রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ২১ অগাস্টের হামলা: বিচারক

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করতেই যে ১৪ বছর আগে ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তা উঠে এসেছে ২১ অগাস্ট মামলার রায়ে।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2018, 01:44 PM
Updated : 10 Oct 2018, 02:00 PM

২০০৪ সালের ওই ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও একজন উপমন্ত্রীসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তার রাজনৈতিক উপদেষ্টাসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়ে বিচারক বলেছেন, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে ওই ধরনের ‘নৃশংস ও ন্যক্কারজনক’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলে আদালত মনে করে।

বুধবার ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ওই ধরনের হামলা হলে সাধারণ মানুষ ‘রাজনীতিবিমুখ’ হবে।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রায় গ্রেনেড হামলার ওই ঘটনায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন; আহত হন কয়েকশ নেতাকর্মী।

সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।

শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতেই যে এই হামলা হয়েছিল এবং তাতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে এ মামলার তদন্তে উঠে আসে।

‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ওই হামলায় যুদ্ধে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে বিচারক বলেন, “প্রশ্ন ওঠে, কেন এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার? রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের উপর পৈশাচিক আক্রমণ?

“শুধু আক্রমণই নয়, দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”

তিন মামলায় সাজার রায় মাথায় নিয়ে তারেক রহমান আছেন যুক্তরাজ্যে

লুৎফুজ্জামান বাবর দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারাও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি

 

অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় এ মামলার রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক।

সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

এছাড়া এ মামলার আসামি সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ১১ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন রায়ে বলেন, “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকবেন, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।”

দণ্ডবিধিতে করা হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলার রায়ে ১৪টি বিষয়কে বিবেচ্য হিসাবে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, প্রসিকিউশন পক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে ‘পরিকল্পিত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।

২১ অগাস্ট শেখ হাসিনার বক্তৃতার শেষ হওয়া মাত্র শুরু হয় গ্রেনেড হামলা

রায়ের পর্যালোচনায় তিনি বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ‘পরাজিত শক্তি’ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ওই হত্যাকাণ্ডের পর চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। এরপরও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।

“পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাশতা করানো হবে’- এই উদ্ধৃতি দিয়ে দেশীয় জঙ্গী সংগঠনের কতিপয় সদস্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় হামলা করে।”

বিচারক বলেন, “সাধারণ জনগণ এ রাজনীতি চায় না। সাধারণ জনগণ চায়, যে কোনো রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে সে দলের নীতি, আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ধারণ করতে। আর সমাবেশে আর্জেস বিস্ফোরণ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে পরবর্তীতে দেশের জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।”

গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে তার চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা পর্যালোচনা করার কথাও বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, বনানীর যে বাড়িটি ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত, তা ওই সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কি না, সেখানে তারেক রহমান ষড়যন্ত্রের সভা করেছিলেন কি-না, জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করেছে কি না- সেসব বিষয়ও বিবেচনা করা হয়েছে রায়ে।

২১ অগাস্টের হামলার পাশাপাশি সিলেটের শাহজাহালের মাজারে বোমা হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী এস এম কিবরিয়ার ওপর হামলা এবং রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মত ঘটনায় ‘পুনরাবৃত্তি’ আদালত চায় না বলেও রায়ে মন্তব্য করেন বিচারক বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।