ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দলটিকে ‘নেতৃত্বশূন্য’ করার চেষ্টার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে আদালতে।
Published : 10 Oct 2018, 12:41 PM
আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এছাড়া এ মামলার আসামি ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।
২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ওই গ্রেনেড হামলার ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।
আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে সময় ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা। আর সেই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাগারে দুর্নীতি মামলার সাজা ভোগ করছেন।
দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় ঘোষণা করে বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
তিনি বলেন, “রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”
বিএনপি আমলে ওই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে নানা চেষ্টা হয়। হামলার পরপরই নষ্ট করে ফেলা হয় আলামত।
পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হলে ‘প্রকৃত তথ্য’ বেরিয়ে আসতে থাকে। উদঘাটিত হয় ‘জজ মিয়া নাটক’।
বিএনপি বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে এসেছে, তাদের কেউ ওই হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল না। বুধবার রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “বিএনপি মনে করে, এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রকাশ। আমরা এই ফরমায়েশি রায় প্রত্যাখ্যান করছি।”
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, তাকে ‘ফাঁসিয়ে দেওয়া’ হয়েছে।
আর আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া এই রায়কে ‘অন্যায় ও বেআইনি’ আখ্যায়িত করে আপিল করার কথা বলেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, পুরো রায় দেখে তারা আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
দুই মামলায় মোট ৫২ আসামির বিচার শুরু হলেও অন্য মামলায় তিনজনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বুধবার রায় এসেছে মোট ৪৯ আসামির। অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে জানিয়ে তাদের সবাইকেই সাজা দিয়েছেন বিচারক।
এই ৪৯ আসামির মধ্যে আটজন রাজনৈতিক নেতা, পাঁচজন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং আট জন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। বাকি ৩১ জন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গি।
হত্যা মামলায় তাদের সবার নাম থাকলেও বিস্ফোরক আইনের মামলায় তাদের মধ্যে ৩৮ জন আসামি ছিলেন।
বাবর, পিন্টুসহ এ মামলার ৩১ আসামিকে রায়ের জন্য সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন একটি ভবনে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে নিয়ে আসা হয়। রায়ের পর আবার তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয় কারাগারে।
এর আগে দুই মামলায় সাত ও দশ বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমানসহ ১৮ জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কাজ চলে।
বাবর-পিন্টুর মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন তারেকের
যার যেমন সাজা
১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড |
# এই আসামিদের দণ্ডবিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। # দণ্ডবিধি ৩০৭ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। # বিস্ফোরক আইনের ৩ ও ৬ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। # বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর জখম করার দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ***সব মিলিয়ে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিই কার্যকর হবে। মৃত্যু পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে রায়ে। |
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী পিন্টুর ভাই হরকাতুল জিহাদ নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ শেখ আব্দুস সালাম কাশ্মিরী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলুবুল মো. জাহাঙ্গীর আলম হাফেজ মাওলানা আবু তাহের হোসাইন আহমেদ তামিম মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল মো. রফিকুল ইসলাম সবুজ মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন *** |
১৯ জনের যাবজ্জীবন |
# দণ্ডবিধি ৩০২, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে # দণ্ডবিধি ৩০৭, ১২০ খ, ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জনিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। # বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের ৩ ও ৬ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। # বিস্ফোরক আইনের ৪ ও ৬ ধারায় ২০ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। *** সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে এই ১৯ আসামির ক্ষেত্রে কেবল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কার্যকর হবে। |
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ হরকাতুল জিহাদ নেতা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে পীর সাহেব মো. খলিল মুফতি শফিকুর রহমান মুফতি আব্দুল হাই বাবু ওরফে রাতুল বাবু শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল আরিফ হাসান সুমন মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন জাহাঙ্গীর আলম বদর মো. ইকবাল আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার লিটন ওরফে মাওলানা লিটন *** |
১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড |
চার জনের ৩ বছরের জেল সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, মামলার প্রথম দিকের তদন্ত কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ। [দণ্ডবিধির দুটি ধারায় এই চারজনের ৩ বছর ও ২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুই সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে তাদের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে তিন বছরের সাজা প্রযোজ্য হবে।] |
পাঁচ জনের ২ বছরের কারাদণ্ড সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও আইজিপি শহিদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক এটিএম আমিন আহমদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার। [দণ্ডবিধির দুটি ধারায় তাদের দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুই সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে তাদের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে দুই বছরের সাজা প্রযোজ্য হবে।] |
দুই জনের ২ বছরের কারাদণ্ড পুলিশের সাবেক উপ কমিশনার (পূর্ব) মো. ওবায়দুর রহমান এবং উপ কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাইদ হাসান। [দণ্ডবিধির তিনটি ধারায় তাদের দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সব সাজা একযোগে কার্যকর হবে বলে তাদের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে দুই বছরের সাজা প্রযোজ্য হবে।] |
*** কারাদণ্ডের আসামিদের হাজতবাসকালীন সময় সাজা থেকে বাদ যাবে। ৩০ দিনের মধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে।
আদালতের পরিবেশ
এ রায় ঘিরে সকাল থেকেই নাজিমউদ্দিন রোড ও আশপাশের এলাকায় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন।
এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন বেলা সোয়া ১০টার পর নিজের খাসকামরায় আসেন। এর ১৫ মিনিটের মাথায় দোতলার এজলাসে আসেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান, আবু আব্দুল্লাহ ভূঞা ও মোশাররফ হোসেন কাজল।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি, আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী নেতা শ ম রেজাউল করিমও পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে আদালতে ছিলেন আব্দুস সোবহান তরফদার, সানাউল্লাহ মিয়া, নজরুল ইসলাম ও জয়নুল আবেদিন মেজবাহ।
পলাতক তারেক রহমানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী এ কে এম আখতার হোসেনসহ অন্য পলাতক আসামির রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবীরাও সেখানে ছিলেন।
বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে এজলাসে এসে রায় পড়া শুরু করেন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। দুই দফা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মধ্যে ১২টা ২০ মিনিটে রায় পড়া শেষ করেন তিনি।
রায় পড়া শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে গেলে চার্জড লাইট দিয়ে রায় পড়া চালিয়ে যান বিচারক। আদালতের ৪৫ মিনিটের কার্যক্রমের বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুৎ ছিল না।
উপস্থিত আসামিদের অধিকাংশই মনোযোগ দিয়ে রায় শুনছিলেন। সাজা ঘোষণার পর মুফতি হান্নানের ভাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভিকে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসতে দেখা যায়।
এজলাস কক্ষের মধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, যিনি এর আগে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাতেও একই সাজা পেয়েছেন।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “আমার মুখ দিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম বের করতে না পারায় আমাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
সেদিন যা ঘটেছিল ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।
|
হামলায় আহতদের সাহায্য করতে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাকর্মীরা যখন ছুটে গেলেন, তখন পুলিশ তাদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে। পুলিশ সে সময় হামলার আলামত সংগ্রহ না করে তা নষ্ট করতে উদ্যোগী হয়েছিল বলেও পরে অভিযোগ ওঠে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন। মঞ্চে উপস্থিত নেতাকর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। ‘আইভী রহমানের চোখে সেই শূন্য দৃষ্টি আমি ভুলতে পারি না’ ২১ অগাস্ট: যেভাবে সেদিন রক্ষা পান শেখ হাসিনা সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। ২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। |
মামলা বৃত্তান্ত
হামলার পরদিন মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। থানা পুলিশ, ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি এই মামলার তদন্তভার পায়।
ঘটনার চার বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যার অভিযোগ এবং বিস্ফোরক আইনে আলাদা দুটি অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।
জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে সেখানে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে তাদের বিচারও শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে।
সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।
সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চার দলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে।
জামিনে ও কারাগারে থাকা ৩১ আসামির সবাই আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ২০ জন।
রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ এজলাসে ১২০ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলা দুটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু জানান, দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার বিচার কাজ একই সঙ্গে চলে। সব মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৪৫৪ কার্যদিবস আদালত বসেছে এ মামলা শোনার জন্য।
মামলার সাক্ষীদের মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ১৪ জন। আর আসামিদের মধ্যে ১৩ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
দুই মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন গত ১৮ সেপ্টেম্বর রায়ের এই দিন ঠিক করে দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এ মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে অধিকতর তদন্তে উঠে আসে। জানা যায়, হামলার বিষয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেওয়ার বিষয়টি ছিল নাটক।
সম্পূরক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট হামলার পর থেকেই তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে কাজ শুরু করে। হামলার অনেক আলামত সে সময় নষ্ট করে ফেলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতারা তদন্তের শুরুতে এ হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত বলেও সে সময় প্রচার চালানো হয়েছিল।
হামলার পর ২০০৪ সালেই বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল চারদলীয় জোট সরকার। ৪০ দিনের মাথায় ওই কমিশনের দেওয়া ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থা ওই হামলায় জড়িত।
পরের বছর নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার কাছ থেকে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।
আদালতে সেই সাজানো জবানবন্দিতে জজ মিয়া বলেছিলেন, সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদের নির্দেশে তিনি পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে অন্যদের সঙ্গে ওই হামলায় অংশ নেন।
কিন্তু বিএনপির সেই সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে ২০০৬ সালের অগাস্টে জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তার ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সিআইডিই তাদের ভরণপোষণের টাকা দিয়ে আসছিল। জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী হওয়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনার চার বছর পর তদন্তে হাত দিয়ে আবদুল কাহার আকন্দ এই হামলার পেছনের ঘটনা তুলে আনেন, দেন সম্পূরক অভিযোগপত্র। সেখানে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে গ্রেনেড হামলার পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
সিআইডির এই কর্মকর্তার তদন্তেই শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের সম্পৃক্ততা উঠে আসে।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ মামলায় মূল রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঘটনার পরিকল্পনাকারীদেরও ওই অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
“দেশ তখন পরিচালিত হচ্ছিল হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে ছিলেন তারেক রহমান। তিনি যেভাবে চালাতেন, সেভাবে কাজ হত। তারেক রহমান পাওয়ারে থাকায় ওই কুটিল চক্র তার কাছে যায়। আর ওসব ব্যক্তির (জঙ্গি) সঙ্গে তারেক রহমানের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।”
বিচারক তার রায়ে বলেছেন, বনানীর যে বাড়িটি ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত, তা ওই সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কি না, সেখানে তারেক রহমান ষড়যন্ত্রের সভা করেছিলেন কি-না, জঙ্গি নেতারা তারেক রহমানের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করেছে কি না- সেসবসহ মোট ১৪টি বিষয় বিবেচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এ মামলায় মোট ৫২ জনের বিচার শুরু করেছিল আদালত। তাদের মধ্যে সাবেক জোট সরকাররের মন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
এছাড়া অন্য মামলায় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল বিপুলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে।
বাকি আসামিদের মধ্যে তারেক রহমান মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছর এবং জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন গত দশ বছর ধরে। তিনিসহ ২১ অগাস্ট মামলার ১৮ দণ্ডিত আসামি পলাতক।
তারেক রহমান ছাড়া এ মামলার পলাতক আসামিরা হলেন- হারিছ চৌধুরী, সেনা কর্মকর্তা এটিএম আমিন আহমদ ও সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা খান সাঈদ হাসান ও ওবায়দুর রহমান খান, হরকাতুল জিহাদের নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গির আলম বদর, ইকবাল, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের, মুফতি শফিকুর রহমান ও রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু। তাদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশে আটক হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
আরও পড়ুন