ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ সঙ্কটে পড়ার প্রেক্ষাপটে আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশীয় তেলবীজ উৎপাদন ৪ গুণ বাড়িয়ে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদার অর্ধেকটা দেশ থেকেই মেটানোর একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
Published : 07 Jun 2022, 09:07 PM
এজন্য সরিষা, সূর্যমুখী, তিল, বাদাম, সয়াবিনসহ অন্যান্য তেল বীজ চাষাবাদে সার-বীজসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
সরিষার তেল, বাদাম তেল, তিলের তেল ও নারিকেল তেলের উপর ভর করে এক সময় ভোজ্য তেলের শতভাগ জোগানই দেশ থেকেই হত। গত পাঁচ দশক ধরে ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম সুপার তেল সেই জায়গা দখল করে নেয়।
কৃষি সচিব সায়েদুল ইসলাম বলেন, “আমাদের পূর্বপুরুষরা দেশে উৎপাদন থেকে আসা বাদাম তেল, নারিকেল তেলসহ অন্যান্য তেল ব্যবহার করেই খাবার তৈরি করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই বাজার আমদানিনির্ভর সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দখলে চলে যায়। কিন্তু দেখা গেছে, আমাদের দেশে উৎপাদিত তেলই বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। আমরা আবারও দেশে তেল বীজের উৎপাদন বাড়িয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে চাই।”
কোভিড মহামারীর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে দেশের হেঁশেলেও।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন পাম তেল এবং ৭ লাখ ৮০ হাজার টন সয়াবিন আমদানি হয়েছে। মোট ২১ লাখ ৩৫ হাজার টন ভোজ্য তেল আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৮৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।
দাম বাড়ায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার পাম ও সয়াবিন তেল আমদানি করতে হয়েছে।
বর্তমানে দেশে সরিষা, তিল ও সূর্যমূখী দানা থেকে প্রায় ৩ লাখ টন তেল উৎপাদন হয়। অর্থাৎ দেশের মোট চাহিদা ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৮৮ ভাগ আমদানি থেকে এবং ১২ ভাগ দেশীয় জোগান থেকে পূরণ হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আট লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে তৈলবীজ আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে সরিষার তেল আবাদ হয় ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।
সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এই আবাদ ৯ লাখ ২০ হাজার হেক্টর, পরের বছর ১৬ লাখ হেক্টর এবং তার পরের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৩ লাখ হেক্টর জমিতে তৈলবীজ আবাদ করা হবে।
উৎপাদন বাড়বে যেভাবে
ভিত্তিবছর ২০২১-২২ সালে ৯ লাখ টন সরিষা, সূর্যমুখী ও তিল, বাদাম ও সয়াবিন বীজ উৎপাদিত হয়েছিল যেখান থেকে পাওয়া গিয়েছিল প্রায় ৩ লাখ টন তেল।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব হচ্ছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১৩ লাখ টন তৈলবীজ উৎপাদন সম্ভব হবে, যা থেকে পাওয়া যাবে ৪ লাখ টন তেল। পরের বছর বীজের উৎপাদন বেড়ে হবে ২২ লাখ টন, যা থেকে তেল আসবে ৭ লাখ ১২ হাজার টন। পরের বছর ২০২৪-২৫ সালে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন তৈলবীজ উৎপাদন হবে; যাতে ১১ লাখ টন তেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
হিসাব করে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ সাল নাগাদ দেশে উৎপাদিত সরিষা, সূর্যমুখী ও তিল থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৪০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। আর এর সঙ্গে বাদাম ও সয়াবিন বীজ হিসাব করলে চাহিদার ৪৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যাবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কীভাবে আগামী তিন বছরে ধানের আবাদ ও উৎপাদনের বিঘ্ন না ঘটিয়ে তেলের উৎপাদন বাড়াতে পারি, তা নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।
“তিন বছরের জন্য আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি যা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।”
কী আছে পরিকল্পনায়?
কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক বলেন, সাধারণত দেশের প্রচলিত সরিষা চাষে প্রতি হেক্টর জমিতে ৭০০ কেজি সরিষার বীজ আসে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এমন কিছু জাত উদ্ভাবন করেছেন যেটার উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ২ টন বীজ উৎপাদন করা সম্ভব।
“নতুন জাতের সরিষার গাছগুলোর উচ্চতা মানুষের মাথার সমান। আগে যেসব গাছ দেখেছি সেগুলো ছিল আমাদের হাঁটুর সমান। শতকরা ৩০ ভাগ জমিতে এখনও কম উৎপাদনশীল টরি-৭ সরিষা আবাদ হয়। আমরা শতভাগ জমিতে উচ্চ ফলন শীল সরিষার আবাদ হবে।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে উচ্চফলনশীল সরিষার তালিকায়, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, ধলি, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮, বারি সরিষা-১৩, রাই ও দৌলত সরিষার কথা বলা আছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, “সরিষা লাভজনক হয় না বলে চাষিরা এটা উৎপাদনে যেতে চান না্। সেজন্য ধানের উৎপাদন না কমিয়ে সরিষা চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কিছু ধানের জাত আবিষ্কার করেছে, যেগুলো ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে পেকে যায়। সাধারণ ধান পাকতে ১৪০ থেকে ১৬০ দিন প্রয়োজন হয়। যেসব প্রজাতির ধান কম সময়ে ফলন দেয় (স্বল্পকালীন) সেসব ক্ষেত্রে স্বল্পকালীন সরিষা চাষাবাদ করলে তা অতিরিক্ত ফসল হিসাবে বিবেচিত হয়। ধানটা কেটেই সরিষা বপণ করা যাবে। ৮০ থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে পেকে যাবে। ধানের উৎপাদন ঠিক রেখে সরিষা উৎপাদনের পর আবার বোরো ধান আবাদ শুরু করা যাবে। ফলে সরিষাটা একটা অতিরিক্ত ফসল হিসাবে পাচ্ছি। এর উৎপাদন খরচও হবে অনেক কম।”
২০ লাখ হেক্টর জমিতে স্বল্প সময়ে ফলন আসা আমন ধান চাষ হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যদি ৫ লাখ হেক্টর জমিতেও স্বল্পকালীন উচ্চফলনশীল সরিষা চাষ করতে পারি, তাহলে বিরাট পরিমান উৎপাদন বাড়াতে পারবে। সরিষার মাধ্যমে এক বিঘা জমি থেকে একজন কৃষক ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত আয় করতে পারবে। এতে কৃষকের আয় বাড়বে, অতিরিক্ত সরিষার উৎপাদন হবে এবং তেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।
“আমরা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেছি। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই পরিকল্পনা আমরা মাঠে বাস্তবায়ন করবো। তার জন্য যে বীজ, সার ও অন্যান্য প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করবো,” বলেন কৃষিমন্ত্রী।
তৃতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে চরাঞ্চলে বা উপকূলীয় এলাকায় বাদামের চাষ বৃদ্ধি। কী করে চর এলাকার পতিত জমিতে বাদাম চাষ বাড়াতে হয়, সেই পথও খুঁজছেন বলে জানান তিনি।
দেশের উপকূলীয় এলাকাকে কেন্দ্র করে সয়াবিন ও সূর্যমুখীর চাষাবাদ বাড়ানোর পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানান তিনি।
আশাবাদী কণ্ঠে রাজ্জাক বলেন, “এছাড়া রয়েছে সয়াবিন। এটা আমাদের এলাকার জন্য খুব উপযোগী না। কিন্তু আনন্দের কথা হচ্ছে আমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের দেশের জন্য উপযোগী কিছু জাত উদ্ভাবন করেছেন যেগুলোর উৎপাদন ভালো। নোয়াখালীর সুবর্ণচর, ভোলার চরফ্যাশনসহ বিভিন্ন এলাকায় খুবই ভালো হচ্ছে। সয়াবিনকে বলা হয় গোল্ডেন বিন, এই বীজে ৪০ শতাংশ প্রোটিন, ১৮ ভাগ তেল থাকে। উপকূলীয় এলাকায় ফসলগুলো ভালো হচ্ছে। আরেকটা হলো সূর্যমুখী। এটারও সম্ভাবনা ভালো। এগুলো ছাড়ানোর মেশিন ছিল না। আমাদের বিজ্ঞানীরা বীজ ছাড়ানো ও তেল বের করার মেশিনের ব্যবস্থা করেছেন।”