সাংসদপুত্রকে বাঁচিয়ে পুলিশের প্রতিবেদন!

রাজধানীতে আলোচিত জোড়া খুনের আসামি সাংসদপুত্র বখতিয়ার আলম রনির গুলিতেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানালেও আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তা লিখেননি।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2015, 06:06 PM
Updated : 13 June 2015, 11:48 PM

আইনজীবীরা এ ঘটনাকে সাংসদপুত্রের প্রতি পুলিশের পক্ষপাত বলে মন্তব্য করছেন।

গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে সড়কে গুলিবর্ষণে দুজন নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ পিনু খানের ছেলে রনির চার দিনের রিমান্ড শেষে শনিবার তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।

মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড এবং গুলি সম্পর্কে বখতিয়ার রনির কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশ রিমান্ড ফেরত প্রতিবেদনে দাবি করেছেন। তবে সাংসদপুত্র বখতিয়ার এই হত্যা করেছে বা তার গুলিতে দুইজন নিহত হয়েছেন এমনটি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেননি।”

এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্যও কোনো আবেদন করেননি।

“আসামিও হাকিমের কাছে বলেনি, তিনি জবানবন্দি দিতে চান।”

তবে গত মঙ্গলবার থেকে রিমান্ড শুরুর দ্বিতীয় দিন তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক দীপক কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রনি নিজের লাইসেন্স করা বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়েন বলে স্বীকার করেছেন।

“গুলিতে কেউ মারা গিয়েছিল কি না তা তার (রনি) জানা ছিল না। তাছাড়া তাকে যে পুলিশ শনাক্ত করতে পারবে সেটিও তার ধারণায় ছিল না। নেশাগ্রস্ত থাকায় সে উত্তেজিত ছিল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তাই সামান্য যানজটে আটকা পড়ে গুলি চালিয়েছিল।”

এ মামলায় গত ৩১ মে রনি ও তার গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে তিনি জানান।

এসআই দীপক বলেন, গ্রেপ্তারের পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রনি গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেন। এর পরদিন ১ জুন তার গাড়িচালক ইমরান ঘটনা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন।

রনি সে সময় স্বীকারোক্তি না দেওয়ায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করে তাকে চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রনি ‘অসুস্থ’ থাকায় চিকিৎসার জন্য তার রিমান্ড কার্যকরে দেরি হয়।

“আদালতেও যেন তিনি গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেন সেজন্য পুলিশ চেষ্টা করছে,” গত বৃহস্পতিবার বলেছিলেন এসআই দীপক।

রিমান্ড শেষে রনির জবানবন্দি নেওয়ার জন্য আবেদন না করা প্রসঙ্গে এই পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে তো ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেবে না। তার বিরুদ্ধে সমস্ত ধরনের সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছি। স্বীকারোক্তিতে কিবা যায় আসে।

“আসামির বিরুদ্ধে কনক্লুসিভ কোনো এভিডেন্স থাকলে তার স্বীকারোক্তি ম্যান্ডেটোরি না। আজকে স্বীকার করে পরে আদালতে যদি দাবি করে পুলিশ তাকে মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে তখন তো তা বাতিল হয়ে যাবে।”

রিমান্ড ফেরত প্রতিবেদনে রনির গুলিবর্ষণের কথা স্বীকারের বিষয়টি উল্লেখ না করার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “যদি বস্তুগত তথ্য-প্রমাণ থাকে তাহলে রিমান্ডফেরত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ না করলেও চলে।”

তবে আইনজীবীরা বলছেন, রিমান্ডে আসামি গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন এবং তার গুলিতে দুজন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার কথা তদন্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলে পরে আদালতে প্রতিবেদনে তা উল্লেখ না করাটা রহস্যজনক।

দুই জায়গায় দুই ধরনের বক্তব্যের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম।

“এটা তার অদক্ষতা হিসাবে দেখে বা শৃঙ্খলা পরিপন্থি হিসাবে গণ্য করে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।”

এ ধরনের ক্ষেত্রে মামলার বিচারে কী প্রভাব পড়ে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মামলার বিষয়গুলো নির্ভর করবে আদালতে থাকা দলিল-প্রমাণের উপর। সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য সেটা মামলার বিষয়বস্তুতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।”

নিহত ইয়াকুব আলীর স্ত্রী সালমা বেগম শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার যে অবস্থা শুনলাম তাতে খুব একটা খুশি হইতে পারতাসি না। শুনতাসি যারে পুলিশ ধরসে এমপির ছেলে বইল্যা তার জামিন হইয়া যাইব। স্যার, আমি ন্যায়বিচার চাই।”

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, গত ১৩ এপ্রিল রাত পৌনে ২টার দিকে রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে একটি কালো প্রাডো গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে তাতে অটোরিকশাচালক ইয়াকুব আলী ও রিকশাচালক আবদুল হাকিম নিহত হন।

এ ঘটনায় নিহত হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম অজ্ঞাতদের আসামি করে ১৫ এপ্রিল রাতে রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।  মামলার এজাহারে বলা হয়, একটি সাদা মাইক্রোবাস থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়লে তাতে তার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

পরে তদন্তে প্রাডো গাড়ি থেকে সাংসদপুত্রের গুলিবর্ষণের বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে বলে তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

রনি গুলি ছোড়ার সময় তার গাড়িতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকার যুবলীগ নেতা ‘টাইগার কামাল’ উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা দীপক।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত ইয়াকুবের শরীর থেকে একটি গুলি উদ্ধার করে সেটি সিআইডিতে পরীক্ষার জন্য পাঠনো হয়েছিল। সেটি রনির বন্দুকের গুলি কি না তাও যাচাই বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

“মামলা তদন্তে যদি বখতিয়ারকে আবারও রিমান্ডে আনার দরকার পড়ে তবে আবেদন করব।”

এ বিষয়ে সাংসদ পিনু খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ন্যায়বিচার চাই। বিচারাধীন বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাইছি না।”