অনেকের প্রশ্ন, খতনার সময় পুরোপুরি অজ্ঞান করা বা ফুল অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। দুই শিশু মৃত্যুর ঘটনায় দায় বা ভুল কোথায় তা নিয়েও হচ্ছে কথাবার্তা।
Published : 24 Feb 2024, 12:23 AM
রোজায় স্কুল ছুটির মধ্যে শিশুর খতনা করানোর বিষয়ে ভাবছিলেন ঢাকার এক অভিভাবক। খোঁজ খবরও নিচ্ছিলেন পরিচিতরা তাদের সন্তানদের কোথায় খতনা করিয়েছেন, চিকিৎসক ও হাসপাতাল কেমন, কোথায় খরচ কত? তবে খতনা করাতে গিয়ে পরপর দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় এখন দ্বিধায় পড়ে গেছেন।
তার মতো আরও এক অভিভাবক তাদের সাত বছরের একটু বেশি বয়সী সন্তানের খতনা করানো নিয়ে এখন চিন্তায় পড়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, হাজামদের মাধ্যমে খতনা করানোর সেই পরিচিত পদ্ধতিতে যেতে চান না শিশুর ব্যাথা কমাতে বা সংক্রমণ বা ঘা হওয়া এড়াতে। চিকিৎসকদের মাধ্যমে হাসপাতালে করানোর কথাই বাসায় আলোচনা চলছিল। সেই ভাবনাতেও খটকা হয়ে দেখা দিয়েছে ঢাকার দুই হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে অজ্ঞান করানোর পর দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায়।
বিকল্প আরও কোনো উপায় আছে কি না খুঁজতে গিয়ে কসমেটিক বা লেজার ব্যবহারের তথ্যও পেয়েছেন। এতে খরচ বেশি হওয়ায় এখন তা যাচাই বাছাই করছেন, যোগ করেন এ অভিভাবক।
এ দুই অভিভাবকের মতো অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে খতনার সময় পুরোপুরি অজ্ঞান করা বা ফুল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। দুই শিশু মৃত্যুর ঘটনায় দায় বা ভুল কোথায় তা নিয়ে চলছে নানান কথাবার্তা।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতার পুরনো প্রশ্ন সামনে এসেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন এ নিয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন বলে বিবৃতি দিয়েছেন। দায়িত্বে গাফিলতি বা অবহেলার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্কও করেছেন।
অথচ যুগের পর যুগ ধরে সাধারণভাবেই খতনা হয়ে আসছে রাজধানীসহ দেশের শহর, গ্রাম ও দূরের পল্লীগুলোতে। স্বাস্থ্য সেবার প্রসারে এ যুগেও চিকিৎসকদের মাধ্যমে খতনা করানোর পরিমাণ সামান্য বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
বেশির ভাগ খতনা করছেন কারা?
এখনও হাজামরা সক্রিয় দেশজুড়ে শহর-গ্রাম সবখানেই; তাদের সঙ্গে এ কাজে আরও যুক্ত হয়েছেন স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট আরও অনেকেই, তবে তারা শল্য চিকিৎসক বা শিশু সার্জন নন।
শুক্রবার নরসিংদী পৌরসভার স্কুল মার্কেট থেকে বটতলা পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি ওষুধের দোকানে খতনা করানোর বিজ্ঞাপন দেখা গেছে।
সেই তথ্য ধরে সদর উপজেলার মাধবদীতে বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে সেগুলোতে নিয়মিত খতনা করানোর তথ্য মিলেছে। পাশাপাশি বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালেও খতনা করা হয়ে থাকে।
এদিন একটি ওষুধের দোকানে খতনা করান এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকা থেকে খতনা করানোর ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। প্রতিদিনই তিন থেকে চারটি শিশুর খতনা করান। প্রতিটি শিশুর জন্য ফি নেন ২ হাজার টাকা।
“আমরা অজ্ঞান করি না। পেনিসে ব্যাথানাশক ইনজেকশন দিয়ে খতনা করানো হয়।“
এখন পর্যন্ত কারও কোনো সমস্যা হয়নি বলে দাবি তার।
জেলার সবচেয়ে বড় হাসপাতালেও দিনে এতগুলো খতনা হয় না বলে জানালেন নরসিংদী জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, হাসপাতালে খতনা করানোর লোকবল, সরঞ্জাম আছে। কিন্তু রোগীরা আসে না।
“পরিচিত লোকজন এবং জেলার বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তারা বাচ্চাদের নিয়ে আসে খতনা করানোর জন্য। এছাড়া খুব মানুষ আসে না। যারা আসেন তারা হাজাম দিয়ে খতনা করানোর পর কোনো ঝামেলায় পড়লে আসেন।”
শিশু সার্জনরা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ খতনা হয় তার ১ শতাংশও তারা করেন না। বেশির ভাগ খতনা করান হাজামরা। এর বাইরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারী, পল্লী চিকিৎসক, নার্স এবং বিভিন্ন ওষুধের দোকানেও সামান্য প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিরা করাচ্ছেন খতনা।
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাচারিপাড়ার জয়েন উদ্দিন তার সন্তানকে সম্প্রতি খতনা করিয়েছেন হাজামকে দিয়ে।
একটি ওষুধ কোম্পানির এই বিপণন প্রতিনিধি বলেন, শুধু তার ছেলে নয়। ওই এলাকার ৯৮ শতাংশ ছেলে শিশুর খতনা হাজামরা করান।
“আমাদের খতনা হাজাম করেছেন কোনো সমস্যা হয়নি। আমার ছেলে, ভাতিজা, ভাগিনাসহ সবাইকেই তাদের দিয়েই করানো হয়েছে।”
একটি মেডিকেল ট্রেনিং স্কুল থেকে ডিএমএফ (ডিপ্লোমা অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) কোর্স করে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর বাজারে চিকিৎসাসেবা দেন সাইফুজ্জামান জুয়েল। খতনা করানোর বিষয়েও প্রশিক্ষণ আছে তার। পরিচিতদের মাধ্যমে ডাক পেয়ে মাঝেমধ্যে অনেকের খতনাও করে দেন তিনি।
তবে তিনি বলছেন, ওই এলাকার প্রায় সবাই হাজাম দিয়ে খতনা করায়।
“আমি গত তিন মাসে একজনের খতনা করিয়েছি। উপজেলা হাসপাতালেও এই সুবিধা আছে। কিন্তু মানুষ এখনও হাজাম দিয়ে করায়। হাজাম দিয়ে করাতে গিয়ে কোনো ঝামেলা হলে আমাদের এখানে আসে। তখন সেটা আবার ঠিক করে দিতে হয়।”
ঢাকায় এর উল্টো চিত্র হলেও সবসময় যে তা শল্য চিকিৎসক বা শিশু সার্জনরা খতনা করে দিচ্ছেন তা নয়। এমবিবিএস চিকিৎসক, নার্স, টেকনিসিয়ানসহ স্বাস্থ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই হরহামেশা এ কাজ করছেন।
ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা হারুন অর রশিদের দুই ছেলেকে খতনা করিয়েছেন চিকিৎসকের মাধ্যমে। এদের মধ্যে বড় ছেলেকে অজ্ঞান করতে হয়েছে, ছোটজনকে দেওয়া হয়েছে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া।
হারুন অর রশিদ বলেন, “বড় ছেলে কিছুটা ভয় পাচ্ছিল এজন্য তাকে অজ্ঞান না করে খতনা করাতে চাইছিলেন না চিকিৎসক। আর ছোট ছেলে স্বতঃস্ফুর্তভাবেই রাজি হয়েছিল।”
ঢাকার বড় বা অতিপরিচিত হাসপাতালগুলোতে খতনার খরচ কিছুটা বেশি, ১২ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত । হাসপাতাল ও প্যাকেজ অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে এ সেবার ব্যয়।
সেন্ট্রাল হাসপাতালে এ খরচ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, বলছেন হাসপাতালটির তথ্য কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ রাসেল।
অন্যদিকে অস্ত্রোপচার ছাড়া লেজার দিয়ে খতনা করানোর ব্যয় আরও বেশি। বড় একটি হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের ওখানে এ চার্জ ৪০ হাজার টাকা।
কম পরিচিত বা ছোট হাসপাতাল বা অন্য ক্লিনিকে নেওয়া হয় ৫ থেকে ১০/১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। খরচ কিছুটা কম বলে এমন হাসপাতালেই বেশির ভাগ যান। এর বাইরে পাড়ার ওষুধের দোকান বা পরিচিত নার্সদের মাধ্যমেও খতনা করান অনেকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আশরাফ উল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, খতনা এক ধরনের অস্ত্রোপচার। এজন্য কাজটি শিশু সার্জারির চিকিৎসকদের বেশি করার কথা। তবে বাংলাদেশে ডিগ্রিধারী শিশু সার্জনের সংখ্যা মাত্র আড়াইশর মত। ফলে যত খতনা করা হয় সেগুলোর ১ শতাংশও তাদের হাত দিয়ে হয় না।
“বেশির ভাগ সার্জারি করছে হাজামরা, কিছু করে প্রশিক্ষণ পাওয়া টেকনিশিয়ান, এমবিবিএস পাশ চিকিৎসকরাও করেন কিছু। খতনা করানোর পর কোনো জটিলতা হলে শিশু সার্জনদের কাছে আসে। এক্ষেত্রে জেনারেল ফিজিশিয়ানদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা যেতে পারে।”
ধর্মীয় বিধান অনুসরণ করে মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশে ছেলে শিশুদের খতনা করানো হয়।
খতনার ইংরেজি শব্দ ‘সারকামসিশন’ এটি লাতিন সারকামডায়ার শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ হল চারদিক থেকে কেটে ফেলা। পুরুষের লিঙ্গের অগ্রভাগের কিছু চামড়া চারদিক থেকে কেটে নেওয়ার পদ্ধতির নামই হল সারকামসিশন বা খতনা।
খতনা করাতে অজ্ঞান করা কতটা জরুরি?
চিকিৎসকরা বলছেন, খতনা করানোর সুবিধার জন্য শিশুকে কখনও কখনও পুরোপুরি অজ্ঞান করা ভালো। তবে অচেতন করার কাজটি করতে হবে বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ (অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্ট) দিয়ে। এর আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা এবং যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবেলার মতো সক্ষমতা সেই হাসপাতালের থাকতে হবে। কিন্তু বড় হাসপাতাল ছাড়া বেশির ভাগ ছোট হাসপাতালে স্থায়ী অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্ট ও প্রয়োজনীয় সুবিধা নেই। খতনা করার জন্য প্রয়োজনীয় শল্য চিকিৎসকও নেই।
তবে দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্টের পদ আছে। তবে এমন চিকিৎসকের ঘাটতির তথ্যও বিভিন্ন সময় দেওয়া হয়েছে।
অজ্ঞান বা অচেতন কিংবা অবশ করার জন্য অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার নিয়ম বা স্বাস্থ্য প্রটোকলের বিষয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ান্স এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, যে কোনো ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োজন হলে তা একজন ডিগ্রিধারী অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্ট করবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আশরাফ উল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সঠিক প্রক্রিয়া মেনে খতনা করাতে গেলে কমপক্ষে আধাঘণ্টা সময় লাগে। কম বয়সী শিশুরা এই সময় দিতে চায় না বলে অজ্ঞান করা ছাড়া উপায় থাকে না।
“কিন্তু অজ্ঞান করার কাজটি অবশ্যই একজন প্রশিক্ষিত ডিগ্রিধারী অবেদনবিদ দিয়ে করাতে হবে।“
খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু: সব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে ১০ নির্দেশনা
খতনা করাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ‘মর্মাহত’
স্বাস্থ্যে মাফিয়া চক্র সক্রিয়, দরকার সচেতনতা: হাই কোর্ট
কম বয়সী শিশুদের টিকা, ইনজেকশন দেওয়া কঠিন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেখানে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খতনা করাতে গেলে তারা ভয় পায়, সহযোগিতা করে না। এক্ষেত্রে দুই-তিনজন জাপটে ধরে ভয় দেখিয়ে খতনা করাতে হবে, এটা ভালো কাজ হয় না। এজন্য আমরা জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়া করি না। তবে ৯-১০ বছরের ছেলে, কোঅপারেটিভ সহযোগিতা করলে তাদের লোকাল করা যেতে পারে।”
অধ্যাপক দেবব্রত বণিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যেকোনো অস্ত্রোপচারে অ্যানেস্থেসিয়া জরুরি। অ্যানেস্থেসিয়া প্রশিক্ষিত লোক দিয়ে, সঠিক মাত্রায়, সঠিক পরিবেশে দেওয়া হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে হবে।
“জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খতনা করানো যাবে না এটা যেমন ঠিক না। আবার সব খতনা করাতেই জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া লাগবে এটাও ভুল।“
চেপে ধরে খতনার সুযোগ নেই
সমস্যার মূলে না গিয়ে অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে ভীতি তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিয়ালজিস্টের সভাপতি দেবব্রত বণিক।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক দুটি শিশু মৃত্যুর ঘটনায় সমন্বয়ে কোনো না কোনো ঝামেলা হয়েছে, অবহেলা আছে। কিন্তু এ নিয়ে ভীতি ছড়ানো ঠিক না।
তার ভাষ্য, একটা দুই বছরের শিশুকে চেপে ধরে খতনা করানোর সুযোগ নাই। আবার বড় শিশু হলে সে যদি সহযোগিতা করে তাহলে তাকে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া যেতে পারে।
খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু: দুই চিকিৎসকের জিজ্ঞাসাবাদ কারাফটকে
খতনা করাতে গিয়ে ঝরল আরেক শিশুর প্রাণ, ২ চিকিৎসক গ্রেপ্তার
খতনার সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, অভিভাবকের ক্ষোভ
“কাকে কোন ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া দিতে হবে নির্ভর করছে রোগীর ওপর, সার্জনের ওপর, সুবিধাটি ওই হাসপাতালে আছে কি না আর যিনি অ্যানেস্থেসিয়া দেবেন তিনি প্রশিক্ষিত কি না।”
তার মতে, খতনা যেহেতু জরুরি অস্ত্রোপচার নয়-তাই এটা করাতে তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।
“অভিভাববকরা অ্যানেস্থেসিয়া দিতে ভয় পান আবার বাচ্চা খতনা করাতে রাজি হয় না-এমন পরিস্থিতিতে দুই মাস পর, ছয় মাস পর দেরি করুক। এরমধ্যে বাচ্চাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে তবে খতনা করানো যেতে পারে। আজকেই করাতে হবে এমন না।”
দায় কাদের?
চিকিৎসকরা বলছেন, অ্যানেস্থেসিয়া দুই ধরনের-জেনারেল ও লোকাল। এর মধ্যে লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া হল যেখানে অস্ত্রোপচার করা হবে শুধু সেই অংশটা অবশ করা। জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়য় রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়।
অজ্ঞান করার আগে রোগীর এইচবি (হিমোগ্লোবিন), বিটি (ব্লিডিং টাইম), পিটি (প্রথ্রম্বিন টাইম), এপিটিটি (অ্যাক্টিভেটেড পারসিয়াল থ্রমবোপ্লাস্টিন টাইম) করানো বাধ্যতামূলক।
এসব পরীক্ষা করে জানা যায় রোগীর অ্যানিমিয়া আছে কি না, অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত জমাট বাঁধবে কি না।
এছাড়া নিয়মিত পরীক্ষার অংশ হিসেবে বুকের এক্সরে করতে হয়। তবে বেশির ভাগ হাসপাতাল বিষয়গুলো মেনে চলেন না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোর দুর্বলতা আছে। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই অবেদনবিদ নেই থাকলেও তারা দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেন না।
খতনার জন্য অচেতন করা শিশু আয়ান আর ফিরল না
খতনায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ: শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সেন্টমার্টিনে বদলি
খতনায় শিশুর মৃত্যু: চিকিৎসা সেবার অনুমোদনই ছিল না জে এস ডায়াগনস্টিকের
“সরকারি হাসপাতাল এবং করপোরেট হাসপাতাল ছাড়া কোথাও রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার আগে প্যাকো (প্রি অ্যানেস্থেথিয়াটিক চেকআপ) করা হয় না। অ্যানেস্থেসিয়ার একজন পরামর্শক দিনে কয়টা কেইস করতে পারেন সেটা নির্ধারিত নেই। আবার জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে বেশির ভাগ অ্যানেস্থেসিয়লজিস্ট রোগীর পাশে থাকে না। তারা টিভি রুমে গিয়ে রেস্ট নেন, নয়ত অন্য কাজ করেন। রোগীর দায়িত্বে থাকে নার্স বা ওটি বয়।”
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন পেডিয়াট্রিক সার্জন নিয়মিত খতনা করান। ওই চিকিৎসকও নিজের নাম প্রকাশ করেননি।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতালই প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে খতনা করায় না। এতে হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং শিশুদের অভিভাবকদেরও দায় আছে।
এর ব্যাখ্যায় ওই চিকিৎসক বলেন, “রোগীর লোকজন মানতেই চায় না খতনা একটা সার্জারি। তারা এর জন্য বেশি টাকা খরচ করতে রাজি হয় না। দেখা গেছে হাসপাতাল ১০ হাজার টাকায় চুক্তি করেছে। এখান থেকে সার্জন আর অ্যানেস্থেওলজিস্টকে দেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা। এজন্য রোগী কখন এসেছে, কখন খেয়েছে সেগুলো ইভ্যালুয়েশন করে না, পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে চায় না। খরচ বাঁচিয়ে লাভ করার জন্য কমদামি ওষুধপত্র ব্যবহার করে।
“আর আমাদের দায় আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। অ্যানেস্থেওলজিস্ট আসলো, হাসপাতাল বলল সব ঠিক আছে তিনি তার কাজ করে ফেললেন। সার্জন আসলে রিপোর্ট না দেখেই অস্ত্রোপচার করে ফেললেন। এমন হয়।”
তবে শিশু শল্য চিকিৎসকরা এ ধরনের কাজ খুব একটা করেন না, দাব তার।
অধিদপ্তর কী বলছে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেনারেল, স্পাইনাল, লোকালসহ অ্যানেস্থেসিয়ার অনেক পদ্ধতি আছে। এটা অবশ্যই একজন প্রশিক্ষিত অবেদনবিদ দিয়ে করাতে হবে। আর কোন পদ্ধতিতে করবে সেটা নির্ভর করছে সার্জন এবং অবেদনবিদের ওপর।
তিনি বলেন, শিশু আয়হামকে যিনি অজ্ঞান করেছেন তিনি অবেদনবিদ নন বলে তিনি তথ্য পেয়েছেন। এরকম আরও অনেকে যোগ্যতা না থাকলেও এই কাজ করছেন।
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ
আয়ানের মৃত্যু: স্বাস্থ্যের প্রতিবেদনে অসন্তুষ্ট হাই কোর্ট, তদন্তে নতুন কমিটি
আয়ানের মৃত্যু তদন্তের নির্দেশ, ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে রুল
“যার যে কাজ করার কথা নয় সেটা করা উচিত নয়। একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, যার ডিগ্রি আছে যে হয়তো রোগীকে বাঁচাতে পারবে না কিন্তু কোনো ঘটনা ঘটলে আইনি প্রক্রিয়ায় তার শাস্তি হবে। কিন্তু যে যোগ্য না সারাদেশে এমন শত শত চিকিৎসক এমন অ্যানেস্থেসিয়া দিচ্ছে। এটা ঘোরতর অন্যায়। আপনি যদি নীতিবান না হন তাহলে কিভাবে করবেন।”
মহাপরিচালক বলেন, বিষয়টি নিয়ে আগামী রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অবেদনবিদদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তারা।
“অ্যানেস্থেওলজিস্টদের সোসাইটির সঙ্গে বৈঠক করব। এই ঘটনা উপর্যুপুরি ঘটছে কেন তা তাদের কাছে জানতে চাইব। দুটি ঘটনায় কী সমস্যা হয়েছিল তাও জানতে চাইব।”