Published : 29 Apr 2025, 09:07 AM
জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ-জনতার ‘মুখোমুখি’ অবস্থানের পর বাহিনীটিকে ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ নানা উদ্যোগের মধ্যে এবারের পুলিশ সপ্তাহ শুরু হচ্ছে।
‘আমার পুলিশ আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে এ আয়োজন পালিত হচ্ছে ‘অনাড়ম্বরভাবে’।
মঙ্গলবার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মধ্যদিয়ে শুরু হতে যাওয়া হওয়া এই পুলিশ সপ্তাহের মূল আয়োজন থাকছে মাত্র তিন দিন।
শুক্রবার পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) নির্ধারিত আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের আনুষ্ঠানিকতা।
দেশের পুলিশ সদস্যদের এই বার্ষিক সম্মিলনের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, “আমরা এবার পুলিশ সপ্তাহ অনাড়ম্বরভাবে করছি। এখানে উৎসব-আনন্দ এগুলো একদমই থাকছে না। পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক না করে আমরা ফাংশনাল, কার্যকর করতে চাচ্ছি।”
এবারের প্রতিপাদ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, “এই ভাবনাটা আমরা সঞ্চারিত করতে চাই সমগ্র দেশবাসীর মনে। তারা যেন বলতে পারেন বৈষম্যহীন বাংলাদেশের এই পুলিশ আমাদের।”
গেল বছরের ৫ অগাস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশজুড়ে পুলিশি স্থাপনায় হামলা ও জনতার ক্ষোভের মুখে একরকম ভেঙে পড়েছিল পুলিশি ব্যবস্থা। আন্দোলনে পুলিশের ‘নৃশংস হওয়ার’ পেছনে কর্মকর্তাদের দায় দিয়ে ‘বিক্ষুব্ধ’ হয়ে উঠেছিলেন সদস্যরাও।
এমন প্রেক্ষাপটের পর পুলিশি ব্যবস্থা ‘কার্যকরে প্রয়াসের’ কথা জানিয়েছেন দায়িত্বরতরা। সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও নানান দাবি-দাওয়ার মুখে শুরু হল এবারের পুলিশ সপ্তাহ।
‘ভিন্ন আমেজের’ এই পুলিশ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের দায়িত্বরতদের কাছে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন, ক্ষতিপূরণ ভাতা, স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট গঠনসহ বেশকিছু দাবির কথা তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
এবারের পুলিশ সপ্তাহে থাকছে না শিল্ড প্যারেডসহ অন্য প্রতিযোগিতা। বরাবরের মতো পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়নি। রাষ্ট্রপতিও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মিলন বসছে না। থাকছে না প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কোনো আলোচনা।
তবে প্রথমবারের মতো এবার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে বাহিনীটির নীতিনির্ধারকদের মতবিনিময় সভা হবে।
অনুষ্ঠানসূচি অনুযায়ী, ভাষণের মধ্য দিয়ে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধনের পর প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত পুলিশ সদস্যদের পদক প্রদান দেবেন। এরপর পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতির (পুনাক) স্টল উদ্বোধন ও পরিদর্শন করবেন।
দুপুরের পর প্রধান উপদেষ্টার ‘নির্দেশনার আলোকে প্রণীত’ কর্মপরিকল্পনার উপর ওয়ার্কশপ থাকবে।
দ্বিতীয় দিন সকাল থেকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট কর্তৃক ‘প্রেজেন্টেশন’ এবং সন্ধ্যায় পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও সচিবদের সম্মেলন।
তৃতীয় দিনের শুরুতে আইজি’জ ব্যাজ প্রদান ও ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে আইজিপির সম্মেলন। এরপর প্রথমবারের মতো নাগরিকদের সাথে মতবিনিময় সভা থাকছে।
বিকালে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অফিসার্স মেসের বার্ষিক সাধারণ সভা এবং সন্ধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত পুলিশ অফিসারদের পুনর্মিলনী।
চতুর্থদিন শুধুমাত্র পুনাক সমাবেশ ও আনন্দমেলা এবং পুনাক স্টলের পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে শেষ হবে এবারের পুলিশ সপ্তাহ।
পুলিশ সপ্তাহের বিষয়ে সোমবার আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, “আনন্দ উৎসব বাদ দিয়ে অনেক বেশি কার্যকর সেশনগুলো করা, আমাদের পেশাগত বিষয়াদি আলোচনা করা। আমাদের বিগত দিনের কর্মকাণ্ড মূল্যায়ন করা। বিগত দিনের ভুলত্রুটিগুলো নিজেরা বের করা এবং সামনের দিনের পরিকল্পনা করা। মূলত এইসব কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকব আমরা তিন দিন।
“আমরা কীভাবে আগামী দিনে আরও কার্যকর পুলিশি সেবা মানুষকে দিতে পারি এবং যেসব চ্যালেঞ্জগুলো আছে- যেগুলো আসবে, সেগুলো আমরা কীভাবে উত্তরণ করব, অতিক্রম করব- সেগুলো নিয়ে আমরা কথা বলব আমাদের মধ্যে। আমরা মাঠপর্যায়ের যে পরিস্থিতি সবার কাছ থেকে নিব, জানব এবং আগামী দিনে তারা কী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন সেটাও শুনব।”
সারাদেশ থেকে পুলিশ ইউনিটের প্রধান, পুলিশ সুপার, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন পুলিশকর্মকর্তারা পুলিশ সপ্তাহে উপস্থিত থাকবেন।
আইজিপি বলেন, “১৭ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মাঠপর্যায়ের পুলিশ সুপার এবং মেট্রোপলিটনের পুলিশ কমিশনার সকলকে এড্রেস করেছিলেন। সেখানে কিছু দিকনির্দেশনা ছিল। আমরা সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করব, সেগুলো আলোচনা করব। পুলিশ সুপাররা এগুলো আমাদের জানাবেন।”
এবারের পুলিশ সপ্তাহে নাগরিক সমাজের সাথে ‘আলোচনা অনুষ্ঠান’ রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “নাগরিক সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির যারা সভ্য, যারা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক অথবা ছাত্রপ্রতিনিধি, গীতিকার, ক্রীড়াবিদ- সবাইকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি। একটা সেশনে আমরা ওনাদের মুখ থেকে শুনতে চাই, পুলিশিংয়ের বিষয়ে তাদের ধারণা কী?
“তারা কী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন গত সাত-আট মাসে এবং ৫ অগাস্টের আগের সময়ে। আমরা আমাদের ভুলত্রুটিগুলো তাদের কাছ থেকে শুনব। আমরা আরও কীভাবে সামনে এগুতে পারি, সেগুলো তাদের কাছ থেকে শোনার জন্য আশা রাখি।”
কমছে বিপিএম-পিপিএম পদকের সংখ্যা
এবারের পুলিশ সপ্তাহে সাহসিকতা ও সেবার জন্য মোট ৬২ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য পদক পাচ্ছেন।
এর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পাচ্ছেন ২৮ জন আর রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) পাচ্ছেন ৩৪ জন। তবে আন্দোলনের সময় প্রাণ হারানো কোনো পুলিশ সদস্যকে পদক দেওয়া হয়নি।
সংখ্যার দিক দিয়ে এবার পদক প্রাপ্তদের সংখ্যা গত বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। বছরজুড়ে ভালো কাজ, গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণ, সাহসকিতাপূর্ণ কাজের জন্য চারটি ক্যাটাগরিতে (বাংলাদেশ পুলিশ পদক- বিপিএম সাহসিকতা ও সেবা এবং প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক- পিপিএম সাহসিকতা ও সেবা) পদক দেওয়া হয়।
বিগত বছরগুলোতে শতাধিক, এমনকি ২০১৯ সালে রেকর্ড সংখ্যক ৩৪৯ জন পুলিশ সদস্যকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
কমেছে আইজি’জ ব্যাজ
প্রশংসনীয় ও ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুলিশের ২৬৮ কর্মকর্তা ও সদস্য পাচ্ছেন ‘পুলিশ ফোর্স এক্সেমপ্ল্যারি গুড সার্ভিস ব্যাজ’। পুলিশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এ পুরস্কার এবারের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন প্রদান করবেন আইজিপি। গত বছর এই ব্যাজ পেয়েছিলেন ৪৮৮ কর্মকর্তা ও সদস্য।