উপসর্গ জটিল হলে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই রোগীকে ভর্তি করা হয়; অন্যদের অবস্থা যাচাই করে ব্যবস্থাপত্রসহ পরামর্শ দেওয়া হয়, জানান পরিচালক।
Published : 07 Aug 2023, 11:31 AM
দুই দিন ধরে জ্বরে ভোগা লাল মিয়া ডেঙ্গু সন্দেহে ছুটে এসেছিলেন ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসক তাকে দেখার পর সরকারি সরবরাহের প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট ও স্যালাইন দিয়ে বিদায় করে দেন।
রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে হাসপাতালের গেইটে দেখা হওয়ার পর পঞ্চাশোর্ধ ভ্রাম্যমাণ পণ্য বিক্রেতা লাল মিয়া জানালেন, স্বজনের পরামর্শেই ডেঙ্গুর ভয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে। তার ধারণা ছিল চিকিৎসক ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য বলবেন। সব শোনার পর ব্যবস্থাপত্রে তেমন কোনো পরামর্শ লিখে না দেওয়ায় বাসায় ফিরে যাচ্ছেন ঢাকার শেখের টেকের এ বাসিন্দা।
একই দিন ১৫ বছরের এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে এসেছিলেন তার মা নাসরিন বেগম। তিন দিন ধরে জ্বরে ভুগছে তার ছেলে। রোগীকে পরীক্ষা করে চিকিৎসক ডেঙ্গু পরীক্ষা করে আবার আসার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানালেন নাসরিন।
এর কিছুটা পরই কথা হয় ইসমাইল নামে ৩০ বছর বয়সী এক যুবকের সঙ্গে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, তিন আগে ডেঙ্গু ধরা পড়লে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। জ্বর না কমায় এবং পেট ব্যাথার সঙ্গে ফুলে যাওয়ায় তিনি হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসক দেখেই তাকে ভর্তি করিয়ে নেন।
ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালের মতো জ্বর নিয়ে রোগী আসার চাপ বাড়ছে মিরপুর রোডে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের দেখা পেতে যেমন দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তেমনি পরীক্ষার জন্য লাগছে লম্বা সময়।
পরীক্ষার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষাকে হয়রানি হিসেবেই দেখছেন রোগী ও তার স্বজনরা। তাদেরই একজন পরিবহন শ্রমিক নুরুজ্জামান। চল্লিশোর্ধ এ ব্যক্তি পাঁচ দিনের জ্বর নিয়ে গত শনিবার মিরপুর থেকে এ হাসপাতালে এসেছিলেন চিকিৎসা নিতে।
চিকিৎসককে দেখানো এবং রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে তাকে কতটা পেরেসানির মধ্যে যেতে হয়েছে সেই বর্ণনা রোববার দেন তিনি এভাবে।
তার ভাষ্য, “টিকিট নেওয়ার ঘণ্টাখানেক পর চিকিৎসকের দেখা মেলে। চিকিৎসাপত্রে ডেঙ্গু এবং রক্তের আরেকটি পরীক্ষার পরামর্শ লিখে দেন তিনি। এরপর পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দিতে দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। রক্ত দেওয়ার জায়গাতেও বিশাল লাইন। লাইনের শেষে যখন কাউন্টারে গেলাম বেলা একটার দিকে তখন বলা হল আড়াইটায় রক্ত নেওয়া হবে।
“আরও দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর তারা শুধু ডেঙ্গুর রক্ত নিল এবং অন্য পরীক্ষার জন্য রোববার আসতে বললো। তখন ডেঙ্গুর রিপোর্ট দিবে বলেও জানায়।”
পরদিন ‘নেগেটিভ’ সিল মারা ডেঙ্গুর রিপোর্ট দেখিয়ে নুরুজজ্জামান জানালেন, তিনি এখন স্বস্তি পাচ্ছেন। জানালেন বেশ আতঙ্কে কেটেছে তার এই কয়টা দিন।
হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমানের কাছে এসব রোগীর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, এখন জ্বর হলেই সবাই ডেঙ্গু আতঙ্কে হাসপাতালে ছুটে আসছেন। রোগীর অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
“যারা আসছেন তাদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগীর ভর্তি লাগে না। আমরা তাদের পরামর্শ দিয়ে বাসায় থাকতে বলি।”
লাল মিয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাকে কেন ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়নি সেটা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের স্বাধীনতা। তিনি রোগীর সঙ্গে কথা বলে হয়তো এর প্রয়োজন মনে করেননি।
দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়ানো, রিপোর্ট দেরিতে দেওয়ার বিষয়ে পরিচালক বললেন, প্রতিদিন জ্বর নিয়ে শত শত রোগী আসছেন। এটা একটা বড় ধরনের চাপ। নিয়মিত কর্মী দিয়েই তাদের সামাল দেওয়ার কারণেই এ বিলম্ব।
ডেঙ্গু শনাক্তের পর অবস্থা জটিল হলে কিংবা প্লাটিলেট নামতে থাকে, রোগীর বমি হয়- এমন উপসর্গ থাকলে রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে দেন বলে জানালেন পরিচালক।
এ হাসপাতালে গত ছয় মাসে ডেঙ্গু রোগী গড় হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর এ প্রাদুর্ভাবের আগে থেকে তারা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। সবশেষ শনিবার একজন রোগী মারা গেছেন যা নিয়ে এসময়ে মোট তিনজন মারা গেলেন।
জরুরি বিভাগে একের পর এক জ্বরের রোগী
গত শুক্রবার রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা যায় জ্বর নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন বয়সের লোকজন আসছ্নে। তিনজন চিকিৎসক বেশ হিমশিম খাচ্ছেন তাদের ব্যবস্থাপত্র দিতে। দিনে-রাতের বড় সময় জুড়েই রোগী আসছেন ঢাকার এ অংশের বড় এ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আতঙ্কে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি রোগী আসছে জ্বর নিয়েই।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নাম প্রকাশ না করে এক নারী চিকিৎসক জানান, এখানে যারা আসছেন তাদের প্রত্যেকের ভর্তির প্রয়োজন হয় না। রোগীর অবস্থা দেখে ভর্তি বা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
রোববার জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তির পরামর্শ দেওয়ার পর হাসপাতালের ছয় তলায় ৬৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয় ইসমাইলকে। ওই ওয়ার্ডে সিট না থাকায় মেঝেতে রাখা হয় থাকে। অথচ পাশে সিট খালি থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হাসপাতালের কর্মী নাসিম আকতার জানালেন, খালি সিটগুলো ‘পেয়িং বেড’। পাশের ওয়ার্ডে সিট খালি আছে তাকে সেখানে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পর হাসপাতালে অনেকগুলো বিভাগে এইডিস মশাবাহী এ রোগে আক্রান্তদের রাখা হচ্ছে। নতুন ভবনের ছয় তলার পূর্ব দিকে নিউরোলজি বিভাগে ডেঙ্গু ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। নিচের পাঁচ তলায় গত ৩০ জুলাই আরেকটি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে।
এ হাসপাতালে ছয়টি মেডিসিন ওয়ার্ড আছে। ডেঙ্গু রোগীদের এগুলোর অধীনেই ভর্তি করা হচ্ছে। তবে পৃথক ওয়ার্ডও আছে ডেঙ্গু রোগীর জন্য।
এসব ওয়ার্ডে থাকা রোগীদের স্বজনরা চিকিৎসা বা ওয়ার্ডে জায়গা পাওয়া নিয়ে তেমন অভিযোগ না করলেও অনেকে নোংরা বাথরুম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বাথরুমগুলোতে ঘুরেও তাদের কথার মিল পাওয়া যায়।
রোববার দুপুরে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন গর্ণপূর্ত বিভাগের একজন প্রকৌশলী। পরিচালককে হাসপাতালের বাথরুমের করুণ অবস্থার কথা জানালে তিনি দ্রুত কযেকজনকে ডেকে পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। এসময় ওই প্রকৌশলীকেও ফোনে কাউকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে দেখা যায়।
পরিচালক খলিলুর জানান, হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য ৩০০ আসনের ব্যবস্থা রয়েছে। রোববার দুপুর পর্যন্ত ২৫৭ জন ভর্তি আছেন। ভর্তি যোগ্য কোনো রোগীকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। রোগী বাড়লেও চেষ্টা থাকে যেন মেঝেতে কাউকে থাকতে না হয়।
তিনি জানান, ডেঙ্গুর জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডে বিছানা না থাকলে মেডিসিন বিভাগের অন্য ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ডেঙ্গু: চাপ বাড়ছে শিশু হাসপাতালে, ‘গুরুতর’ রোগীও আসছে
ডেঙ্গু: রোগীরা ছুটছে রাজধানীতে, হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৩০০ ছাড়াল, এক বছরে সর্বোচ্চ
এ বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ৬০ হাজার ছাড়াল
ডেঙ্গুর টিকা তৈরির উদ্যোগ নেবে বিএসএমএমইউ
ডেঙ্গু: ভয়ঙ্কর জুলাই মৃত্যু নিল ২৫১ জনে, রোগী ছাড়াল ৫১ হাজার