ৩০৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টাতেই ভর্তি হয়েছেন ১০৯ জন। এ বছর এ পর্যন্ত তিন হাজার ২৪৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যুও হয়েছে।
সীমিত জনবল ও চিকিৎসক দিয়েই রোগীর এ বিশাল চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
সবাই কী ব্যস্ত ডেঙ্গুতে?
পুরান ঢাকার এ দিকটার সবচেয়ে বড় মিটফোর্ড হাসপাতাল নামে পরিচিত এ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখা গেল, ডেঙ্গু রোগীর চাপ থাকলেও আরও হাজার খানেক রোগী ভর্তি রয়েছেন। বর্হিবিভাগের পাশাপাশি জরুরি বিভাগেও রোগীর লাইন লম্বা। শুধু জ্বর নয়, সব ধরনের সমস্যা নিয়ে রোগীরা আসছেন।
সহকারী অধ্যাপক মো. জাবেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মিটফোর্ডে দিনে সাধারণ অস্ত্রোপচার হয় গড়ে ১২টি এবং সব বিভাগ মিলে অন্তত ৫০টি। এসময়ে ডেঙ্গু রোগী অগ্রাধিকার পেলেও অন্যান্য বিভাগের চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে।
হাসপাতাল পরিচালক জানান, বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ৩৫৬ জন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন হাসপাতালে। নার্স রয়েছেন ৭০৩ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী মিলে মোট জনবল এক হাজার ৩৭৯ জন।
চিকিৎসা দিতে পারছি, তবে সিটের টানাটানি
পরিচালক কাজী রশিদ বলেন, ৯০০ শয্যার হাসপাতালে গড়ে এক হাজার চারশত রোগী ভর্তি রয়েছেন। বর্তমান জনবল দিয়ে কষ্ট হলেও তারা সবার চিকিৎসা দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারলেও সবার ভর্তির জন্য সিটের ব্যবস্থা করতে পারছেন না। এমনকি খালি সব জায়গায় বিছানা পেতেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
ঝাড়ু দেওয়ার মত জায়গাও নেই
হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার বিল্লাল হোসেন বলেন, মূল ভবনের সাত তলায় জ্বরে আক্রান্ত শিশু আসলে ভর্তি দেওয়া হয়। এখন ভর্তি হতে হতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে ঝাড়ুদার ঠিকঠাক ঝাড়ুও দিতে পারছেন না। শুধু বিছানার চাদর বদলে দিয়ে কোনো রকমে চলছে চিকিৎসা সেবা।
বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে তার কথার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দা ছাপিয়ে চিকিৎসকের কক্ষের সামনের দরজাতেও বিছানা পেতে রোগীদের থাকতে দেখা গেছে।
ডেঙ্গু সমন্বয়ে সেল
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এ হাসপাতালে ডেঙ্গু সমন্বয় সেল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের এ সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জাবেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মিটফোর্ডে ১৪ অগাস্ট এটি কাজ শুরু করবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় গতি ও সমন্বয়ে ইতোমধ্যে মুগদা ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এমন সেল চালু করা হয়েছে। প্রতিটি ডেঙ্গু সমন্বয় সেলে পাঁচজন চিকিৎসক ও তিনজন নার্স থাকছেন।
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গু: জ্বর হলেই গন্তব্য হাসপাতাল, তবে সোহরাওয়ার্দীতে ভর্তি লাগছে না অনেকের
ডেঙ্গু: চাপ বাড়ছে শিশু হাসপাতালে, ‘গুরুতর’ রোগীও আসছে
ডেঙ্গু: রোগীরা ছুটছে রাজধানীতে, হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৩০০ ছাড়াল, এক বছরে সর্বোচ্চ
এ বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ৬০ হাজার ছাড়াল
ডেঙ্গু: ভয়ঙ্কর জুলাই মৃত্যু নিল ২৫১ জনে, রোগী ছাড়াল ৫১ হাজার