দুই বছরে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ। খরচের তুলনায় দ্বিগুণ মুনাফায় খুশি চাষিও।
Published : 04 May 2024, 11:46 PM
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সোহেল মিয়া সরিষা চাষে ঝুঁকে বেশ লাভবান হয়েছেন।
মণপ্রতি উৎপাদন খরচ তার ১২০০ টাকা, গত বছর বিক্রি করেছেন তিন হাজার করে, এবার দাম কমলেও পেয়েছেন আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ খরচের দ্বিগুণ লাভ তার।
সোহেল মিয়ার এই আয়টা একেবারেই নতুন। আগে আমন ধান কাটার পর এসব জমি পড়ে থাকত। একেবারে কিছুই না করার চেয়ে সরিষা চাষ করতে গিয়ে বেশ ভালোই হয়েছে।
অর্থাৎ লাভের ওপর দ্বিগুণ লাভ পেয়ে চওড়া হাসি তার মুখে। এবার ৭২ মণ সরিষা বিক্রি করেও বীজ হিসাবে ১১ মণ সংরক্ষণ করেছেন।
এই কৃষকের নতুন এই ফসল চাষে জড়িয়ে পড়া কৃষি বিভাগের একটি বিশেষ পরিকল্পনার অংশ। ভোজ্যতেল আমদানিতে বিপুল খরচ কমিয়ে আনতে দেশেই ৪০ শতাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সরিষার মত তেলবীজের উৎপাদন বাড়াচ্ছে কৃষি বিভাগ।
সরিষা ছাড়াও সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, বাদামসহ নানা ধরনের তেলবীজ হয় দেশে। ধানের কুঁড়ার তেল সম্ভাবনা জাগিয়েও ডানা মেলতে পারেনি সেভাবে। তবে সরিষা চাষের আওতা আর উৎপাদন দুটোই দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নতুন জাত লাভবান করছে চাষিদের।
আমনের পর পড়ে থাকা জমিতে সরিষার নতুন দুটি জাতে বাজিমাত হচ্ছে চাষিদের।
কৃষি বিভাগের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত দুই বছরে দেশে সরিষার উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সোহেল মিয়া যে হারে লাভবান হয়েছেন, অন্য এলাকায় আর্থিক হিসাবে মুনাফা হয়েছে তার চেয়ে বেশি। তবে দেশের দক্ষিণে সূর্যমুখী, সয়াবিনের মতো বীজের উৎপাদন বেশি হয়, সেখানে ঢুকতে পারছে না সরিষা।
উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচানোর লক্ষ্য
২০২০-২১ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৮৫ কোটি ডলার, সে সময় এটি ১৬ হাজার কোটি টাকার সমান ছিল। বিশ্ববাজারে মূল্য বৃদ্ধির কারণে পরের দুই বছরে তা ছাড়ায় ২৮৯ কোটি ডলার। টাকার দরপতনের কারণে দেশের মুদ্রায় তা ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
২০২০ সালে দেশে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ৮০ টাকা থেকে ৯০ টাকার মধ্যে থাকলেও পরের দুই বছরে দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এখন অবশ্য কিছুটা কমেছে।
সয়াবিন তেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সরিষার তেলের দামও। বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিলিটার বোতলের সয়াবিন তেল ১৬৫ থেকে ১৬৭ টাকা আর কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডভেদে বোতলের সরিষার তেল ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে।
সাবেক কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা দেশে উৎপাদিত সরিষাসহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করেই খাবার তৈরি করতেন। ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দখলে চলে যায়। কিন্তু দেখা গেছে, আমাদের দেশে উৎপাদিত তেলই বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। তাই আমরা তেল বীজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে চাই।”
সরকার দেশে তেলবীজের উৎপাদন বাড়িয়ে ভোজ্যতেলের দেশীয় জোগান ১২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছে।
২০২২ সালে তখন সরিষা, তিল ও সূর্যমূখী দানা থেকে প্রায় ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়েছে। সেটি বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদন ১২ লাখ টন করতে চায় কৃষি বিভাগ।
সাফল্য মূলত সরিষায়
২০২০ সালে দেশে আট লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে তেলবীজ আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে সরিষা চাষ হয় ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে।
২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১৬ লাখ এবং পরের বছরে অর্থবছরে ২৩ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনার দ্বিতীয় বছর শেষে আবাদ ৬২ শতাংশ বৃদ্ধির খবর দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়; তবে মূল সরিষার আবাদ বেড়েছে শতভাগ। দ্বিতীয় বছরে এসে চাষের আওতায় সাড়ে আট লাখ হেক্টর থেকে হয়েছে ১৪ লাখ। এর মধ্যে সরিষার আবাদই হয়েছে ১২ লাখ হেক্টরে। অর্থাৎ দুই বছরে চাষের আওতা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
আবাদ বাড়ায় সরিষা উৎপাদন দুই বছরে পৌনে ৯ লাখ টন থেকে বেড়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ টন হবে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।
অন্যান্য তেলবীজে সাফল্য কম
সয়াবিনের চাষের আওতা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবশ্য সুখবর নেই। ৮৬ হাজার ৩৯ হেক্টর থেকে ৪৪১ হেক্টর বেড়েছে চাষের আওতা। উৎপাদন এক লাখ ৫৪ হাজার ৯৫৬ টন থেকে বাড়বে আড়াই হাজার টনের মত।
সূর্যমুখীর আবাদও অতটা বাড়েনি। উৎপাদন ২৮ হাজার টনের কাছাকাছি থেকে কিছুটা বেড়ে ৩২ হাজারের কাছাকাছি যাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
তিলের উৎপাদন গত বছরের আড়াই হাজার টন থেকে বেড়ে এবার ৩ হাজার ছাড়ানোর আশা করছে কৃষি বিভাগ।
তবে চিনাবাদামের চাষ বেড়েছে। ৮৭ হাজার হেক্টর থেকে ৯৬ হাজার ছুঁইছুঁই হয়ে গেছে। উৎপাদনও এক লাখ ৬৭ হাজার টন থেকে বেড়ে এবার এক লাখ ৯৩ হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশায় কৃষি বিভাগ।
সব মিলিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল হয়েছিল ১৫ লাখ টনের কিছু বেশি। প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে এবার তা ২১ লাখ টন ছাড়ানোর আশা করা হচ্ছে।
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে যেসব জমিতে কিছুই উৎপাদন হয় না, সেখানে যেন কিছুটা হয়। ভোলা, নোয়াখালী ও খুলনার লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হচ্ছে।“
সাবেক কয়েকজন কৃষি সচিব বলছেন, জোর দিতে হবে সূর্যমুখী, সয়াবিন ও রাইনব্রান বা ধানের কুঁড়ার তেলেও। তাহলেই ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ সহজ হবে।
সরিষায় সাফল্য কেন
কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরিষার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষকরা উৎসাহ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেছিল। এখন সরিষা ও সরিষার তেলের দাম কমতির দিকে। তারপরেও বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিয়ে ও পতিত জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে এসে আমরা লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে যাচ্ছি।”
অবশ্য সরিষা চাষ করতে গিয়ে আলু ও পেঁয়াজের উৎপাদন কিছুটা কমেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চাষিদের সরিষায় ঝোঁকার কারণ বোঝা গেল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার তেলবিল এলাকার চিত্রে।
সেখানে এবার ৪০০ একর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। কৃষকদের কেউ কেউ কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে বীজ ও সার পেয়েছিলেন প্রণোদনা হিসাবে। তবে প্রণোদনার হিসাব বাদ দিলেও বেশ লাভ থাকছে তাদের।
কৃষক সোহেল মিয়া কাঠাপ্রতি উৎপাদন পেয়েছেন ৫০ থেকে ৫২ কেজি। তার মণপ্রতি খরচ ১২০০ টাকা, বিক্রি করেছেন আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ বিনিয়োগের দ্বিগুণ মুনাফা।
সোহেল মিয়ার এই আয়টা একেবারেই নতুন। আগে আমন কাটার পর এসব জমি পড়ে থাকত। একেবারে কিছুই না করার চেয়ে সরিষা চাষ করতে গিয়ে বেশ ভালোই হয়েছে।
সরিষার উৎপাদন বাড়ায় এলাকার মানুষের ভোজ্যতেল ব্যবহারের অভ্যাস পাল্টে গেছে বলেও জানালেন এই চাষি। তিনি বলেন, “সবার সইষ্যার তেল খায়া অভ্যাস হয়া গেছে। ঘানিত্তে থেকে তেল ভাঙায়া রান্নাবাড়া করে।
“আমিও এইবার একমণ সরিষা ভাঙাইছি। ১৬ লিটারের মত তেল পাইছি। নিজেরা খাই, আত্মীয় স্বগনরেও দিছি। লিটারে খরচ ১৬০ টাকার মত। হাটে বেচা অয় ১৭০।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ শাখার উপপরিচালক মোছা. নাছরিন আক্তার বানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বছর যেখানে ৯ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল, এবার আমরা সেটা বাড়িয়ে ২৬ হাজার ৫৮০ হেক্টরে উন্নীত করতে পেরেছি।
“রোপা আমনের আবাদ শেষে পতিত জমিকে এবার টার্গেট করা হয়েছিল। ফলে অন্য কোনো ফসল বা শাক সবজির চাষাবাদ বাদ দিতে হয়নি। বারি-১৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা বীজে ফলন ভালো। ৮০ থেকে ৮৫ দিনে ফসল ঘরে তোলা যায়।”
আগামী বছর সাড়ে ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের আশা করছেন এই কর্মকর্তা।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ দুলাল উদ্দিন বলেন, “রোপা আমন ও বোরো মওসুমের মাঝামাঝি সময়ে তিন মাসের গ্যাপ থাকে। সেই সময়ে সরিষা চাষের কৌশল নেওয়া হয়েছে।
“জেলায় ৩৫ হাজার ৪০০ কৃষককে এক কেজি করে সরিষা বীজ ও ২০ কেজি করে সার দেওয়া হয়েছে। এভাবে এবার আমরা উৎসাহিত করেছি।“
এর সুফলও মিলেছে। গত বছর চাষ হয়েছিল ৫৮ হাজার হেক্টরে, এবার বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৮১ হাজার ৫৪০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার ২৮৫ টন।
উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম কমে যাওয়ার তথ্য দিয়ে কৃষিবিদ দুলাল বলেন, “গত বছর প্রতিমণ ৩৫০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছিল। এবার আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করছে।
“তবে দাম কমলেও কৃষক এখনও লাভবান হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে চাষ করতে ৩৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে। ফলন ভালো হলে ৫ থেকে ৬ মণের মত হয়। ফলে অনেক লাভ থাকে।”
দক্ষিণে সাফল্য কম
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সরিষার বদলে সয়াবিন, বাদাম ও সূর্যমুখী তেলবীজ চাষের প্রচলন রয়েছে। তবে ভালো দাম না থাকায় এসব তেলবীজের আবাদ বাড়াতে উৎসাহিত হচ্ছেন না কৃষকরা।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাসান ওয়ারিসুল কবীর বলেন, “এবার সরিষার আবাদ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কমেছে।”
এখানে সূর্যমুখী তেলের ভালো আবাদ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “কৃষকরা বীজ ভাঙিয়ে নিজেদের পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেন। স্থানীয়ভাবে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা লিটারে সূর্যমুখী তেল বিক্রি হয়।”
সূর্যমুখী ও ধানের কুঁড়ার তেলে জোর দেওয়ার পরামর্শ
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কম সময়ে উৎপাদনে আসে এমন বীজ না থাকায় এতদিন সরিষার দেশীয় জোগান বাড়ানো যাচ্ছিল না। এখন যেসব বীজ এসেছে, আবাদের সময়ে কমেছে। ফলে কৃষকও সরিষা চাষে যুক্ত হচ্ছে।
তবে এই তেল এখন বেশিরভাগ মানুষ খায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “কেবল সরিষা বীজ দিয়ে দেশীয় জোগান থেকে ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ কঠিন হবে। সূর্যমুখী ও রাইসব্রান (ধানের কুঁড়ার তেল) তেলের জোগান বাড়াতে হবে।”
তার বিবেচনায়, সূর্যমুখী চাষের ক্ষেত্রে এখন বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পর্যাপ্ত কারখানা না থাকা। এর ফলে কৃষক সূর্যমুখীর ভালো দাম পাচ্ছে না। আবার এখন যে উৎপাদন হচ্ছে, তার ওপর ভর করে বড় কারখানা করাও কঠিন। কারণ, বছরের বেশিরভাগ সময়ই তখন কারখানা বন্ধ করে রাখতে হবে।
ধানের কুঁড়ার তেল উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় সেদিকে নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “সমন্বিত কিছু মিলিয়ে উদ্যোগ নিলে এক পর্যায়ে হয়ত দেশীয় জোগান ৪০ শতাংশে উন্নীত করা যাবে।”
পুরনো খবর