শিক্ষার্থীদের ৯ দাবিতে যা যা মিলল

বাসচাপায় দুই ছাত্র-ছাত্রীর মৃত্যুর পর টানা পাঁচ দিন সড়কে বিক্ষোভ করে নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে শিক্ষার্থীরা।

মঈনুল হক চৌধুরীও শামীম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2018, 06:42 PM
Updated : 2 August 2018, 07:53 PM

গত ২৯ জুলাই জাবালে নূরের দুটি বাসের রেষারেষির মধ্যে একটি বাস বিমানবন্দর সড়কের এমইএস এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একদল শিক্ষার্থীর উপর উঠে যায়।

তাতে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হলে ক্ষোভে ফেটে পড়া তাদের সহপাঠিরা সড়ক অবরোধ করে বেশ কয়েকটি বাস ভাংচুর করে।

নৌমন্ত্রী ও পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের এক বক্তব্যের পর ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও পরদিন সড়কে নামে, তাদের অবরোধে আটকা পড়েন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ নানা কর্মকর্তাও। এরপর বিভিন্ন জেলায়ও শুরু হয় বিক্ষোভ।

স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন থেকে নয়টি দাবি উঠে আসে শিক্ষার্থীদের স্লোগানে, ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো না থাকায় এভাবেই আসে নয় দাবির কথা, যাতে সমর্থনও দিতে দেখা যায় রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলকে।

বিক্ষোভ শুরুর পরদিন থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি; শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। এক পর্যায়ে সরকার বৃহস্পতিবার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেও শিক্ষার্থীদের সড়কে নামা আটকাতে পারেনি।

এরপর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে ডেকে নেন নিহত দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীবের পরিবারকে। তাদের ২০ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি সড়কে নিরাপত্তায় নানা নির্দেশনার কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে দিয়ার বাবা শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানান।

পরে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের ৯টি দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করে বলেন, এসব দাবি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।

এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার পর আন্দোলন অযৌক্তিক হবে।

যে দাবিগুলো ছিল, যে আশ্বাসগুলো পেল

দাবি নম্বর ১: বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।

পদক্ষেপ: দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া ওই বাসের চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে জাবালে নূর পরিবহনের মালিককেও। মামলায় দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সঙ্গে অপরাধজনিত হত্যার ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এখন বিচার প্রক্রিয়াটি আদালতের উপর নির্ভর করছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, দ্রুত বিচার করে দোষীদের সাজা দেওয়া হবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য অবহেলাকারী চালকের শাস্তির মাত্রা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা সড়ক  পরিবহন আইন প্রণয়নে গতি এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে নতুন আইন শিগগিরই সংসদে উপস্থাপন করা হবে।”

দাবি নম্বর ২. নৌপরিবহনমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের কাছে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।

পদক্ষেপ: নিজের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য’ দুঃখ প্রকাশ করে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। নিহত দিয়া খানম মিমের বাসায় গিয়ে তার পরিবারের কাছেও ক্ষমা চেয়ে এসেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের স্লোগান থেকে তার পদত্যাগের দাবি উঠলেও শাজাহান খান বলেছেন, এটা শুধু বিএনপির পক্ষ থেকেই উঠেছে, ফলে তা তিনি আমলে নিচ্ছেন না।

শিক্ষার্থীদের নয়টি দাবি এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে

দাবি নম্বর ৩. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএসে ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে।

পদক্ষেপ: যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই কলেজছাত্রী নিহত হয়েছেন, সেখানে আন্ডারপাস অথবা ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এটি নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। রমিজউদ্দিন স্কুল ও কলেজকে ৫টি বাস দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

দাবি নম্বর ৪: প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে।

পদক্ষেপ: দিয়া ও করিমের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী সব স্কুলের সামনে গতিরোধক স্থাপনের নির্দেশ দেন বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানিয়েছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “কোনো স্কুল-কলেজের পাশে রাস্তা থাকলে সেখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকবে এবং শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করবে।”

দাবি নম্বর ৫: সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।

পদক্ষেপ: নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিমের পরিবারকে ২০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আহত শিক্ষার্থীদের ব্যয়ভার গ্রহণের কথা একদিন আগেই জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। 

দাবি নম্বর ৬: শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে।

পদক্ষেপ: সরাসরি বলা হয়নি, তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় এই দাবি বাস্তবায়নের ইঙ্গিত রয়েছে।

দাবি নম্বর ৭: শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

পদক্ষেপ: এটার কথাও সরাসরি বলা হয়নি, তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় এই দাবি বাস্তবায়নের ইঙ্গিত রয়েছে।

সরকার কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তাও আসছে ইন্টারনেটে

দাবি নম্বর ৮: রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের গাড়ি চালনা বন্ধ করতে হবে।

পদক্ষেপ: এটা আইনতই নিষিদ্ধ। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর ঢাকার সড়কে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের ধরতে বিআরটিএকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। জাবালে নূর পরিবহনের বাস দুটির নিবন্ধনও বাতিল করে বিআরটিএ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি যাতে রাস্তায় উঠতে না পারে, সেজন্য গাড়ির যাত্রার পয়েন্টে অর্থাৎ টার্মিনালে চেকপোস্ট বসিয়ে দেব, যাতে গাড়িটি বের হওয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই যেন ধরা পড়ে যে গাড়ির ফিটনেস আছে কি না, রেজিস্ট্রেশন ও চালকের লাইসেন্স সঠিক আছে কি না। তারপরও চালক গাড়িটি নিয়ে বের হলে আমরা সে ব্যবস্থাও নিচ্ছি।”

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গাড়ি থামিয়ে কাগজপত্র যাচাইয়ের কাজ নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার পর সরকারি গাড়ি চালকদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দেয় সরকার। পুলিশ সদস্যদেরও একই নির্দেশ দেওয়া হয়।

দাবি নম্বর ৯: বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।

পদক্ষেপ: সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাস হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সহজ হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুই-একটি দাবি পূরণে সময় চেয়ে বলেছেন, “দুই-একটি দাবি পূরণে সময় লাগবে, যেমন ফুটওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস।”

দাবি পূরণ হওয়ায় এখন শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শিক্ষার্থীদের ফেরাতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য রাজপথ অনিরাপদ হয়ে পড়বে বলে অভিভাবকদের সতর্ক করেছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।    

এখন আন্দোলন অযৌক্তিক: কাদের

বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর পর আন্দোলন করা অযৌক্তিক বলে মনে করছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

বৃহস্পতিবার বিকালে সড়ক ছাড়ার সময় শিক্ষার্থীদের আবার আসার ঘোষণার প্রেক্ষাপটে রাতে সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এই মত প্রকাশ করেন তিনি।

শিক্ষার্থীরা এখনও আন্দোলন করে যাচ্ছে, এভাবে সমস্যার সমাধান হবে কি না- এক সাংবাদিকদের প্রশ্নে কাদের বলেন, “তাদের দাবিনামা যৌক্তিক, সেটা আমি আগেও বলেছি। দাবিনামা মেনে নেওয়ার পর আন্দোলন যদি হয়, সেটা কিন্তু অযৌক্তিক হবে।”

তিনি বলেন, “দাবিনামা মেনে নেওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছি এবং অনেকগুলো মেনে নেওয়া হয়েছে। যেটা বাকি আছে সেটা সড়ক পরিবহন আইন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আগামী কেবিনেট মিটিংয়ে আসবে সে আইনটি। অ্যাপ্রুভ হওয়ার পর সংসদে যাবে এবং আশা করছি, এ আইনটি পাস হবে।”

নিরাপদ সড়কের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে কাদের বলেন, “অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে দ্রুততার সাথে। ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

“বাকিগুলো সড়ক পরিবহন আইনের মধ্য আছে, সংসদে পাস হলে ইমপ্লিমেন্ট করা যাবে। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিচারও সময়ের ব্যাপার। বিষয়টি আমাদের কোমলমতিরা উপলব্ধি করবে।”

নৌমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন বারবার এবং ক্ষমাও চেয়েছেন। মন্ত্রী যখন ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, তাকে কি মাফ করা যায় না?”

বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ইন্ধন দেওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কাদের বলেন, “বিষয়টা আমরা খতিয়ে দেখছি, এ রকম রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটছে কি না, কেউ তাদের অতীতে আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে কখনও কোটার উপর কখনও শিক্ষার্থীদের উপর সওয়ার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি।”

শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের কাছে আহ্বান জানাব, তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেবে।”