রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালক এবং একজন সহকারীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত; খালাস পেয়েছেন এক বাসের মালিকসহ দুইজন।
Published : 01 Dec 2019, 02:43 PM
বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই দুর্ঘটনার দেড় বছরের মাথায় রোববার ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ের র্পবেক্ষণে তিনি বলেন, “দেশের পরিবহন সেক্টরে ড্রাইভার হেলপারদের খামখেয়ালিপনায় মানুষ হত্যা নেশায় পরিণত হয়েছে। যা বন্ধ হওয়া আবশ্যক।”
দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় ‘অপরাধজনক প্রাণনাশের’ দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বাস চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং হেলপার কাজী আসাদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ধারায় এটাই সর্বোচ্চ সাজা।
দণ্ডিত এই তিন আসামির মধ্যে পলাতক কাজী আসাদ বাদে বাকি দুজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
জাবালে নূরের একটি বাসের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও হেলপার এনায়েত হোসেনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।
ওই পরিবহন কোম্পানির আরেক বাসের মালিক শাহাদাত হোসেনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “ড্রাইভার ও হেলপার ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুইজনকে হত্যা করেছে। এটা গর্হিত কাজ। এই ধারায় সর্বোচ্চ যে শাস্তি তাই হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে বার্তাটি হল- বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কোনোভাবে পার পাওয়া যাবে না।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মো. হাসিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসামি মাসুম বিল্লাহ যে সময়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে মামলার কাগজপত্রে বলা হয়েছে, সে সময়ে তিনি মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে ছিলেন বলে সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে। ওই ঘটনায় কোনো ময়নাতদন্তও হয়নি। সুতরাং নিরেপেক্ষভাবে রায় দেওয়া হলে আমার মক্কেল খালাস পেতেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
সেই দুর্ঘটনায় নিহত দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন দূরপাল্লার বাসচালক। তবে রায় শুনতে তিনি আদালতে আসেননি।
দিয়ার মা রোকসানা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত রায় দিয়েছে, শুনে আমি খুশি হয়েছি। আমার মেয়েকেতো ফিরে পাব না। রায়ের মাধ্যমে কিছুটা হলেও শান্তি পাবে আমার মেয়ের আত্মা।”
রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তির ঘোষণার পর আসামি মাসুম বিল্লাহকে কাঠগড়ায় কাঁদতে দেখা যায়। সাজাপ্রাপ্ত বাকি দুই আসামিও ছিলেন বিমর্ষ।
চালক মাসুম বিল্লাহর বাসটি গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের উপরে উঠে গেলে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও দ্বাদশ শ্রেণির আবদুল করিম রাজীব নিহত হয়; আহত হয় আরও কয়েকজন।
দিয়া ও রাজীবের মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে এক সপ্তাহ অচল থাকে ঢাকার সড়ক, আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলায়। শিক্ষার্থীদের সব দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে হয় সরকারকে।
শিক্ষার্থীদের দাবিতেই সংসদে পাস হয় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইন, যা গত ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে।
এই মামলার বিচারকে ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলার আরেকটা মাইলফলক’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সড়ক পরিবহন আইন এবং মামলার রায়, দুটোই সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
“আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য সড়ককে নিরাপদ করা এবং সড়ক পরিবহণ আইনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করা।”
এই মামলাটি দ্রুততার সঙ্গে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী বলেন, “মামলার পেপারবুক তৈরি হওয়ামাত্র উচ্চ আদালতে শুনানির তালিকায় আনার চেষ্টা করা হবে।”
রায়ে বিচারক বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলায়। তবে ঘটনা ঘটার পর ২৭৯ ধারায় শাস্তি দেওয়ার আর সুযোগ নেই।
৩০৪ ধারার অভিযোগ ছিল- ঢাকার জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় আসামি জুবায়ের সুমনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে মাসুম বিল্লাহ রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর বাস তুলে দেয়।
“এই দুজন যেহেতু নিয়মিত গাড়ি চালাতো, তাই তারা জানতো যে ফ্লাইওভার থেকে নামার ঢালটি বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখান থেকে নামতে গিয়ে মাসুম বিল্লাহর গাড়ি ফ্লাইওভারের পাশে রেলিংয়ে দুবার ধাক্কা খায়।
“ওই গাড়ির হেলপার এনায়েত ও গাড়ির যাত্রীরা বারবার মাসুম বিল্লাহকে সাবধান করে এবং ধীরে গাড়ি চালাতে অনুরোধ করে। কিন্তু বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়।”
রায়ে বলা হয়, “৩০৪ ধারা অনুযায়ী হত্যা নয়, কিন্তু অপরাধজনক প্রাণনাশের মত জখমের বিষয় থাকতে হবে। রাজীবের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়া সেরকম জখমেরই প্রমাণ। তাই দুই চালক মাসুম বিল্লাহ, জুবায়ের সুমন এবং সুমনের গাড়ির হেলপার আসাদ কাজীকে এই ধারার অধীনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল।”
বিচারক বলেন, মাসুম বিল্লাহর গাড়ির হেলপার এনায়েতের বেপরোয়া গতির বিষয়ে চালককে সতর্ক করেছিলেন। তিনি কোনো অপরাধ করেননি, তাই তাকে খালাস দেওয়া হল।
আর গাড়ির মালিক জাহাঙ্গীর আলম হাল্কা গাড়ির লাইসেন্সধারী চালককে ভারী বাহন চালাতে দিয়ে অপরাধ করলেও তার অপরাধ এই ধারায় আওতাভুক্ত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছেন বিচারক।
অপর আসামি গাড়ির মালিক শাহাদাতের মামলার অংশ হাই কোর্টে স্থগিত থাকায় তার ব্যাপারে রায়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি।
নিয়ম না মানার প্রবণতায় সড়কে বিশৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা উঠে এসেছে এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে।
বিচারক বলেন, “পরিবহন সেক্টরের ড্রাইভার, হেলপারদের খামখেয়ালিপনা ও উদাসীনতায় কি ছাত্রছাত্রী, কি যুবক, কি বয়স্ক ব্যক্তি কেউই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে জীবন বিনষ্ট হওয়া থেকে রেহাই পায় না।”
ওই ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে বিচারক বলেন, “রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই জন মেধাবী উদীয়মান ছাত্রছাত্রী নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়। দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীবের ঘনিষ্ঠরা, সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রী সেদিন রাস্তায় নেমে আসে। গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপারের খামখেয়ালিপনায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়ীদের বিচার চাইতে তারা কুণ্ঠাবোধ করেনি।
“পরিবহন সেক্টরের অধিক ভাড়া উপার্জনের জন্য মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে হেভি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স বিআরটিএ কর্তৃক অনুমোদন না করা সত্ত্বেও ভারী গাড়ি চালিয়ে যত্রতত্র মানুষের উপর তুলে দিয়ে হত্যা করে চলছে। এ যেন দেশের পরিবহন সেক্টরের ড্রাইভার হেলপারদের খামখেয়ালিপনায় মানুষ হত্যা নেশায় পরিণত হয়েছে। যা বন্ধ হওয়া আবশ্যক।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বেশি লাভের জন্য গাড়ির মালিক চালকদের কাছ থেকে বেশি টাকা জমার নিয়ম বেঁধে দেওয়ার ফলে চালক ও তাদের সহকারীরা বিভিন্ন বাস স্টপেজে অবৈধ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ফলে প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা ও জীবনহানি ঘটছে।
“এক্ষেত্রে পরিবহন মালিকের অধিক টাকা উপার্জনের মানসিকতা পরিহার করা যেমন আবশ্যক, তেমনি রাস্তায় নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সদস্যগণ নিয়মিত ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করলে হালকা লাইসেন্স দিয়ে ভারী যান চালানোর সুযোগ থাকত না।
“মালিকপক্ষ হালকা যানবাহন চালকদের কম বেতন দিয়ে ভারী যান চালানোর কাজে নিয়োজিত করেন। ফলে ড্রাইভাররা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ভারী গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এক্ষেত্রে মালিকদের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চালকদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।”
সাংবাদিকদের উদ্দেশে বিচারক বলেন, “সংবাদ এমনভাবে প্রচার করবেন না যাতে ছাত্রসমাজ বা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় বা মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়। এই মামলায় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় আসামিদের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এই ধারার সর্বোচ্চ শাস্তিই যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সেটি আগে উল্লেখ করার অনুরোধ করছি। এই ধারায় এর চেয়ে বেশি দণ্ড দেয়ার সুযোগ ছিল না।”
দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন চালিয়ে আসায় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রশংসা করেন বিচারক।
তিনি বলেন, “ইলিয়াস কাঞ্চন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সমাজে দৃষ্ঠান্তমূলক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তেমনি আমাদেরও নিরাপদ সড়কের জন্য নিজ নিজ জায়গা থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।”
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুর্ঘটনার দিনই ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম।
ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে বলা হয়, কালশী ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে জাবালে নূরের দুটি বাস পাল্লা দেওয়ার সময় একটি এমইএস বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীদের উপর উঠে যায়। চালক মাসুম বিল্লাহ গাড়ি চালাচ্ছিলেন বেপরোয়া গতিতে। যাত্রীরা সাবধান করলেও তাদের কথা তিনি কানে তোলেননি।
তদন্তে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের বাসের ফিটনেসের মেয়াদ দুই বছর আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। ট্যাক্স টোকেনেরও মেয়াদ ছিল না। শাহাদাতের বাসের রুট পারমিটই ছিল না।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয় অভিযোগপত্রে। ওই বছরের ২৫ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে গিয়েছিলেন জাবালে নূরের মালিক শাহাদাত হোসেন। তার পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ আসে। বাকি পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম চলে।
অভিযোগপত্রের ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন আদালতে এসে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। কারাগারে থাকা চার আসামি গত ৭ অক্টোবর নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৪ নভেম্বর বিচারক রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারণ করে দেন।
পুরনো খবর