ইস্কাটনে জোড়া খুন: এমপিপুত্র রনির রায় ফের আটকে গেল

একজন সাক্ষীর জবানবন্দি নতুন করে গ্রহণের আবেদনে ইস্কাটনের জোড়া খুনের মামলায় আওয়ামী লীগের সাংসদ পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনির রায় আবারও পিছিয়ে গেছে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2018, 07:23 AM
Updated : 15 Jan 2019, 01:10 PM

এ মামালার আলামত হিসেবে মোবাইল কল লিস্ট প্রদর্শনীর জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক কুমার দাসকে আগামী ১৭ অক্টোবার আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। সেদিন তার জবানবন্দি গ্রহণের পাশাপাশি নতুন করে তাকে জেরা করবেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।   

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ আদালতের পিপি এস এম জাহিদ হোসেন সর্দারের ‘রিকল’ আবেদনের শুনানি করে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল ঈমাম বৃহস্পতিবার এই দিন ঠিক করে দেন।

সেদিন দীপক কুমার দাসের জবানবন্দি ও জেরার পর রায়ের জন্য নতুন তারিখ ঠিক করে দিতে পারেন বিচারক।

তিন বছর আগে রাজধানীর ইস্কাটনে গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যার ঘটনায় আলোচিত এ মামলার রায় এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত পিছিয়ে গেল।

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে গাড়ি থেকে ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতে আবদুল হাকিম নামের এক রিকশাচালক এবং ইয়াকুব আলী নামের এক অটোরিকশাচালক আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ এপ্রিল হাকিম এবং ২৩ এপ্রিল ইয়াকুব মারা যান।

এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম ১৫ এপ্রিল রমনা থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ওইবছর ৩১ মে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের এমপি পিনু খানের বাসা থেকে তার ছেলে রনিকে আটক করে। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই রয়েছেন।

ঢাকার আদালতে এমপি পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। ইস্কাটনে জোড়া খুনের মামলায় রায়ের নির্ধারিত দিন বৃহস্পতিবার তাকে কারাগার থেকে আদালতে নেওয়া হলেও রায় পিছিয়ে গেছে।

শুনানিতে যা হল

বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার নির্ধারিত দিনে এ আদালতের পিপি এস এম জাহিদ হোসেন সর্দার জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে আবার তলব করে তার জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন করেন।

আবেদনে বলা হয়, মামলার নথিতে আসামির মোবাইল কললিস্টের কথা উল্লেখ করা হলেও জব্দ তালিকার অংশ হিসেবে ভুলক্রমে তা আদালতে প্রদর্শনী হিসেবে দাখিল করা হয়নি। এ কারণে নতুন করে তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি নেওয়া প্রয়োজন।

এদিকে দৈনিক যুগান্তর বৃহস্পতিবার ‘রায়ের আগে গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব’ শিরেনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে তদন্ত কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয় ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজের সিডি এবং মোবাইল ফোনের কললিস্ট বা সিডিআর জমা দেওয়া হলেও রায়ের আগে এসব গুরুত্বপূর্ণ আলামত পাওয়া যাচ্ছে না।

ওই প্রতিবেদন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বিচারকের কাছে এর প্রতিকার চান বখতিয়ার আলম রনির আইনজীবী কাজী নজিবুল্যাহ হীরু।

তিনি বলেন, “ওই পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী যদি ভিডিও ফুটেজ অথবা অন্য আলামত নথিতে না থাকে তবে তো তার তথ্য বিচারকের খাসকামরার চার দেয়ালের বাইরে আসা উচিৎ নয়। এ পত্রিকা শুরু থেকেই তাদের নিজেদের ইন্টারেস্টে রনির বিরুদ্ধে নিউজ করে যাচ্ছে। কে আলামত গায়ব করল? এসব নেগেটিভ নিউজের বিরুদ্ধে আমরা আদালতের আদেশ চাই।”

অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল ঈমাম এ সময় বলেন, “আমি যখন রায় লেখার জন্য মামলার নথিপত্রের প্রত্যেকটি অংশ, পাতা পড়তে যাই, তখন দেখি অনেকগুলো আলামত নথিতে নেই। হত্যা মামলায় বেশ কিছু আলামত এক্সিবিট (প্রদর্শনী) হয়েছে। অথচ তা নথিতে পাওয়া যায়নি। কেন? কীভাবে এটা হল? একটা মার্ডার কেইসে এটা হবে কেন?

“অবশ্য এ খবর খাসকামরার চার দেয়ালের মধ্যের খবর। এটা কীভাবে নিউজ হল?”

শুনানির এ পর্যায়ে সরকার সমর্থক আইনজীবী নজিবুল্যাহ হীরু বলেন, “আমরা হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছি। বলেন, এজলাসের বাইরে এত টেলিভিশন, এত ক্যামেরা কেন?”

আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বখতিয়ার আলম রনি এক পর্যায়ে এজলাসে উপস্থিত যুগান্তরের এক সাংবাদিককে উদ্দেশ করে বলেন, “যিনি নিউজ করেছেন, তিনি এজলাসে উপস্থিত আছেন। তাকে ধরেন।”

এজালাসে উপস্থিত দুজন আইনজীবী তখন রনিকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন এবং তাকে থামিয়ে দেন।

মামলার রায়ের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার পর গুলিতে নিহত অটোরিকশা চালক ইয়াকুব আলীর স্ত্রী সালমা বেগম আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে হতাশা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, “রায় নিয়ে কেমন যেন একটা বিষয় হচ্ছে। আসামিকে মনে হয় বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফন্দি ফিকির হচ্ছে। আমি সুবিচার চাই, সঠিক রায় চাই।”

নিহত রিকশাচালক হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম ও নিহত অটোরিকশাচালক ইয়াকুবের স্ত্রী সালমা বেগম

মামলা বৃত্তান্ত

ইস্কাটনে এলোপাতাড়ি গুলিতে দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হওয়ার তিন মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ২১ জুলাই রনিকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস।

‘খুনের উদ্দেশ্য না থাকলেও’ আসামি জানতেন যে তার গুলিতে কেউ হতাহত হতে পারে- এই যুক্তিতে হত্যার অভিযোগ এনে এ মামলায় ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেন তিনি।

নিহতদের শরীরে পাওয়া গুলির ব্যালাস্টিক রিপোর্ট, রনির অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের প্রতিবেদনসহ মোট ১৫টি আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৩৭ জনকে সাক্ষী করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

গত বছর ৬ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে জোড়া খুনের এ মামলায় রনির বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার দ্বিতীয় মহানগর দায়রা জজ সামছুন নাহার।

রনির গাড়িচালক ইমরান ফকির এবং ঘটনার সময় গাড়িতে থাকা তার দুই বন্ধু ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।

ঘটনার দিন কালো রঙের যে গাড়ি থেকে রনি গুলি চালিয়েছিলেন সেটি সংসদ সদস্য পিনু খানের বলে গণমাধ্যমে খবর আসে সে সময়।

রনির বন্ধু কামাল মাহমুদ ঢাকার হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে বলেছিলেন, লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে সাংসদপুত্রই সেদিন গুলি ছুড়েছিলেন।

রনির পিস্তলের গুলিতেই ইয়াকুব ও হাকিমের মৃত্যু হয় বলে পরে ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার কথা জানায় পুলিশ।

এই সাংসদপুত্রের গাড়ি চালক ইমরান ফকিরকেও গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে সাক্ষী হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়।

গতবছর ৮ অক্টোবর আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ইমরান বলেন, ওই রাতে সোনারগাঁও হোটেল থেকে রনিকে নিয়ে তিনি মগবাজার মোড় হয়ে ইস্কাটনের বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। সে সময় ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের জন্য রাস্তার একপাশ বন্ধ ছিল।

“আমাদের গাড়ির বাঁ দিকে ও পেছনে দুটি ট্রাক ছিল। রাস্তায় ছিল জ্যাম। জ্যামে আটকা থাকা অবস্থায় রনি সাহেব এক পর্যায়ে হাত বের করেন। এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ শোনা যায়।”

তবে সাংসদপুত্র রনি ৩০ অক্টোবর আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

বিচার চলার মধ্যেই ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাটি প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়।

২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আল মামুন রায়ের জন্য ৮ মে তারিখ ঠিক করে দেন। কিন্তু এর মধ্যেই আসামিপক্ষের এক আবেদনে মামলাটি ফের বদলি করা হয় দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

নতুন আদালতের বিচারক মঞ্জুরুল ঈমাম ‘অধিকতর’ যুক্তিতর্ক শুনানির প্রয়োজন বোধ করায় রায় পিছিয়ে যায়। দুইপক্ষ আবার তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরে।গত ১৯ সেপ্টেম্বর পুনরায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক রায়ের জন্য ৪ অক্টোবর দিন রাখেন।

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তাকে নতুন করে তলবের আবেদন করায় রায় আবার পিছিয়ে গেল।

পুরনো খবর