Published : 29 Apr 2025, 09:22 AM
প্রায় দুই যুগ আগে প্রকাশিত যে বই আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জয় করে নিয়েছে, তা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনই বা কতটুকু? কথা হচ্ছে ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিস’ বইটা নিয়ে। এই বইয়ের গল্পগুলো পড়ার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে চারটা বইয়ের যোগ আছে। আর বইটি নিয়ে কথা বলার প্রাসঙ্গিকতা লাহিড়ির গল্পের ভেতরই খুঁজতে হবে।
ধারাবাহিক পড়ে গেলে ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্পের আশ্চর্য ক্ষমতা অনেক সময়ই হয়তো বোঝা যায় না। লাহিড়ির লেখার ক্ষমতাটা হলো— আপাত পারিবারিক ঘটনার ভেতর দিয়ে তিনি এ সময়ে জনবিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংকটকে ধরতে চেষ্টা করেন। বিশ্বের রাজনৈতিক সংকট, মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রাম, সম্পর্কের বোঝাপড়ার নানা অর্থ, মানবিক বিপর্যয়, আদিম সময় থেকে মানুষের অনিবার্য স্থানান্তর, সেই সঙ্গে অভিবাসনের নিরন্তর সংগ্রাম তাঁর গল্পের উপজীব্য হয়ে আসে। কোনো ইজম, নারী স্বরের উপনিবেশের বাইরে গল্পের মধ্যদিয়ে চলমান সংকট-সংগ্রামের মিনিয়েচার তৈরি করেন তিনি। পাঠের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সেগুলো নিয়েই কথা বলা যাক।
ঢাকায় ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা পঠিত হওয়া কম বিচিত্র ব্যাপার নয়। ঝুম্পা লাহিড়ির গল্প প্রথম পড়েছিলাম দিলওয়ার হাসানের অনুবাদে। এমন হতে পারে যে, ওটাই সম্ভবত ঢাকার পত্রিকায় ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখার প্রথম অনুবাদ।
তিনি (সুহৃদদের কাছে তিনি এ নামেই পরিচিতি) ঝুম্পা লাহিড়ির ‘দ্য থার্ড অ্যান্ড ফাইনাল কন্টিনেন্ট’ গল্পটা অনুবাদ করেছেন ‘অভিবাসনের ইতিহাস’ নামে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গল্পটা দৈনিকের পাতার ধরাতে গিয়ে তাঁকে মূল ইংরেজি সংকলনের অন্তত ২৫ পৃষ্ঠার গল্পকে স্রেফ ১২-১৩ পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনতে হয়েছে। অবশ্য সেই সময় এমন করার একটা চলও ছিল। এখন তা অনেকটা কমেছে।
নব্বইয়ের দশকেও ঢাকায় ঝুম্পা লাহিড়ীর পরিচিতি তৈরি হয়নি। তিনি পুলিৎজার পুরস্কারও পাননি। দিলওয়ার হাসান (সম্ভবত) ‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনের পুরোনো সংখ্যার সুবাদে লাহিড়ির গল্পটা পড়েন। পরে গল্পটা অনুবাদ করে তখন দেশের পরিচিত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদককে ছাপতে দেন।
বিদেশি লেখক বেছে নিতে ঢাকার পাঠক বরাবরই উন্নাসিক। কোনো পুরস্কার, অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার আগে খুব কম লেখকই তাদের সমাদর পান। শক্তিশালী নতুন লেখক ‘আবিষ্কারের’ ঘটনা খুব বেশি মানুষের নেই। তত দিনে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ঝুম্পা লাহিড়ির গল্পের সংকলন প্রকাশ হয়েছে। শেষে তো ২০০০ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কারও পেলেন। তখনই খোঁজ পড়ল, কে এই পুলিৎজার জয়ী লেখিকা, তাও না কি ভারতীয় বংশোদ্ভূত! শেষে কাগজের ডাই থেকে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করে ছাপা হয়ে ছিল।
গল্পের কাহিনীটি এরকম: ভারত থেকে গিয়ে ইংল্যান্ড পড়ালেখা শেষে মার্কিন আমেরিকায় অভিবাসী হওয়া যুবকের গল্প। আমেরিকার অর্জন ও খ্যাতিতে বিভোর শতবর্ষী বিধবার বাড়িতে স্বল্প ভাড়ায় থাকতে শুরু করেছিল সে। পরে উপার্জন বাড়ার সঙ্গে বেশি ভাড়ার বাড়িতে চলে যায় যুবকটি। বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়ে যুবকটি ভাবতে পারছেন— বিধবা নারীর বাসা ভাড়ার অঙ্কটা তাঁর সন্তানের কাছেই অবিশ্বাস্য প্রায় হবে।
কে যেন বলে ছিলেন—ফুটপাতে ঈশ্বর থাকেন। তারই প্রতিফলনে হয়তো, এদিন আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম, ফুটপাতরে অনাদরে থাকা অনেক বইয়ের মধ্যে ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিস’ হারপর কলিন্স সংস্করণটিও আছে। সেখান থেকে ইংরেজিতে পড়া গল্প মাত্র দুটি— ‘সেক্সি’ ও ‘আ টেম্পরারি ম্যাটার’।
তুষারপাতের কারণে আমেরিকার একটি এলাকা প্রতি সন্ধ্যায় কয়েক ঘণ্টা সংযোগ থাকবে না জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এটা সাময়িক ব্যাপার (আ টেম্পরারি ম্যাটার)। এই সময়ে আমেরিকায় পড়তে আসা যুবক-যুবতীর প্রেম, বিয়ে, মৃত সন্তান জন্ম দেয়া, সম্পর্কের শৈথিল্য ইত্যাদির টানাপোড়েন নিয়ে গল্প। দীর্ঘ জীবনের মধ্যে এটা তো সাময়িক ব্যাপার বটেই।
‘সেক্সি’ গল্পটা অভিবাসী তরুণী মিরান্ডার সঙ্গে অভিবাসী দেবের পরকীয়ার গল্প। তবে সম্পর্কটা বিচারের মুখোমুখি হয়েছে মিরান্ডার সহকর্মী লক্ষ্মীর বড় বোনের স্বামী ছেড়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। একবার মিরান্ডাকে এক বিজ্ঞান জাদুঘরে নিয়ে দেব দেখিয়ে ছিল, সেতুর একপ্রান্তে একটা ছোট শব্দ করলেও অপর প্রান্ত উচ্চ শব্দ হয়। এটা ছিল শব্দ বিজ্ঞানের খেলা। পরে মিরান্ডা বুঝে ছিল, তার কাছে খুব সামান্য একটা শব্দ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে অন্য অর্থ তৈরি করে। স্থান ভেদে শব্দের অর্থ, অনুভূতি বদলে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের অভিজিৎ মুখার্জির অনুবাদে ঝুম্পা লাহিড়ির গল্প পড়া হচ্ছে লেখকের শক্তিকে আবিষ্কারের মতো ব্যাপার, এটা মনে হয় অনুবাদকের শক্তি।
অভিজিৎ মুখার্জি পণ্ডিত মানুষ। ‘যে ভারতীয় ইংরেজিতে লিখছেন’ বইয়ের মতো প্রবন্ধ সংকলন পড়লে লেখকের চিন্তার গভীরে যাওয়ার পারদর্শিতা বোঝা যায়। ‘আশীর্বাদধন্য এই বাড়ি’ নামে তিনি অনুবাদ করেছেন ‘দিস ব্লেসড হাউস’ গল্পটি। একটা সংবাদমাধ্যমের বৈশাখী সংখ্যার সম্পাদনায় যুক্ত থাকার সুবাদে তাঁর কাছ থেকে এই অনুবাদটা আমিই এনে ছিলাম। আমার বিবেচনায়, ঝুম্পা লাহিড়ির অন্যতম সেরা গল্প এটি।
আমেরিকায় অভিবাসী নব দম্পতি সঞ্জীব ও টুইঙ্কল সদ্য ভাড়া নেওয়া বাড়িটা সাফ করতে গিয়ে দেখল, আগের ভাড়াটিয়া বাড়ির প্রায় সব কোণে যিশুখ্রিষ্টের প্রতিকৃতি ছড়িয়ে রেখে গেছেন। নতুন ভাড়াটিয়া হওয়ার অধিকারে সঞ্জীব চাইছে, যিশুর প্রতিকৃতি হটিয়ে দিতে। কিন্তু টুইঙ্কল দেখছে এগুলোর ধর্মীয় গুরুত্বের বাইরে একটা নান্দনিক সৌন্দর্যও আছে, এগুলো রক্ষা করা যায়। পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বিশ্বে এক ধর্মাবলম্বী আরেক ধর্মীয় প্রতিকৃতি হটিয়ে দেয়ার যে লড়াই তার মূলেও এই কারণ।
লেখিকা দেখান, নতুন ভাড়াটিয়া হওয়ার সুযোগে আগের ভাড়াটিয়ার চিহ্নমাত্র সহ্য না করার মতো স্থূল দ্বন্দ্বে লিপ্ত ধর্মীয় গ্রুপগুলো। আসলে তারা নতুন আসা ভাড়াটিয়া বৈ বেশি নয়। টুইঙ্কলের ভাষায়, ‘এটা আমাদের দুজনের বাড়ি। একসঙ্গে আমরা এর মালিক। মূর্তিটা আমাদের সম্পত্তির অংশ।’ এর চেয়ে ভালো শান্তিপূর্ণ সমন্বয়ের চিন্তা কী-ই হতে পারে।
অভিজিৎ মুখার্জির গল্পটা ঢাকার উজান প্রকাশনী থেকে ‘বিগ্রহ ও নিরাকার’ বইয়ে সংকলিত হয়েছে।
ঢাকায় অন্য ভাষার সাহিত্য পাঠের ট্র্যাজেডি বোধ হয়— অধিকাংশের রুচি অনুবাদ পাঠের মাধ্যমে উঠেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা। অন্য যে কোনো ভাষাই হোক, মূল ভাষা থেকে পাঠের অভিজ্ঞতা কম। অনুবাদের বিরাট গুরুত্ব স্বীকার করেও বলা যায়, মূল ভাষায় সাহিত্য পাঠে সক্ষম হয়ে ওঠা জরুরি, অন্তত ইংরেজি ভাষায় হলেও। ইংরেজি বই সংগ্রহ এখন আর দেশে কঠিন নয়।
এই সমালোচনার অনেকটা এই লেখকেরও (আমি) কাঁধে নিতে হবে। অনেকের মতোই দ্রুত পাঠের জন্য এখানেও অনুবাদ বইয়ের সুযোগ নেওয়া হয়েছে।
কল্যাণী মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদে ‘দোভাষীর বেদনা’ বইটিও পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে পাওয়া। বইটা প্রকাশ করেছে দিল্লির ‘রূপা অ্যান্ড কম্পানী’ প্রকাশনী। এই বই থেকেই বাকি গল্পগুলো পড়া হয়েছে। অস্বীকারের সুযোগ নেই, এই বইয়ের ভুলভাল বানান আর প্রকাশনার অযত্ন চোখে পড়ার মতোই।
‘আশীর্বাদধন্য এই বাড়ি’র একটা অন্তঃস্বর পাওয়ায় যাবে ‘মিস্টার পিরজাদা যখন ডিনারে আসতেন’ গল্পে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় আটকা পরা পরিবার নিয়ে প্রবাসী অধ্যাপকের উদ্বেগ অভিবাসী শিশুর চোখ দিয়ে দেখানো হয়েছে। শিশুটি গোপনে অধ্যাপকের কন্যাদের জন্য প্রার্থনা করে, তাদের মঙ্গল কামনায় প্রতি মঙ্গলবার মিষ্টি খেতে শুরু করে। এমনকি যুদ্ধের পর দেশে গেলে ওই অধ্যাপকের সঙ্গে কখনো দেখা হবে না জেনেও সে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। আরেক প্রেক্ষাপটে ধরা পড়েছে, দেশভাগের পর দুই দেশে বর্ধনশীল সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই বিদেশে উচ্চতর গবেষণায় গিয়ে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী অভিবাসী পরিবারে। এটা যুদ্ধের সময় কোটি বাঙালির ভারতে আশ্রয় নেওয়ার বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয়।
গল্পে লেখিকা যেন আমাদের দেখিয়ে দেন— শিশুর মতো সরল না হলে সাম্প্রদায়িকতা ঘুচবে না, দূরে না গেলে মানুষের নৈকট্য আসবে না। এ গল্প যেন আমাদের বার্তা দেয়— যুদ্ধের সময় সীমান্ত পেরিয়ে কোটি বাঙালি যেমন ভারতীয়দের মানবিক সেবা পেয়েছে, তেমনি বিভেদ বাড়তে থাকলে যুদ্ধ (অমানবিক দূরত্ব) খুব দূরের কিছুও নয়। গল্পে: “মিস্টার পিরজাদা বাঙালি, কিন্তু তিনি মুসলমান’, বাবা আমাকে বোঝালেন, ‘এইজন্যই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থাকেন, ভারতবর্ষে নয়।”এ আরও এক ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস সামনে আনে।
ভারত ভ্রমণে আসা অভিবাসী পরিবারের নারীর প্রতি দোভাষী ধরনের গাড়ি চালকের একটা অনুরাগ ছড়িয়ে আছে ‘দোভাষীর বেদনা’ গল্পে। বেশ তো ভ্রমণের গল্প, এখানে আবার বেদনা কোথায়? এক সময় খানিকটা ইংরেজি আয়ত্তে আনার পর চালক ভেবে ছিল, তার জীবনই বদলে দিবে এই ভাষা। যে কারণে তিনি প্রবাসী ওই নারীর কাছে স্পর্ধিত অনুমতি আশা করে। কিন্তু দিনে দিনে ইংরেজি ঘিরে স্বপ্ন ফিকে হয়ে যাওয়ার মতোই ধীরে প্রবাসী নারীর প্রতি তার প্রত্যাশার পরিধি কমে আসে। এর মধ্যেই সে উন্মোচন করে, প্রবাসী দম্পতির পরিবারে একটা সন্তান ঠিক তাদের দুজনের নয়, বরং পুরুষের বন্ধুর ঔরসজাত, যা সে জানে না। যেমন তার পিতৃভূমি হলেও সে ভারতের বিভিন্ন স্থান খুঁজে বের করছিল ভ্রমণ গাইড থেকে। প্রবাসী জীবনের মতো, সাংসারিক সম্পর্কেরও সে প্রবাসী।
‘আসল দারোয়ান’ গল্প আবর্তিত হয়েছে জাতিঃস্বরের মতো স্মৃতিতে আচ্ছন্ন এক বৃদ্ধাকে ঘিরে। এতে দেখা যায়, সিঁড়ির নিচে আশ্রয়ের সুবাদে গৃহকর্মীর কাজ করেন বৃদ্ধা। ভবনের বাসিন্দারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকে বৃদ্ধাকে নিরাশ্রয়ী করে তুলে। বৃদ্ধার অবদানের কথা ভুলে ‘আসল’ দারোয়ান খুঁজতে বের হয়। মানুষের কাজে অস্বীকৃতির গল্প এটি।
স্বামীর চাকরির সুবাদে অভিবাসী নারীর একঘেয়ে ও নিঃসঙ্গতার গল্প ‘মিসেস সেনের কথা’। একই সঙ্গে পুরুষের দাপটে নারীর স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে যাওয়ার গল্পও এটি। গল্পে অভিবাসনের সংগ্রামে অংশ হিসেবে বেবি-সিস্টার হিসেবে এক কিশোরকে (এলিয়ট) তার কাছে রাখেন। কিশোর এলিয়টও যেন অবলম্বন খুঁজে যায়।
‘বিবি হালদারের চিকিৎসা’ আমাদের পরিচিত গল্প। অর্থ না থাকার অজুহাতে বিবি হালদারকে বিয়ে না দিয়ে নিজের পরিবারে রেখে দেয় তার বড় ভাই। তার আশ্রয় হয় ছাদের নিচু ঘরে। পরিবারে থাকার সুবাদে তাকে ঘর-গেরস্থালি, ভাইয়ের দোকানের হিসেবে কষতে হয়। প্রতিবেশী নারীরা বারবার বলার পরও বিয়ের উদ্যোগ নেয় না তাঁর পরিবার। এক দিন বোঝা যায় বিবি হালদার গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন। বিষয়টা জানাজানি হলে লোকলজ্জায় পড়ার ভয়ে পরিবার নিয়ে সরে যায় বড় ভাই। শেষে ভাইয়ের ফেলে যাওয়া ভাঙা ব্যবসায় জোড়া দিয়ে সন্তান নিয়ে চলতে থাকে বিবি হালদারের জীবন। মানসিক সমস্যায় ভুগলেই যে জৈবিক চাহিদা নাই হয়ে যায় না, আর কেউ কেউ সেই সমস্যার সুযোগ নেয়, লেখিকা আমাদের সেই কথাটাই ধরিয়ে দিতে চান।
গল্পের এত কাহিনি বর্ণনার পর পাঠকের মনে হতেই পারে, ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প তিনি কেন পড়বেন? আবার পারিবারিক কাহিনির ভেতর তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্তারের কথা আগেই বলেছি। সেই সঙ্গে আমেরিকার গল্পের কাঠামো শেখার আছে। এই গল্পগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমান আমেজ থাকে। মানে, সাদত হাসান মান্টোর যুগে উর্দু গল্প, লাতিন আমেরিকার গল্প, নব্বইয়ের দশকের পর বাংলা গল্পে যেমন চমক দেখানোর চর্চা করা হচ্ছে; ঝুম্পার গল্প তার বাইরে।
‘ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিস’-এর পর ঝুম্পা লাহিড়ীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস, একটি গল্প সংকলন ও কিছু গদ্য প্রকাশ হয়েছে। পেন/হেমিংওয়ে পুরস্কার জয়ী তাঁর ‘নেমসেক’ উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। ম্যান বুকার পুরস্কার চূড়ান্ত তালিকায় ছিল তাঁর ‘দ্য লোল্যান্ড’ উপন্যাসটি। এ সব তথ্য বাদ দিলেও, প্রায় সব লেখাই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে কোটি পাঠক পড়ছেন। সেখানে তাঁর সাহিত্য পাঠের সুযোগ না নেওয়াটা বোকামিই হবে। দীর্ঘ বছর যাবৎ বাংলা গল্প যে গণ্ডির ভেতর শোচনীয় রকমের ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই বৃত্তের বাইরে আসার পথও পাওয়া যেতে পারে তাঁর লেখায়।
ঝুম্পা লাহিড়ীর প্রায় সব গল্পই প্রবাসীদের চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়েছে। অনেক চরিত্র আমেরিকার অক্সফোর্ড বা হারবার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া তরুণ-তরুণীর জীবনের প্রেক্ষাপটে তৈরি। এর একটা একঘেয়েমি আছে। কিন্তু কাহিনির বৈচিত্র্য ও চিন্তার কারুকাজের দ্বৈরথ কম লেখকের গল্পেই মেলে। সেখানে লাহিড়ির লেখায় তা পাওয়া যায়। মনে রাখা যেতে পারে, গল্পের চরিত্রের মতো ঝুম্পা লাহিড়ীও আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সৃজনশীল লেখালেখিসহ একাধিক ডিগ্রি নিয়েছেন।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বিশ্বে এখন সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন হচ্ছে—অভিবাসীদের কী হবে? অভিবাসীদের ঢল ধেয়ে যাওয়া ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী এজেন্ডার মধ্যে এটিও একটি। এই অভিবাসন বৈষম্যমূলক বিশ্বের অনিবার্য ছিল। তা ছাড়া, রেমিট্যান্স নির্ভর উন্নয়নশীল দেশের জীবন ও অর্থনীতিতে অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই অভিবাসীদের জীবন অভিজ্ঞতা ভেতর দিয়ে বিশ্বকে দেখার চাহিদা তৈরি হয়েছে, জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্যও ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
একবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অবকাশকালীন পঠিত বইয়ের তালিকায় দেখা গেল, ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লো ল্যান্ড’ উপন্যাসটি। সেই ঝুম্পা লাহিড়ি ইতালিয়ান ভাষা শিখছেন, এ খবর এখন একেবারেই পুরোনো। বরং আশ্চর্য হতে হয়, তিনি আর ইংরেজিতে লেখেন না। তিনি এখন পুরোদস্তুর ইতালিয়ান ভাষায় লেখেন। লেখালেখির অভ্যস্ত ভাষা বদলে ফেলে আরো এক ভাষায় লিখেও যাঁরা খ্যাতি ধরে রাখতে পেরেছিলেন— অনরে দ্য বালজাক, মিলান কুন্দেরা, ভ্লাদিমির নাবোকভ— তাঁদের কাতারে উন্নীত করলেন নিজেকে। ইতালি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ ছাড়াও চারটি বই লেখা হয়েও গেছে ওই ভাষায়। ২০১৮ সালেই ইতালিয়ান ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখা উপন্যাস ‘দোভে মি ভো’। পরে ‘হয়ারঅ্যাবাউটস’ নামে নিজেই উপন্যাসের ইংরাজি অনুবাদ করেছেন।
কী এমন প্রয়োজন পড়ল তাঁর অভ্যস্ত ভাষা বদলে ফেলার? তার কারণ হলো অস্তিত্ব, তার কারণ বদল।
ঝুম্পা লাহিড়ীর বক্তব্য হলো— মানুষ প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয়ের বিবর্তনের পাশাপাশি নিজের জন্য একটা খাঁচা তৈরি করছে। এ থেকে বের হতে না পারলে দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যাবে, সত্য তাকে ফাঁকি দেবে। তাই তাঁর থিতু হয়ে বসার উপায় নেই। জগতের সব রকম অস্তিত্বের তরফে সৃষ্টিকে, সমাজকে দেখতে শিখতে হবে।
এ জিনিস আগে কখনো হয়নি! পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী লেখক তাঁর লেখার ভাষা পাল্টে ফেললেন!
এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন— ইংরাজি তাঁকে জনপ্রিয়তা এনে দিলেও, এই ভাষা কোনোদিনই তাঁর নিজস্ব ছিল না। তথ্যের খাতিরে জেনে রাখা ভালো, ঝুম্পা লাহিড়ি বাঙালি হলেও, তাঁর জন্ম লন্ডনে। তারপর বড় হয়ে ওঠা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ইংরাজি ভাষায় পড়াশোনা করতে হয়েছে বলে, সেই ভাষাটাকে লেখালিখির প্রাথমিক মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সুযোগ থাকলে বাংলাতেই সাহিত্যচর্চা করতেন তিনি। ঠিক এমন একটা কারণ থেকেই, ইতালিয়ান ভাষায় গল্প লিখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঝুম্পা লাহিড়ী। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা। কতখানি আত্মবিশ্বাস আর উদ্যম হলে এটা সম্ভব, ভাবুন! বহুভাষী ঝুম্পা লাহিড়ির বিপুল পাঠের পাশে বিদেশী ভাষার প্রতি এখনো বিদ্বেষে ভোগা আহ্লাদিত বাঙালি লেখকদের কথা কতটা ভাবা যায়?
সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের নৃশংস আগ্রাসনে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমের দেশগুলোতে ইসলামভীতি (ইসলামোফোবিয়া) বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে এর সমালোচনাও চলছে। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটিয়েছেন ঝুম্পা লাহিড়ী। ২০২৪ সালে সেপ্টেম্বরে তাঁকে মার্কিন আমেরিকার মর্যাদাপূর্ণ ইসামু নগুচি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত করা হয়। তবে ইসলাম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যে পুরুষদের মাথায় বহুল ব্যবহৃত পোশাক কেফিয়েহ বা হাত্তাহ (বাংলাদেশে ‘হাজি ওড়না’ বলেও পরিচিত) পরিধান করায় নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত নগুচি মিউজিয়ামের তিন ফিলিস্তিনিকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। এমনকি ওই বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বয়কটের ডাক দেয়া খোলা চিঠিতে হাজারো লেখকের সঙ্গে তিনিও স্বাক্ষর করেন। ঝুম্পা লাহিড়ী একে অভিহিত করেন ইতিহাস বোধ আর মানবিকতার দায় হিসেবে। তাঁর এই অবদান ও লেখালেখি সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?