“রাজনৈতিক ভিন্নতা দূর করে ভোটের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে হবে। এটা নভেম্বরের মধ্যেই হতে হবে। কারণ এ সময়ের মধ্যে হয়ত ইসি ভোটের তফসিলও দিতে পারে,” বলেন এক নির্বাচন বিশ্লেষক।
Published : 06 Jul 2023, 01:00 AM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রায় ছয় মাস, যেজন্য নয় মাস আগে থেকে একগুচ্ছ কাজের সময়সূচি ধরে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোনো নির্বাচন কমিশনের এখনও পেরোতে হবে অনেকটা চ্যালেঞ্জের পথ; সবচেয়ে বড়টি হল সব দলকে ভোটে আনা।
রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান আলোচনা ও কথার খেলার মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিতে পিছিয়ে নেই কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। আইন ও নিয়ম কানুন ঠিকঠাক করার পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা তৈরি, ব্যালট পেপার, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও অন্যান্য নির্বাচনী সামগ্রীর চাহিদা নিরূপণের নিয়মিত কাজ চলছে।
শেষ হয়েছে রোডম্যাপ অনুযায়ী সংলাপ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস এবং আইন সংস্কারের কাজ। তবে নতুন দলের নিবন্ধনের কাজ গুছিয়ে আনা হলেও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি।
এছাড়া পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের কাজ অগাস্টে, তফসিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্রের তালিকা, আসনওয়ারী ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঠিক করার কার্যক্রমও চলছে।
তবে ভোট আয়োজনে ইসির নিয়মিত কার্যক্রমের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের চেয়ে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন এক নির্বাচন বিশ্লেষক।
তার মতে, রোডম্যাপ ইসির ‘গঁদ বাধা কাজ বা রুটিন ওয়ার্ক’। কমিশন ঠিক সময়ে সব কাজ শেষ করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সামনে ‘রাজনৈতিক সংলাপ বা সমঝোতাই’ তো দরকার হবে, যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে কমিশন। যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট নিশ্চিতকল্পে জোর প্রচেষ্টা চলছে।
“আবারও রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকা হবে কি না সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে,” বলেন তিনি।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত সেপ্টেম্বরে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করে। ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সে হিসাবে ৩১ অক্টোবর অথবা ১ নভেম্বর থেকে ভোটের ক্ষণ শুরু হবে।
রোডম্যাপের সময় ধরে সবগুলো কাজই এগোচ্ছে জানিয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “ভোটের আরও সময় রয়েছে। আমরা ইসি ঘোষিত রোডম্যাপের সঠিক ট্র্যাকেই আছি। দুয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে সময়সীমার সামান্য হেরফের হলেও কোনো অসুবিধা নেই। কিছু সময় হাতে রেখেই সব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।”
সামনের প্রকাশনা সংক্রান্ত প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে বিজিপ্রেসের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে বলে জানান তিনি।
ইসির অতিরিক্ত সচিব জানান, কিছুটা দেরিতে হলেও আইন সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে (সংসদে আরপিও সংশোধন পাস হয় ৪ জুলাই)। চলতি জুলাইয়ে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। পদ্ধতিগত কারণে ও প্রতিবেদনের জন্য সময় লাগলেও রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না।
ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণার আগে-পরে ভোটের আনুষঙ্গিক সব কাজ ঠিকভাবে করতে প্রস্তুতি থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আনিসুল হক অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচনের প্রত্যাশা তুলে ধরে সবশেষ ৮ জুন সংসদে জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে করাকে নির্বাচন কমিশন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ উত্তরণে নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে সব দলের নির্বিঘ্ন প্রচার, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী-সমর্থকদের উপর হামলা রোধ ও হয়রানিমূলক মামলা না করাসহ একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভোটের যত সরঞ্জাম
প্রায় ১২ কোটি ভোটার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় ব্যালট পেপারের জন্য কাগজের সরবরাহ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অন্যান্য সরঞ্জাম-সামগ্রী জোগানের বিষয় নিয়ে প্রাথমিক পর্যালোচনাও চলছে।
ইসির কাছে থাকা স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের বাইরে নতুন করে আরও কতগুলো কেনা লাগবে তাও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
নির্বাচনী মালামালের মধ্যে রয়েছে- ব্যালট পেপারের কাগজ, মনোনয়নপত্র থেকে ফলাফল বিবরণী, ম্যানুয়াল মুদ্রণ, ভোটারের সমান সংখ্যক ব্যালট পেপার মুদ্রণ, স্ট্যাম্প প্যাড, অফিশিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, লাল গালা, প্যাকিং বাক্স, অমোচনীয় কালি, বিভিন্ন ফরম, প্যাকেট, সুই-সুতা, খাম, মোমবাতি রয়েছে।
ভোটের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হচ্ছে-স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালির কলম, ব্যালট বাক্সের সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, রেড সিলিং ওয়াক্স, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল ও ব্রাশ সিল।
প্রায় ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের দুই লক্ষাধিক ভোটকক্ষের বিষয়টি বিচেনা করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটা করা হবে বলে জানান ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার কর্মকর্তারা।
তারা জানান, ভোটের ক্ষণ গণনার সময় ঘনিয়ে আনার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ নির্বাচনের ‘ক্ষণ গণনা থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত অ্যাকশনপ্লান ও বাস্তবায়ন সূচি’ নিয়ে অর্ধশতাধিক কাজের ফর্দ সাজানো হবে।
রোডম্যাপ ইসির ‘গঁদ বাধা’ কাজ, মূল চ্যালেঞ্জ অন্য কিছু
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমের মতে, ইসির ঘোষিত কর্মপরিকল্পনার কাজগুলো ভোট আয়োজনের জন্য অপরিহার্য। তবে সবার নজর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের দিকেই। কিন্তু সব দলকে ভোটে আনার বিষয়টিই বড় চ্যালেঞ্জ।
এর বাইরে নতুন দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম অগ্রাধিকার কার্যতালিকায় থাকা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভোটের জন্য দলগুলোর প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। অগাস্টের মধ্যে এ কাজ শেষ হলে ভোটকেন্দ্র, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণসহ বাকি কাজ হবে তফসিল ঘোষণার পর।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সিদ্ধান্ত হয়নি: কাদের
সিটি নির্বাচনে ইসির অস্বস্তিমাখা স্বস্তি
আসল চ্যালেঞ্জ নিতে এক বছরে কতটা তৈরি হল ইসি
ভোটে সব দলের অংশগ্রহণই বড় চ্যালেঞ্জ: সিইসি
শতেক কাজের ফর্দ নিয়ে ভোটের পথে ইসি
আগের দুই নির্বাচনের মতো এবারও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে এবারও। বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোটগুলো ভোটের আগে এক দফা আন্দোলনের কথা বলছে। ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছে। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সমস্যা নিরসনে আলোচনার তাগিদ দিয়ে আসছে। তবে আলোচনা বা সংলাপ নিয়ে কথার খেলা চললেও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন বিশ্লেষক আলীম বলেন, “অংশগ্রহণমূলক ভোটের জন্য একটা সমঝোতা হওয়া বাঞ্চনীয়। আমরা বারবার বলে আসছি, প্রধান চ্যালেঞ্জ দলগুলোকে ভোটে আনা। এ জন্য সংলাপ, সমঝোতার জন্য সরকারের ভূমিকা নিতে হবে। এটা কমিশনের কাজ নয়। এ সংলাপ শুধু সংলাপের জন্য সংলাপ হলে হবে না। দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকতে হবে।
“রাজনৈতিক ভিন্নতা দূর করে ভোটের পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করতে হবে। এটা নভেম্বরের মধ্যেই হতে হবে। কারণ এ সময়ের মধ্যে হয়ত ইসি ভোটের তফসিলও দিতে পারে।”
রোডম্যাপ-সংলাপ নিয়ে যা বলছে ইসি
নিবন্ধিত দলগুলোকে নিয়ে দু’দফায় সংলাপে বসলেও বিএনপিসহ নয়টি দলের সাড়া পায়নি নির্বাচন কমিশন। এরপরও অনানুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
কমিশন বলছে, দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা একটা চলমান প্রক্রিয়া। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটের আগে দলগুলোকে আবার সংলাপে ডাকা হবে কি না তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
ইসির অনানুষ্ঠানিক আলোচনাতেও ‘আগ্রহ নেই’ ৯ দলের
সংসদ নির্বাচনের পথে ইসির কর্মপরিকল্পনায় ৯ অগ্রাধিকার
সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বর না কি জানুয়ারিতে?
সুষ্ঠু ভোট করতে ইসির কর্মপরিকল্পনা সংসদে জানালেন আইনমন্ত্রী
সবশেষ পাঁচ সিটি নির্বাচনসহ বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় ৮০০ নির্বাচনের আয়োজন করেছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, “প্রতিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও উৎসব মুখর পরিবেশে সুসম্পন্ন হয়েছে এবং জনগণের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।”
এ ধারাবাহিকতাতেই আগামীতে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তিনি সবাইকে আবারও আশ্বস্ত করেন।