২১ অগাস্ট মামলার আপিল শুনানি শুরু হাই কোর্টে

আগামী বছরের শুরুর দিকে এই শুনানি শেষ হবে বলে আশা করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2022, 12:47 PM
Updated : 5 Dec 2022, 12:47 PM

দেড় যুগ আগে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় বিচারিক আদালতের চার বছর আগে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় অনুমোদন এবং দণ্ডিতদের আপিল আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে হাই কোর্টে।

সোমবার বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়।

প্রথম দিন শুনানির পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আগামী বছরের শুরুর দিকে এই শুনানি শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তাদের প্রত্যাশা নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকবে হাই কোর্টে।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ওই সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়।

নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলার রায় হয়। এতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

ট্রাইব্যুনালে দেওয়া রায়ের চার বছর পর আপিলের শুনানিতে এল হত্যা মামলাটি।

কোনো মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে দণ্ডিতরা আপিল না করলেও সেই দণ্ড কার্যকরে হাই কোর্টের অনুমতি লাগে। এ মামলার শুনানি চূড়ান্তভাবে শেষ হলে মৃত্যুদণ্ড পাওয়াদের দণ্ড কার্যকরে অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হবে হাই কোর্টে। পাশাপাশি একইসঙ্গে দণ্ডিতদের আপিলগুলোও নিষ্পত্তি হবে। পেপারবুক পড়ার মাধ্যমে শুরু হয়েছে সেই অনুমোদন ও আপিল শুনানির প্রাথমিক পর্ব।

সোমবার শুনানি শুরুর পর এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম আমিন উদ্দিন। তিনি জানান, সোমবার এজাহারের পর অভিযোগপত্রের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে।

আগামী বুধবারের মধ্যে অভিযোগপত্র পড়া শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এর আগে গত বছরের অগাস্টে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, “পেপারবুক রেডি হয়ে আছে। পলাতক আসামিদের পক্ষে মামলা করার জন্য আদালত রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবীও নিয়োগ দিয়েছে। অর্থাৎ মামলাটি শুনানির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

অন্যদিকে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম সেসময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স মামলার শুনানি হয় বছর এবং ক্রম অনুসারে। এখন হাই কোর্টে ২০১৫-১৬ সালের মামলাগুলো চলছে। নম্বর এবং বছরের ক্রমানুসারে যদি শুনানি হয়, আরও চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যাবে।

“কিন্তু এ মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে রায় হওয়ার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডেথ রেফারেন্স রেকর্ড হয়েছে এবং পেপারবুকও প্রস্তুত করা হয়েছে। মামলাটি এখন শুনানির জন্য প্রস্তুত আছে। গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধান বিচারপতি চাইলে মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করে দিতে পারেন।”

কী ছিল রায়ে

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেওয়ার শেষ পর্যায়ে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে ঘটনাস্থলে ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ জনকে হত্যা করা হয়।

ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন।

মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

নানা রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রতিকূলতা শেষে এ ঘটনার ১৪ বছর পর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার রায় দেয়।

রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর, উপমন্ত্রী পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ।

পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যার দায়ে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে আদালত।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।

তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।

নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে উচ্চ আদালতের অনুমোদন লাগে। সেই অনুমোদনের জন্য যে আবেদনটি (রায় ও মামলার নথিসহ) করা হয় সেটি ‘ডেথ রেফারেন্স’ নামে পরিচিত।

বিচারিক আদালতে রায়ের দেড় মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ডেথ রেফারেন্সসহ মামলার নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়।

মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও রায়সহ যাবতীয় নথিপত্র হাই কোর্টে দাখিল করা হয়।

হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের দুই মামলায় রায়ের কপিসহ মোট ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার এ নথি হাই কোর্টের রেকর্ড রুমে সংরক্ষণ করা হয়।

এর মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলার রায় ৩৬৯ পৃষ্ঠার এবং হত্যা মামলার রায় ৩৫৬ পৃষ্ঠার।

এদিকে রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডপ্রাপ্তরা জেল আপিলের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দি আসামিরা জেল আপিল করেন।

আসামিদের করা আপিল, জেল আপিল, ডেথ রেফারেন্স, মামলার রায় ও যাবতীয় নথি যাচাই-বাছাই করে পেপারবুক তৈরির জন্য সেসব পাঠানো হয় সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসে। সেখানে পেপারবুকটি প্রণয়ন করা হয়।

এরপর ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট পেপারবুক এসে পৌঁছায় সুপ্রিম কোর্টে।  তা আরেক দফা যাচাই-বাছাই শেষে শুনানির জন্য পেপারবুকটি প্রস্তুত করা হয়।