আসল চ্যালেঞ্জ নিতে এক বছরে কতটা তৈরি হল ইসি

কয়েকটি সিটি করপোরেশনে এবং সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন করেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি। কিন্তু আস্থার সংকট কি কেটেছে?

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2023, 03:28 AM
Updated : 26 Feb 2023, 03:28 AM

“মানুষের জীবনটাও চ্যালেঞ্জ, নির্বাচনও একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জকে ভয় পেলে হবে না, মোকাবেলা করতে হবে”- এক বছর আগে সিইসির দায়িত্ব নেওয়ার পর এমনটাই বলেছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তারপর গত এক বছরে স্থানীয় সরকার আর সংসদের কয়েকটি আসনে উপ-নির্বাচন করে এখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগোচ্ছে হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন।

আর সেই নির্বাচনটি সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে করাটাই যে এই ইসির আসল কাজ, তা মনে করিয়ে দিলেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।

এই বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের শুরুতে সংসদ নির্বাচন হতে পারে। তবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকায় সেই ভোটে সবার অংশগ্রহণের ইঙ্গিত এখনও মেলেনি।

সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন প্রণয়নের পর সার্চ কমিটির মাধ্যমে ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সচিব হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। এ ইসির অন্য সদস্যরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান, সাবেক জেলা জজ রাশেদা সুলতানা এমিলি, সাবেক সচিব মো. আনিছুর রহমান ও সাবেক ইসি সচিব মো. আলমগীর।

দায়িত্ব নেওয়ার পর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা বলার সঙ্গে সংসদ নির্বাচন ঘিরে বড় পরিকল্পনাও সাজান সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা। অর্ধেক আসনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা হোঁচট খেয়েছে সরকার সাড়া না দেওয়ায়।

এরমধ্যে অবশ্য কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে প্রশংসা পেয়েছে ইসি, গাইবান্ধার উপ-নির্বাচনে অনিয়ম দেখে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলেছে।

কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে মূল চ্যালেঞ্জ যে সংসদ নির্বাচন, তা সিইসিও জানেন। সম্প্রতি তিনি বলেন, “কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষ মূল যে বিভক্তিটা.... দুটি দল এখনও অনড় অবস্থানে আছে। অনড় অবস্থাটা দেশের জন্য বিপজ্জনক।”

Also Read: নির্বাচন করাটা ‘খুব কঠিন’ ঠেকছে সিইসির কাছে

Also Read: সব দোষ ইসিকে দিলে মানব না: নতুন সিইসি

Also Read: অর্থসঙ্কটে প্রকল্প স্থগিত, দেড়শ আসনে ইভিএমে আর ভোট হচ্ছে না

Also Read: কয়েক মাসের মধ্যে ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ প্রত্যাশা সিইসির

বিশ্লেষকের চোখে

বর্তমান কমিশনের সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে সফলতা, ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জের দিকগুলো তুলে ধরেছেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মোর্চা ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) সাবেক এ পরিচালক বললেন, প্রথম বছরে বর্তমান ইসি বেশ কিছু ভালো কাজ করেছে। বিশেষ করে মেয়াদের শুরুতে কুমিল্লা সিটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠেনি। প্রথমধাপে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপ নির্বাচন অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দিয়েছে।

“নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে সংসদীয় আসনের পুরো নির্বাচন বাতিল করার নজির নেই। অনিয়মের কারণে নির্বাচনী এলাকার উপ নির্বাচনের ভোট বন্ধের বিষয়টি বড় উদাহরণ, এটা বিশাল সফলতা।”

সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলীম বলেন, রোডম্যাপে কী কী বিষয় রয়েছে, তার চেয়ে ইতিবাচক দিক হলো নির্ধারিত সময়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। তাতেও বলা হয়েছে, বর্তমান ইসির বড় চ্যালেঞ্জ হয়েছে আস্থার সঙ্কট-এটা চিহ্নিত করেছে।

বিগত কয়েকটি কমিশনের নিজেদের মধ্যে মতভেদের কারণে তিক্ততার নজির রয়েছে। কিন্তু হাবিবুল আউয়াল কমিশন প্রথম বছরে পাঁচ সদস্যের মধ্যে কোনো ভিন্নমতের বিষয় প্রকাশ্যে আসেনি।

আলীম বলেন, “এটাও সফলতা।পাঁচজন ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে। কোনো বিষয় নিয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমত দেখিনি।”

ছয় উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়টিকে ব্যর্থতার তালিকায় রাখতে চান ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সাবেক পরিচালক আলীম।

“কিছু প্রশ্ন উঠেছে-ছয় উপনির্বাচনের এত কম টার্নআউট হওয়া, যা গ্রহণযোগ্য না। ভোটারদের কম উপস্থিতি মানে ভোটারদের আস্থা নেই ভোটে। যোগ দিয়েই কমিশন বলেছি-তারা আস্থার সঙ্কটে পড়বে। এখনও সেই আস্থা ফিরে আসেনি। এভাবে নির্বাচন হলে তা লেজিটিমেট হয় না, এটা বড় ব্যর্থতা। সাধারণ জনগণকে নির্বাচনে ফেরাতে হবে।”

সংসদ নির্বাচনে দেড়শ’ আসনে ইভিএমের কথা বলে প্রকল্প নেওয়াসহ নানা আলোচনায় ‘সময় নষ্ট’ হয়েছে বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘আস্থা সঙ্কট’ কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে বড় অগ্রগতি হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল ও গাজীপুরের মতো সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ করতে হবে এ বছরেই। এসব নির্বাচনে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া ইসির বড় চ্যালেঞ্জ মানছেন তিনি।

আলীম বলেন, “নির্বাচনের মালিক হচ্ছে জনগণ; তাদের কাছে নির্বাচনকে নিয়ে যেতে হবে। সামনে ৫/৬টি সিটি নির্বাচন হবে; এখানে অনিয়মকে যদি শক্ত হাতে ম্যানেজ করা যায়, ভোটারদের আস্থা ফিরবে। কমিশন যে কোনো মূল্যে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়- এ বার্তা দেওয়া জরুরি; এটাই ইসির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এখন।”

সময়ই বলবে: আহসান হাবিব

সংসদ নির্বাচনের পথে ১০/১১ মাস বাকি সময়ের চ্যালেঞ্জ এবং ফেলে আসা এক বছরের মূল্যায়নের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, “আলাদা কোনো চ্যালেঞ্জ নয়, প্রতিটি নির্বাচন যেভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য করেছি; একইভাবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও করব ইনশা আল্লাহ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও ইতোমধ্যে বলেছেন, দেশে-বিদেশে সবার কাছে অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে আমরা বদ্ধ পরিকর।”

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ভোট করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

আহসান হাবিব বলেন, “কত সময় পার হলো, প্রথম বছর গেল কিংবা শেষ বছর এল, এটা আমার কাছে মুখ্য নয়। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছি; এটা করেই যাব। প্রতিটি কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গেই করব। আমাদের কাজের মূল্যায়ন সময়ই বলবে।”

সব শেষ ছয় উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয় আসনের উপনির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ ছিল কম, তার প্রভাব পড়েছে ভোটের হারে।

“এটা সব নির্বাচনের দৃষ্টান্ত নয়। প্রতিটি নির্বাচনে আমাদের কঠোর মনোভাব, স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছার কোনো ঘাটতি ছিল না, আগামীতেও থাকবে না।”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেন, গাইবান্ধার উপনির্বাচনে ভোট বন্ধ করে তারা ‘কঠোর বার্তা’ দিতে পেরেছেন।

“ভোটারদের আস্থা ফিরছে। সামনেও নির্বাচন রয়েছে। সংসদ নির্বাচনেও আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে সুন্দর নির্বাচনের। অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠাভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে আমরা কর্মপরিকল্পনা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ দিয়েছি, আস্থা অর্জনে এগিয়ে গেছি।”

তিনি বলেন, “আমি বরারবই বলেছি, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক বিভেদ আর প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হয়েছে। সব দলের প্রতি আহ্বান অব্যাহত থাকবে, ভোটে অংশ নিন। কমিশনের একার পক্ষে সব সম্ভব হবে না; সকলের সহযোগিতাও দরকার।”

ভোটের আগে সমঝোতার আশা

নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব ইসির হলেও প্রক্রিয়ায় মূল কারিগর রাজনৈতিক দলগুলো। তাই তাদের সহযোগিতা ছাড়া যে কিছুই সম্ভবপর নয়, তা যাত্রার শুরুতেই বলেছিলেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেছিলেন, “সব দোষ ইসিকে দিলে হবে না। আমাদের চেয়ে অনেক বড় হচ্ছে রাজনৈতিক দায়িত্ব।”

নবম সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল স্পষ্ট। বিএনপি এবার বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে আগামী নির্বাচনে তারা যাবে না। মেয়াদের এক বছর আগেই দলটির সাত সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগও করেছেন।

বিএনপি যখন একথা বলছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা পাল্টা বলছেন, নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই।

এখন এই বিরোধপূর্ণ অবস্থান থাকলেও ভোটের আগে কোনো সমঝোতা হবে বলে আশাবাদী নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।

তিনি বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, এবারের নির্বাচন আরও অংশগ্রহণমূলক হবে এবং ভোটের আগে একটা পলিটিক্যাল কনসেনসাস দেখতে পাব। ভোটের বাইরে থেকে তো কারো লাভ নেই। আমি আশা করি, সব দল ভোটে আসবে।”

সিইসি হাবিবুল আউয়ালও একই রকম আশাবাদী। গত বৃহস্পতিবার পর্যবেক্ষক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বলেছিলেন, “আশা করি, আগামী কয়েকমাসে হয়ত দেখব একটা রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে এবং সব দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। আমাদের বিভিন্ন দল থেকে বলা হয়েছে, তারাও বিশ্বাস করবেন একটি সমঝোতা হবে। আমরাও আশাবাদী।”

তার আশা, শেষ পর্যন্ত সব দলকে নিয়েই একাদশ সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন তারা।