ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০০ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭৭ নম্বর বেডে শুয়ে থাকা হালিমাকে 'কেমন আছেন' জিজ্ঞেস করলে উত্তর মেলে ‘ভালো আছি’। এরপর আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকেন।
Published : 17 Jul 2021, 09:20 PM
এই কিশোরীর হয়েই যেন পরে সব কথা বললেন মা সাহানা আক্তার। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারখানার দ্বিতীয় তলায় কাজ করত হালিমা। আগুন লাগার পর দোতলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে মাথায় ও মুখে আঘাত পেয়েছিল। প্রথম তিন দিন কোনো কথা না বললেও পরে কথা বলতে পারছে সে।
“প্রথমদিন তো মাইয়ার চেহারাই চিনতে পারি নাই আমরা। দুইডা চোখই অস্বাভাবিক ফোলা আছিল। এখন আল্লাহর রহমতে ডান চোখটা ভালো হইলেও বাম চোখটা খুলতে পারে না।"
১৩ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত সাহানা বলেন, "ডাক্তার কইছে তিনমাস টানা ওষুধ খাইতে। এরপর হালিমা সুস্থ হইব।”
গত ৮ জুলাই বিকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডসের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্বিতীয় তলায় কাজ করছিলেন হালিমা।
আগুন বাড়তে থাকলে উপায় না দেখে দোতলা থেকে লাফ দেন। গুরুতর আহত অবস্থায় অচেতন এই কিশোরীকে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়।
তিন দিন পর তার জ্ঞান ফেরে। প্রথমে কাউকে চিনতে না পারলেও এখন মা-বাবাসহ স্বজনদের চিনতে পারছেন বলে জানালেন তার মা।
এর আগেই বিভীষিকা ছড়িয়ে কেড়ে নেয় অর্ধশতাধিক প্রাণ। আহতের সংখ্যাও ছিল অর্ধশতাধিকের বেশি।
ভয়াল ওই অগ্নিকাণ্ডে রাতেই ঢাকা মেডিকেলে আনার পর মারা যান তিন জন। পরদিন পুড়ে প্রায় অঙ্গার হয়ে যাওয়া ৪৮ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস যাদের কাউকেই শনাক্ত করা যায়নি।
ওই ঘটনায় আহতদের মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মী ও শ্রমিককে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছয় জনকে ভর্তি করা হয়, যাদের মধ্য তিন জন ছাড়া পেলেও বাকিরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, “রূপগঞ্জের আগুনের ঘটনায় তিন জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাদের অবস্থা উন্নতির দিকে।“
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, অন্যদিকে কারখানার অদূরে রূপগঞ্জে ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আহতদের অনেককে নিয়ে যাওয়া হয় তাৎক্ষণিকভাবে। সেখানে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ১২ জন। দু’এক দিন আগে তারা সবাই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন।
সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন তিন নারীই কারখানার দ্বিতীয় তলায় কাজ করছিলেন। তাদেরই একজন হলেন হালিমা।
তার মা রূপগঞ্জেরই আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। হালিমার বড় বোন সাদিয়াও হাসেম ফুডসে কাজ করেন। সেদিন তার ডিউটি রাতে থাকায় বেঁচে গেছেন।
অভাবের সংসারে বড় মেয়ে সাদিয়াকে অষ্টম শ্রেণি এবং মেজ মেয়ে হালিমাকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়ে কাজে পাঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায়।
মাত্র চার মাস আগে সাড়ে ৫ হাজার টাকা বেতনে হালিমা কাজ শুরু করেন।
সাহানা বলেন, "ইচ্ছা ছিল নিজেগো একটা ঘর বানামু। তাই পোলাপানগুলারে কাজে দিছিলাম।"
হালিমার বাবা সাইদুর রহমান কাজ করেন রূপগঞ্জের একটি সুতা কারখানায়৷ তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের পালগাঁওয়ে।
চিকিৎসায় সহায়তার বিষয়ে সাইদুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সরকার সাহায্য দিছে। কিন্তু সেটা রোগীর নামে। টাকা উঠাইতে গেলে হালিমার সই লাগব। ওর নামে ব্যাংক একাউন্ট লাগব। এখন তো সেটা সম্ভব না।
তাই যেমন পারতেছি জোগাড় কইরা মাইয়ার চিকিৎসার খরচ দিতেছি। এই পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হইয়া গেছে।"
সেদিনের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আমেনা বেগম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আগুন লাগার পর সবাই যখন ছোটাছুটি করতাছে- আমাগো ফ্লোরের এক বড় স্যাররে কইলাম ‘স্যার আমাগো বাঁচান’। তিনি কিছু করতে পারেন নাই।
“ওনারে একটা গাড়ি আইসা (ফর্ক লিফট) নিয়া গেল। আমাগোরে আর নিল না। পরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আইসা আমাগোরে দোতলা থেকে নামাইল। সেসময় লাফ দিয়া আমি নিচে পইড়া গেলাম।"
দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আমেনার ডান হাত এবং কোমড়ের হাড় ভেঙ্গে যায়।
তার ভাতিজা রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "চাচীর শরীর বেশি ভালো না। ভর্তি তিনজনের মধ্যে উনিই বেশি আহত হইছেন। ডাক্তার এক্সরে আর সিটিস্ক্যান করতে দিছেন, শরীর একটু ভালো হইলে অপারেশন করবে বলে জানাইছেন।"
আমেনার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের সদরে। তার স্বামী আজাদ ও মা অনুফা বেগমও হাসপাতালে তার সঙ্গে আছেন।
আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ঘটনার পর আমেনারে ভর্তি করানোর সময় ৪০ হাজার টাকা নিয়া আসছিলাম। এখন আর ১০ হাজার টাকা আছে।
“খরচ চালাইতে হিমশিম খাইতেসি। প্রতিদিন এক হাজার টাকার উপরে খরচ। তাও আল্লাহর কাছে শুকরিয়া এতবড় একটা ঘটনার পরও আমার স্ত্রী বাঁইচ্চা আছে।"
একই কেবিনে চিকিৎসাধীন মাজেদা বেগমও দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়েন। এতে তার চোয়ালে এবং সারা শরীরে গুরুতর আঘাত পান। দাঁত ভেঙ্গেছে চারটি।
মাজেদার বাড়ি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জে। তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের নতুন বাজার এলাকায় থাকেন। কিছুদিন আগে বিবাহ বিচ্ছেদের পর আরেকটি বিয়ে করে তার স্বামী শফিক।
মাজেদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "চার বাচ্চা নিয়া সংসার চালানো কঠিন ছিল। তাই ৫ হাজার ৬০০ টাকা বেতনে ওই কারখানায় কাজ নেই।
“ঘটনার পর বাচ্চাগুলারে নিয়া আমার ফুপু কারখানার এক অফিসারের কাছে গিয়া বেতন চাইলে তারা বেতন দেয় নাই। এখন অগো খাওয়ামু কী, আর আমার চিকিৎসাই করুম ক্যাম্নে।"