মানব সভ্যতার দ্রুত বিকাশ শুরু হয়েছে শিল্পায়নের সূচনায়, প্রকৃতি বিনাশও গতি পেয়েছে তখনই।
Published : 12 Nov 2022, 09:17 AM
সভ্যতা গড়ার নেশায় মানুষ বদলে দিয়েছে প্রকৃতিকে, এখন তার ফল মিলছে হাতেনাতে।
মানুষের কর্মকাণ্ড বাড়াচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। আর তাতে মানুষের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হুমকির মুখে পড়ছে।
এভাবে চলতে থাকলে এই পৃথিবীর তাপমাত্রা এতটাই বেড়ে যাবে যে মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
একদিকে বাড়বে খরা, অন্যদিকে বরফ গলে উঁচু হতে থাকবে সমুদ্রপৃষ্ঠ। তাতে তলিয়ে যাবে বহু নিচু এলাকা। চরম আবহাওয়াই তখন হয়ে উঠবে স্বাভাবিক নিয়ম।
কেবল মানুষ নয়, এই পৃথিবীর বহু প্রাণের জন্যই নেমে আসবে বিপর্যয়।
মানুষের কর্মকাণ্ডই মানুষকে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এর সমাধান কী?
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষ যা যা জানতে পেরেছে, তা সংক্ষেপে, সহজ করে তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
জলবায়ু বদলাচ্ছে কীভাবে?
কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বায়ুমণ্ডলের পরিস্থিতিই হল আবহাওয়া। বাতাসের উষ্ণতা, আর্দ্রতা, বায়ু চাপ, বায়ুপ্রবাহ, মেঘ-বৃষ্টির পরিসংখ্যান দিয়ে আবহাওয়ার পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আর কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বহু বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে বলা হয় জলবায়ু।
আবহাওয়ার ওই গড় অবস্থা বদলে যাওয়া মানে হল, জলবায়ু বদলে যাচ্ছে।
মানুষ এখন জলবায়ুতে যে দ্রুত পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে, তার মূল কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। মানুষ খনি থেকে তেল, গ্যাস আর কয়লা তুলছে, তা ব্যবহার করছে শক্তি উৎপাদনের জন্য। এসব জ্বালানি দিয়েই কারখানা আর যানবাহন চলছে, ঘরে ঘরে চলছে সব বৈদ্য্যুতিক সরঞ্জাম।
শক্তি তৈরির জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি যখন পোড়ানো হয়, সেখান থেকে বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, এর বেশিরভাগটাই কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2)।
এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন গ্যাস যত বাড়বে, পৃথিবীর তাপমাত্রাও বাড়তে থাকবে।
মানুষের কর্মকাণ্ড জলবায়ুকে কতটা বদলে দিয়েছে, একটি পরিসংখ্যান দিলেই তা বোঝা যায়।
উনিশ শতকের তুলনায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এখন ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। আর এই সময়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিপর্যয় এড়াতে হলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। নিশ্চিত করতে হবে, যেন ২১০০ সাল পর্যন্ত সময়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে।
উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি কমিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ যদি না নেওয়া হয়, তাহলে এই শতকের শেষে তা ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে।
পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে, যার ফল হবে ভয়ঙ্কর। এক দিকে তাপদাহে জীবন বিপন্ন হবে, অন্য দিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উদ্বাস্তু হবে বহু মানুষ। বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। পরিস্থিতি সত্যিই সেরকম হলে সংশোধনের কোনো উপায় আর থাকবে না।
প্রভাব পড়ছে কোথায় কতটা
এর প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে চরম আবহাওয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আরও বেশি ভয়ঙ্কর রূপ পাচ্ছে। আর তাতে হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা।
এখন তাপমাত্রা যদি আরও বাড়তে থাকে, অনেক এলাকায় চাষের ক্ষেত পরিণত হবে মরুভূমিতে। তার মানে সেসব এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
পূর্ব আফ্রিকা এ নিয়ে টানা পঞ্চম মৌসুম পর্যাপ্ত বৃষ্টি ছাড়াই পার করল। ওই এলাকার পরিস্থিতি ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে দুর্ভিক্ষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আশঙ্কা।
বাড়তি তাপমাত্রা মানে হল দাবানলের বাড়তি ঝুঁকি। গত গ্রীষ্মে ইউরোপ তা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছে। জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে জার্মানি ও ফ্রান্সে স্বাভাবিক গড়ের চেয়ে সাতগুণ বেশি এলাকার বন দাবানলে পুড়েছে এবার।
আবার সাইবেরিয়ার মত এলাকায় গলে যাচ্ছে বরফের প্রান্তর। সেই বরফস্তরে শত শত বছর ধরে আটকে থাকা গ্রিনহাউজ গ্যাস মিশছে বায়ুমণ্ডলে। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।
অনেক এলাকায় ঘটছে ঠিক উল্টোটা। অতিবৃষ্টি ডেকে আনছে রেকর্ড ভাঙা বন্যা। সাম্প্রতিক সময়ে চীন, পাকিস্তান, নাইজেরিয়ায় দেখা গেছে এমন চিত্র।
সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে গরিব দেশগুলোর মানুষকে, কারণ বদলে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। উন্নয়নশীল অনেক দেশে এরই মধ্যে সেই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।
কেবল ডাঙার জীবন না, হুমকিতে পড়ছে সাগরের প্রাণ ও প্রতিবেশ। ২০২২ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে করা এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, সাগরের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রাণী প্রজাতি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে পশুপাখির জন্য খাবার আর পানি পাওয়া আরও কঠিন হবে, তৈরি হবে অস্তিত্ব সঙ্কট। যেমন মেরু অঞ্চলে বরফই যদি গলে যায়, মেরু ভালুকও বাঁচতে পারবে না। আর হাতিদের বেঁচে থাকার জন্য দিনে দেড়শ থেকে তিনশ লিটার পানি পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠবে।
মানুষ যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতিতে লাগাম দিতে না পারে, এই শতকেই পৃথিবী থেকে সাড়ে পাঁচশ প্রজাতি হারিয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
কোন অঞ্চলের কী অবস্থা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একেক এলাকায় একেক রকম। কিছু এলাকা অনেক বেশি উষ্ণ হয়ে উঠছে, কোথাও বৃষ্টি বেড়ে গেছে অনেক বেশি, কোথাও আবার খরা বাড়ছে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখা না যায়, তাহলে কোথায় কী ঘটবে তার একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
>> যুক্তরাজ্য আর ইউরোপে বাড়বে অতিবর্ষণ, তাতে বাড়বে বন্যার ঝুঁকি।
>> মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাপদাহের ভয়াবহতা বাড়বে। যেসব এলাকায় এখন কৃষিকাজ হয়, সেগুলো মরুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
>> সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে যেতে পারে প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপ দেশগুলো
>> আফ্রিকার অনেক দেশে খরা আর খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে।
>> খরার কবলে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, অন্যান্য এলাকায় বাড়তে পারে ঝড়ের তাণ্ডব।
>> অস্ট্রেলিয়াকে পুড়তে হতে পারে অনেক বেশি গরমে, সঙ্গী হতে পারে খরা।
সরকারগুলো কী করছে?
কেবল সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে একমত হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
২০১৫ সালে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক শিল্পায়ন যুগের তুলনায় যদি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখার জন্য যা করা দরকার, তা তারা করবে।
ওই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে কার্বন গ্যাস নির্গমণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। কোন দেশ কীভাবে কতটা দ্রুত তা কমিয়ে আনতে পারে, সেই লক্ষ্য ঠিক করতে মিশরে শুরু হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭ এ আলোচনা করবেন বিশ্ব নেতারা।
অনেক দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ‘নেট জিরো’ পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইতোমধ্যে। এর মানে হল, তারা গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনবে এবং বাকিটার ভারসাম্য আনবে সমপরিমাণ কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সেজন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো, বড় কোম্পানিগুলো এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে অভ্যাসেও বড় পরিবর্তন আনতে হবে।
ব্যক্তি কী করতে পারে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে ছোটখাটো অভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমেও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সামষ্টিকভাবে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব।
উড়োজাহাজে চড়া কমিয়ে দেওয়া যায়
গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে কিংবা বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করে
মাংস এবং ডেইরি পণ্য খাওয়া কমিয়ে দিয়ে
দৈনিক জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে এনে
ঘরের কাজে জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে
শীতের দেশে ঘর গরম করার কাজে গ্যাসনির্ভর হিটারের বদলে ইলেক্ট্রিক হিট পাম্প ব্যবহার করে