শতেক কাজের ফর্দ নিয়ে ভোটের পথে ইসি

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোর প্রস্তুতির মধ্যে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিল সংশ্লিষ্ট ফরম ও প্যাকেটসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য মাঠ পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2018, 07:25 PM
Updated : 17 Oct 2018, 07:27 PM

নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত ম্যানুয়েল মুদ্রণ শেষ করে ৫ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হবে।

তফসিল ঘোষণার আগে এবং তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল গেজেটে প্রকাশ পর্যন্ত এমন শত কাজের ফর্দ ধরে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশনের।

ভোটের দিন ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশনের পরের দিন কেন্দ্রভিত্তিক ফল একীভূত করা হবে। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন শেষে ভোটের দুই দিন পর নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশ এবং তিন দিন পর সংসদ সচিবালয়ে তা পাঠানোর কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে।

ভোট সংক্রান্ত ইসি সচিবালয়ের ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে (প্রাক নির্বাচন ও তফসিল পূর্ববর্তী) প্রাথমিক কর্মপরিকল্পনা’ এবং ‘ (তফসিল ঘোষণার পর) নির্বাচন পরিচালনার জন্য কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সূচি’ সংক্রান্ত চেক লিস্ট কমিশন অনুমোদন করেছে।

৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে ২৮-৩০ অক্টোবরের মধ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসি।

নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, “৩০ অক্টোবরের মধ্যে ভোটের তফসিল নিয়ে কমিশন বৈঠক হবে। এরপর যে কোনো দিন তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। ভোটকে সামনে রেখে সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”

ইতোমধ্যে ভোট প্রস্তুতির সার্বিক পরিস্থিতি সোমবার কমিশনকে জানিয়েছে ইসি সচিবালয়। মঙ্গলবার ইসি সচিবালয়সহ আঞ্চলিক, জেলা  পর্যায়ের নির্বাচন  কর্মকর্তাসহ শতাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন সিইসি।

সিইসি কেএম এম নূরুল হুদা

এ নিয়ে তিনি বলেন, “ভোটার তালিকা, ভোটকেন্দ্র, প্রশিক্ষণ, নির্বাচন সামগ্রী প্রস্তুতসহ তিন-চারটি বিষয়ে কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছি। মাঠের সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক। কোথায়, কীভাবে নির্বাচন সামগ্রী নেওয়া হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন। মাঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি লক্ষ্য করেছি।“

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে নূরুল হুদা বলেন, “সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষভাবে অবাধে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তা আমরা করব।”

শত কাজের কর্মপরিকল্পনা

ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান জানান, ভোটের তফসিলের আগে মাঠ পর্যায়ে মনোনয়নপত্র, ভোটার তালিকার সিডিসহ সব ধরনের সামগ্রী-ম্যানুয়েল রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সব কিছু  প্রস্তুত থাকবে।

ইতোমধ্যে দুটি কর্মপরিকল্পনা ধরে কাজ গুছিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

নির্বাচন ভবন

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের ১৬ জুলাই রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত  একটি এবং তফসিল ঘোষণা থেকে ভোটের ফলাফল পর্যন্ত আরেকটি কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।

ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান জানান,  তফসিল ঘোষণার আগে ২২টি খাতে ১০৩টি কাজ সাজানো হয়েছে, যাতে করে তফসিল ঘোষণার পরই সব কাজ দ্রুততম সময়ে করা সম্ভব হয়।

“নির্ধারিত সময়ের এসব কাজের অধিকাংশই  সম্পন্ন হয়েছে; আগাম প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো ৩০-৩১ অক্টোবরের চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকবে।”

এ কর্মকর্তা জানান, তফসিল ঘোষণার পর ৯৯টি কাজ নিয়ে ‘কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসূচি’ রাখা হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রস্তুত রাখা হবে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

কাজের মধ্যে রয়েছে- সংলাপ, আইনের সংস্কার, নির্বাচনী এলাকার সীমানা, ভোটার তালিকা, দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, বাজেট, নির্বাচন সামগ্রী, ম্যানুয়েল নির্দেশিকা, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, নির্বাচনের জনবল, আইন শৃঙ্খল, প্রশিক্ষণ, প্রচার, ইভিএম, আইসিটি, ফলাফল ইত্যাদি।

২২ খাতে ১০৩ কাজ

৩০ অক্টোবর: ৩০০ নির্বাচনী এলাকার জিআইএস প্রস্তুত ও মানচিত্রসহ পুস্তিকা প্রস্তুত। প্রার্থীদের জন্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ছবি ছাড়া ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত।

৩১ অক্টোবর: ছবিসহ ও ছবি ছাড়া ভোটার তালিকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক কপি মুদ্রণ।

১০ নভেম্বর: সম্পূরক ভোটার তালিকার সিডি রেজিস্ট্রেশন অফিসারকে সরবরাহ।

২০-৩১ অক্টোবর: বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের জন্য হেল্পডেস্ক করতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ; নিয়মিত সংবাদ অবলোকন করে কমিশনকে জানাতে টিম গঠন; সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা; সাংবাদিক ও পর‌্যবেক্ষকদের জন্য কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সভা পরিকল্পনা।

২৫ অক্টোবর: নির্বাচনে ব্যবহৃত সব ফরম, প্যাকেট মুদ্রণ সম্পন্ন। ব্যালট বাক্স, লকসহ নির্বাচন দ্রব্যাদির মজুদ পরীক্ষা করে জেলা নির্বাচন অফিসারদের জানানো।

৩০ অক্টোবর: মনোনয়নপত্র দাখিল সংশ্লিষ্ট  প্রাথমিক পর‌্যায়ের বিভিন্ন ফরম (ফরম-১, ফরম ২, ফরম-৩), প্যাক্টেসহ অন্যান্য দ্রবাদি মাঠ পর‌্যায়ে প্রেরণ। নির্বাচনী দ্রব্য-স্ট্যাম্প প্যাড, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, অফিসিয়াল সিল, গালা ইত্যাদি সংগ্রহ।

২ নভেম্বর: ভোটের জন্য আগে সব ব্যালট বাক্স পুনরায় যাচাই ও ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা।

৫ নভেম্বর:ম্যানুয়েল মুদ্রণ শেষ করে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠানো।

৩১ অক্টোবর: মাঠ পর্যায় থেকে ভোটকেন্দ্রের তালিকা কমিশনের অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা (তফসিল ঘোষণার ৭ দিনের মধ্যে পাঠাতে হবে)।

২৩ অক্টোবর-৩০ অক্টোবর: বিভিন্ন প্রকার ম্যানুয়েল ও নির্দেশিকা মুদ্রণ; ভোটের ফল প্রদর্শন, প্রচার, ডিজিটাল মনিটর স্থাপন ও যন্ত্রপাতি সংযোজন (ভোটের ১৫ দিন আগে)।

২২-২৫ অক্টোবর: আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, ঋণখেলাপি সংগ্রহ তথ্য সংগ্রহ, ভোটকেন্দ্র থেকে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ভোট গণনার বিবরণী, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি গঠনসহ সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা তৈরি।

১৭-২৫ অক্টোবর: ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রাথমিক প্যানেল প্রস্তুতে নীতিমালা উপস্থাপন; প্যানেল প্রস্তুতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা সংগ্রহে নির্দেশনা; তফসিল ঘোষণার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্যানেল চূড়ান্ত করবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের শূন্যপদ পূরণে জনপ্রশাসনকে অনুরোধ; সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনে এবং অফিস সময়ের পরে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা;

ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ অনুসারে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নির্ধারণ করে রিটার্নিং অফিসারে কাছে তথ্য সংগ্রহ; ভোটের ১৫ দিন আগে নিয়োগ চূড়ান্ত ও প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত নির্দেশনা।

১৬- ৩১ অক্টোবর: আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক প্রস্তাবনা ও সভার পরিকল্পনা; বিভিন্ন বাহিনী মোতায়েন, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা পাঠানো সংক্রান্ত প্রস্তাব উপস্থাপন (তফসিল ঘোষণার পর কার্যক্রম গ্রহণ)।

প্রশিক্ষণ, প্রচার: অক্টোবরের মধ্যে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ; ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা; আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি ও জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন; প্রশিক্ষণ।

২০-৩০ অক্টোবর: দল ও দলীয়  প্রধানদের প্রচারণা নিয়ে নীতিমালা জারি;

২৫-৩০ অক্টোবর: ইভিএম ব্যবহার পাইলটিং করার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব উপস্থাপন; ইভিএম ব্যবহার উপযোগী করা, প্রচারণা; ইভিএম মকভোটিং সংক্রান্ত পরিকল্পনা; ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ফল সংগ্রহ ও পরিস্থিতি প্রতিবেদন

ব্যয় তদারকি

৩০০ আসনে একটি করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন, প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে মোবাইলে পরিস্থিতি প্রতিবেদন পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সুসংহতকরণ, বেসরকারি প্রাথমিক ফল প্রচার, অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সফটওয়্যার প্রস্তুত, কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশেসহ সার্বিক প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি ৩০ অক্টোবরের মধ্যে নেওয়ার কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।

ফল গেজেটে প্রকাশ পর্যন্ত ৯৯ কাজ

তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী সময় সূচি ও রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হবে।

নির্বাচন ভবন

নির্বাচন কাজে সহায়তায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি; ইসির অধীনে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত বদলি না করা; স্থানীয় সরকারের সহায়তা; আইন শৃ্ঙ্খলা রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা; মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে ঋণখেলাপিরর তথ্য পেতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি তফসিল ঘোষণার দিনই পাঠাবে।

মনোনয়নপত্র দাখিল, প্রাসঙ্গিক তথ্য, প্রার্থীর তালিকাপ্রার্থী, রাজনৈতিক দল, জোট গঠন নিয়ে পরিপত্র ও বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে।

তফসিল ঘোষণার পর দিন থেকে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা, স্বতন্ত্র প্রার্থিতা, হলফনামা, নানা ধরনের কমিটি গঠন বিষয়ে পর্যায়ক্রমে ভোট পর্যন্ত পর্যন্ত ১৮ ধরনের পরিপত্র জারি ও বেশ কিছু নির্দেশনা দেবে ইসি।

প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর আইন শৃঙ্খলা বৈঠক, ব্যালট পেপার মুদ্রণ, নির্বাচনী মালামাল পাঠানো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে।

ভোটের ১২ দিন আগে আইন শৃঙ্খলা মোতায়েন সংক্রান্ত পরিপত্র জারি হবে। ভোটের ৭ দিন আগে জেলা পর্যায়ে পাঠানো হবে নির্বাচন সামগ্রী। ভোটের দিন ইসি সচিবালয় পরিস্থিতি প্রতিবেদন, ফল প্রকাশ ও একীভূত ফল জানাবে।

ভোটের দু দিন পর ইসি ফল অনুমোদন করে নির্বাচিত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা গেজেটে প্রকাশে প্রেসে পাঠাবে। ভোটের তিন দিন পর গেজেট সংসদ সচিবালয়ে যাবে।