তাপমাত্রা যখন ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়, তখন কী ঘটে মানুষের শরীরে? ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে তা বোঝার চেষ্টা করেছেন বিবিসির একজন সাংবাদিক।
Published : 22 Apr 2024, 01:42 AM
বৈশাখের আকাশে সূর্য যেন আগুন ঢালছে, থার্মোমিটারের পারদ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। গরমের এমন দাপট সামনে আরো কঠিন সময়ের আভাস দিচ্ছে।
প্রখর রোদ আর ভ্যাপসা গরমে হাসফাঁস অবস্থার মধ্যে হাসপাতালে বাড়ছে গরমের রোগীর ভিড়। হিটস্ট্রেকে মৃত্যুর খবরও এসেছে। উত্তাপ থেকে শিশুদের বাঁচাতে ছুটি ঘোষণা হয়েছে স্কুল-কলেজে।
দিন যত গড়াচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত এই অভিঘাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
২০২২ সালের তাপদাহে শুধু ইউরোপেই প্রাণ যায় ৬০ হাজার মানুষের। এর পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুলাই মাসকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ মাস’ হিসেবে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তখন বলেন, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যুগ শেষ। চলে এসেছে ‘গ্লোব্লাল বয়েলিং’ এর যুগ।
জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্ব যত উষ্ণ হচ্ছে, মানুষের শরীর ও স্বাস্থ্যের ওপরও তার প্রভাব পড়ছে। এই তাপদাহে মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করেছেন বিবিসি রেডিও ৪ এর উপস্থাপক জেমস গ্যালাঘের।
সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যামিয়ান বেইলির আমন্ত্রণে গত বছর তাপদাহের ওই পরীক্ষায় অংশ নেন গ্যালাঘের। একটি ল্যাবে তাকে বসিয়ে তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এই পরীক্ষায় শরীর ঘেমে ওঠার পাশাপাশি শরীরের ভেতরে যে পরিবর্তন ঘটতে থাকবে, সেই বিষয়ে অধ্যাপক বেইলি সাংবাদিক গ্যালাঘের আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
গ্যালাঘের বলেন, বেইলি তাকে তার একটি পরীক্ষাগারে নিয়ে যান। বায়ুরোধী সেই কক্ষে রাখা ছিল নানা বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম। কৃত্রিমভাবে ওই কক্ষের ভেতরের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অক্সিজেনের মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এর আগেও বেইলির এই কক্ষে এসেছিলেন গ্যালাঘের। কিন্তু আগেরবার এসেছিলেন শরীরে ঠাণ্ডার প্রভাব পরীক্ষা করে বোঝার জন্য।
গ্যালাঘের জানান, পরীক্ষাগারে প্রথম নির্দেশনা অনুযায়ী ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পরিবেশ বেশ আরামদায়কই ছিল। এরপর তাপমাত্রার প্রভাবে তার ত্বক, অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হার্ট ও ব্লাড প্রেসারের অবস্থা বোঝার জন্য ল্যাবের অন্যান্য যন্ত্রাংশের সঙ্গে তার সংযোগ করা হয়।
বেইলি তাকে জানান, ব্লাড প্রেসার, হার্ট বিট রেট ও অন্যান্য শারীরিক সংকেত ভালোভাবেই কাজ করছিল। তার মগজ বা হাইপোথ্যালামাসে বসানো থার্মোস্ট্যাট অনবরত তাপমাত্রা পরীক্ষা করে সিগন্যাল পাঠাচ্ছিল।
তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলে তারা খানিকটা বিরতি নেন। ল্যাবের পরিবেশ তখন আগের চেয়ে গরম হলেও অস্বস্তিকর ছিল না।
গ্যালাঘের জানান, তাপমাত্রা বাড়ানোর পর শরীরে কিছু পরিবর্তন স্পষ্ট হতে থাকে। তার ত্বকে লালচে ভাব চলে আসে।
“আমি ঘামছিলাম। ঘাম একেবারে চেইয়ে পড়ছিল এমন না, তবে ভালোভাবেই ঘামের বিন্দুগুলো স্পষ্ট হচ্ছিল। আর ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরও ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল।”
এরপর তাপমাত্রা ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানো হয়। গ্যালাঘের বলেন, “তখন আমার মনে হচ্ছিল তাপ শরীরে লাগছে।”
তাপের প্রভাবে যা হল
অধ্যাপক বেইলি বলেন, ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কক্ষের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে বা ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হচ্ছিল এমন না, খুব দ্রুতই সেটি গরম হয়ে ওঠে।
“৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়ে একটু বেশি তাপমাত্রা বাড়ানোর বিষয়টি শুনতে বেশি মনে না হলেও সত্যিই এটি শরীরে জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের।”
৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঘেমে-নেয়ে একাকার সাংবাদিক গ্যালাঘের তার ভেজা জামাকাপড় ও তোয়ালে মেঝেতে খুলে রাখেন। এরপর তিনি শুনে অবাই হন যে, এই পরীক্ষায় তার শরীর থেকে ইতোমধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি তরল বেরিয়ে গেছে।
তিনি জানান, পরীক্ষার পর রক্তনালীগুলো ত্বকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হৃদস্পন্দনও অনেক বেড়ে যায় এবং ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় প্রতি মিনিটে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। অতিরিক্ত গরমে হার্টের ওপর এই চাপ থেকে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মত ঘটনায় মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। রক্ত ত্বকের দিকে চলে আসায় মস্তিকে রক্ত প্রবাহ কমে স্বল্প সময়ের জন্য স্মৃতিশক্তিও কমে যায়।
সাংবাদিক গ্যালাঘেরের ওপর চালানো পরীক্ষায় দেখা যায়- কক্ষের তাপমাত্রা ২১ থেকে ৪০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ওঠানোর পর মস্তিস্কের রক্ত সঞ্চালন ৮.৫% কমে যায়, শ্বাস নেওয়ার হার প্রতি মিনিটে ১০-১৫ বার বেড়ে যায়, হার্টবিট রেট প্রতি মিনেটে ৫৪ থেকে ৮৭ বার পর্যন্ত উঠে যায়, শরীরের তাপমাত্রা ৩৬.২ ডিগ্রি থেকে ৩৭.৫ সেলসিয়াসে ওঠে।
এছাড়া এক ঘণ্টার পরীক্ষায় ৪০০ মিলিলিটার ঘাম ঝরে, ত্বকের তাপমাত্রা ৩১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায় এবং স্মৃতিশক্তি পরীক্ষায় ৩০ এর মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় স্কোর ২৩ থেকে কমে ১৭ তে চলে আসে।
আর্দ্রতা
উপস্থাপক জেমস গ্যালাঘের জানান, তার পরীক্ষায় কেবল তাপমাত্রার পরিবর্তন করে শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা হচ্ছিল। কিন্তু পরীক্ষায় বিবেচনার মত আরেকটি বিষয় হল বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতা। এর ফলে কক্ষের ভেতরের পরিবেশ বেশ অস্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। কারণ আদ্রতা শরীরকে তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঠাণ্ডা হওয়ার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
ঘামলেই শরীর শীতল বা ঠাণ্ডা হবে এমন না। সেই ঘাম বাতাসে বাষ্পীভূতও হতে হবে, তাহলেই শরীরে শীতল অনুভূতি পাওয়া যায়। কিন্তু যখন বাতাসে জলের পরিমাণ বেশি থাকে, তখন ঘামের জন্য বাষ্পীভূত হওয়া কঠিন।
গ্যালাঘেরের পরীক্ষার সময় আদ্রতা ৫০%-এ স্থির রাখা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি দল বিভিন্ন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিস্থিতিতে কিছু তরুণদের ওপর পরীক্ষা চালান। শরীরের মূল অংশের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়লে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে সেই বিষয়টি তারা খেয়াল করেন।
এই দলের গবেষক র্যাচেল কোটল বলেন, “শরীরের মূল কাঠামোর তাপমাত্রা বাড়লেই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এর ফলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।”
তিনি বলেন, “উদ্বেগের বিষয় হল, হিটওয়েভ বারবার ঘটে না, দীর্ঘ সময়ও থাকে না কিংবা অনেক বেশি তীব্রও হয় না। কিন্তু এত পরিবেশ আরো আর্দ্র হয়ে ওঠে।”
স্বাভাবিকভাবে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শরীর খাপ খাওয়াতে পারে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি গেলে মাথাঘোরা বা ঝিমুনিভাবের সঙ্গে মূর্ছা যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। শরীরের মূল অংশে অতিরিক্ত তাপমাত্রা টিস্যু, যেমন হার্টের পেশী ও মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। একপর্যায়ে এটি মারাত্মক হয়ে ওঠে।
“একবার শরীরের মূল তাপমাত্রা ৪১-৪২ ডিগ্রির মত বেড়ে গেলে আমরা সত্যিকার অর্থেই ব্যাপক সমস্যায় পড়ি। চিকিৎসা না নিলে হাইপারথার্মিয়ার কারণে তখন কারো মৃত্যুও হতে পারে,” বলেন অধ্যাপক বেইলি।
আর এই বিষয়টিকে বলা হয় ‘হিট স্ট্রোক’।
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে হলে
আইসিডিডিআর’বি বলছে, তীব্র গরমে শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, রিকশাচালক, কৃষক ও নির্মাণশ্রমিকদের মত শ্রমজীবী, স্থুলকায় ব্যক্তি এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ, বিশেষ করে যাদের হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ আছে, এমন ব্যক্তিরা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন।
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে আইসিডিডিআরবি।
দিনের বেলা সম্ভব হলে বাইরে বের না হওয়া, রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। বাইরে বের হলে ছাতা, টুপি, ক্যাপ বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে
হালকা রঙের ঢিলেঢালা সুতির জামা পরতে হবে
প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে
সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে, বাসি ও খোলা খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
দিনের বেলা একটানা শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকতে হবে
সম্ভব হলে একাধিকবার শরীরে পানির ঝাপটা দেওয়া বা গোসল করা
প্রস্রাবের রঙের দিকে নজর রাখতে হবে। প্রস্রাবের রং হলুদ বা গাঢ় হলে অবশ্যই পানি পানের পরিমাণ বাড়াতে হবে
ঘরের পরিবেশ যেন অতিরিক্ত গরম বা ভ্যাপসা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
বেশি অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
আরো পড়ুন-
বাতাসে যেন ’আগুনের হল্কা’; যশোর-চুয়াডাঙ্গায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ