সড়ক শৃঙ্খলা আনুন: আকুতি দিয়ার বাবার

সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী চালকের শাস্তির পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকায় বাসচাপায় নিহত দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম, যিনি নিজেও একজন বাসচালক।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2018, 04:39 PM
Updated : 31 July 2018, 04:52 PM

“বাবা, যে চলে গেছে, তাকে তো আর পাব না। আমরা সুন্দরভাবে সরকারের কাছে একটা দাবি জানাই, একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আমাদের রাখেন,” বলেছেন তিনি।

গাবতলী থেকে উত্তরাঞ্চলের দূর পাল্লার গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর মঙ্গলবার ঢাকার মহাখালীতে তার ভাড়া বাসায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একথা বলেন।

যে বাস চালিয়ে চলছে সংসার, সেই বাসের নিচে সন্তানের মৃত্যুর পর নিজে বাস চালানো ছেড়ে দিতে চাইছেন জাহাঙ্গীর। 

গত রোববার ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষার সময় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের এক দল শিক্ষার্থীর উপর উঠে যায় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। তার নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিয়া ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুল করিম।

দীর্ঘদিন ধরে বাস চালিয়ে আসা জাহাঙ্গীর বলেন, “গাড়িটা অদক্ষ ড্রাইভার চালিয়েছে। গাড়িগুলো যখন ব্রিজ থেকে নামে তখন দুইটা গাড়ি হুড়োহুড়ি করে নামে। তারা যদি দক্ষ থাকত, তাহলে চিন্তা করত, স্কুল-কলেজের সামনে একটু আস্তে যাই।”

বেপরোয়া গাড়িচালনা বাংলাদেশের রাজধানীতে নিত্যকার চিত্র। কয়েক মাস আগে এক কলেজছাত্রের হাত হারানো ঢাকার অনিরাপদ সড়কের চিত্র তুলে ধরেছিল। গণপরিবহনে চালকের আসনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রশিক্ষিত চালকদেরও দেখা যায় হরহামেশা।

গত রোববারের ঘটনার বর্ণনায় পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ফ্লাইওভারের কাছে শিক্ষার্থীরা বাসের জন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন দুটি বাসের পাল্লা দেওয়ার মধ্যে একটি শিক্ষার্থীদের উপর উঠে যায়।

জাহাঙ্গীর বলেন, “আমার বুক যেমন খালি হয়েছে, আমি চাই না আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি হোক।

“এজন্য সরকারের কাছে আবেদন করব, প্রকৃত যারা গাড়িচালক তারা যেন গাড়ি চালান। যারা গাড়ি চালাতে পারেন না, তাদের যেন লাইসেন্স দেওয়া না হয়। পুরো বিষয়টা যেন সরকারের পক্ষ থেকে দেখাশোনা করা হয়।”

এই দুর্ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ঢাকার গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের ধরতে।

দুই সহপাঠীর মৃত্যুর পর শিক্ষার্থীর ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু ছিল জাবালে নূর পরিবহনের বাস

দুই বাসচালক ও তাদের দুই সহকারীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতের মাধ্যমে মঙ্গলবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

জাহাঙ্গীর বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব ও স্থানীয় এমপি সাহেব বাসায় এসেছিলেন। তারা বিচার হবে বলে কথা দিয়েছেন। এই হত্যার বিচারটা যেন হয়, সেটা তারা দেখবেন বলেছেন।”

দক্ষিণ মহাখালীর দুই কক্ষের ওই বাসায় স্ত্রী রোখসানা বেগম ও তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন জাহাঙ্গীর।

এই ছিল কলেজ শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিমের পড়ার টেবিল, এখানে আর বসবেন না তিনি

দিয়ার মা রোকসানা খানম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন মা হিসেবে আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।”

সেদিন কলেজ ছুটির পর মেয়ের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন রোখসানা, কিন্তু সেই মেয়ে ফিরেছে লাশ হয়ে।

চোখ মুছতে মুছতে রোখসানা বলেন, “দিয়া একা রাস্তা পার হতে ভয় পেত। আমার টেনশন হত। ওকে বারবার বলেছিলাম, তুমি সাবধানে রাস্তা পার হইয়ো। ও বলেছিল, ‘মা তুমি ভয় কর না, আমি একা রাস্তা পার হই না, সব ছেলেমেয়েদের সাথে রাস্তা পার হই’।”

দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও মা রোখসানা চান সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তি

বড় বোন রিয়া ও ছোট ভাই আরাফাতও দিয়াকে হারানোর বেদনায় কাতর। দুই কক্ষের ওই বাসাটির একটিতে মেঝেতে বিছানা করে এক সঙ্গে ঘুমাত তারা। ছোট ওই কক্ষের দেয়ালে এখনও ঝুলছে দিয়ার ছবি; তা দেখে চোখ মুছছে দুই ভাই-বোন।

দিয়ার বড় বোন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রোকাইয়া খানম রিয়া বলেন, “দিয়া ছিল সবার থেকে আলাদা। পড়াশোনায় যেমন ভালো ছিল, তেমনি দেখতেও ছিল অনেক সুন্দর।”

ভাইবোনের খুনসুঁটির কথা মনে করে আইপিএইচ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত বলে, “ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হলে দিয়া আপুর ফেইসবুকে আমি অনেক মজার কমেন্ট করে দুষ্টুমি করতাম। তাই ও আমাকে ব্লক করে রেখেছিল।”

বোনের স্মৃতি নিয়ে আছেন ছোট ভাই আরাফাত ও বড় বোন রোকাইয়া খানম রিয়া

দুই সহপাঠীর মৃত্যুর পর ক্ষোভে রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীরা সেদিন সড়ক অবরোধ করেছিল, ভাংচুর করেছিল কয়েকটি গাড়ি। পরদিন আরও কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থী বিক্ষোভ-অবরোধে যোগ দেন।

মঙ্গলবার তা বিক্ষোভ আরও বড় আকার ধারণ করে; কয়েকটি স্থানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা অবরোধের পাশাপাশি গাড়ি ভাংচুর করে। তখন তাদের সরিয়ে দিতে সক্রিয় হয় পুলিশ।

টিভিতে খবরে তা দেখে শিশু আরাফাত বলে, “আমার বোনের বন্ধুরা এই হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে, পুলিশ তাদের মারধর করেছে। এটা কেমন কথা? এটা কি তারা ঠিক করেছে? তাদের বোন মারা গেলে তারা কি প্রতিবাদ করত না?”

পুলিশের ধাওয়ায় ছুটছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার চিত্র

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের প্রতি সমমর্মিতা প্রকাশ করে দিয়ার বাবা বলেন, “তারা (শিক্ষার্থীরা) তাদের সাথের সাথী হারিয়েছে। আমি বাবা হিসেবে তাকে লালন-পালন করেছি। কিন্তু তাদের সাথেই সে সবসময় থাকত। এজন্য শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট। তাই শিক্ষার্থীরা তাদের কষ্টের কারণে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করেছে।”

ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় রাস্তা আটকে রেখে একটি বাসে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি আন্দোলনকারীদের বলছি, সুন্দর করে একটা মানববন্ধন করি। ভাংচুর না করে মানববন্ধন করে দাবি করি, যারা সঠিক ড্রাইভার তারা যেন গাড়ি চালায়। তারা গাড়ি চালালে এমন দুর্ঘটনা কমে যাবে।”

দিয়া ও করিমের মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের আচরণেও হতাশা প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীর। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরি সভাপতি হিসেবে শাজাহান খান দিয়ার বাবারও নেতা।

জাহাঙ্গীর বলেন, “তিনি গণমাধ্যমে যে আচরণ করেছেন, তার জন্য ক্ষমা চাইলে শিক্ষার্থীরা সান্ত্বনা পেত।”

শাজাহান খান তার ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষাপটে শাজাহান খান তার ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

নিম্নবিত্ত পরিবারের জাহাঙ্গীর সরকারের কাছে আশা করছেন, সংসারের এই অবস্থায় তার বড় মেয়ের যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়।

“প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করছি, আমার বড় মেয়েটার যেন একটা সরকারি চাকরি হয়,” বলেন তিনি।