৭ ও ১০ বছর সাজার পর এবার তারেকের যাবজ্জীবন

বিএনপিরকর্মীদের চোখে দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি তারেক রহমানের তৃতীয় মামলায় কারাদণ্ড হল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2018, 02:21 PM
Updated : 10 Oct 2018, 02:29 PM

আগের দুটি মামলায় তার যথাক্রমে ৭ ও ১০ বছর কারাদণ্ড হলেও তা ছাপিয়ে একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় তার সাজা হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

লন্ডনে থাকা তারেককে পলাতক দেখিয়েই শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলাটির এই রায় দিয়েছে ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল। তাতে তারেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন হয়েছে ১৯ জনের; মৃত্যুদণ্ড হয়েছে লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের। 

হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুই মামলার প্রতিটিতে কয়েকটি ধারায় খালেদা জিয়ার ছেলেকে তিনবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিস্ফোরক আইনের আরেকটি ধারায় তার ২০ বছর কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে।

তবে সবগুলো সাজা একসঙ্গে কার্যকরের উল্লেখ থাকায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেককে যাবজ্জীবন সাজাই খাটতে হবে। পলাতক হওয়ায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগও পাচ্ছেন না তিনি।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মা খালেদা জিয়া আরেকটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে কারাগারে থাকার মধ্যে তারেকের বিরুদ্ধে আরেক মামলার রায় হল।

তারেক রহমানের ফাঁসি চাইছেন গ্রেনেড হামলায় আহতরা

এক দশক ধরে লন্ডনে আছেন তারেক রহমান

এই রায় প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলেছে, তাদের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় সরকারের ফরমায়েশি রায় দিয়েছেন বিচারক।

রায় প্রত্যাখ্যান করে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিক্ষোভ এবং আগামী ১৬ অক্টোবর কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচিও দিয়েছে তারেকের দল বিএনপি।

অন্যদিকে এই রায়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা তারেকের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রত্যাশা করেছিল। সেই শাস্তির জন্য রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ইঙ্গিতও দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তারেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা অনেকগুলো মামলার মধ্যে মুদ্রা পাচারের মামলায় ২০১৩ সালে প্রথম রায়টি হয় এবং তাতে তিনি খালাস পেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলের পর হাই কোর্টের রায়ে ৭ বছরের দণ্ডাদেশ হয়।

তার পাঁচ বছর পর চলত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় মায়ের সঙ্গে তারেকের কারাদণ্ডের রায় হয়। খালেদার হয় পাঁচ বছর কারাদণ্ড, তারেকের হয় ১০ বছর সাজা।

এরপরই রায়ের পর্যায়ে আসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় একুশে অগাস্টের গ্রেনেড হামলার মামলাটি।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন।

গ্রেনেড হামলায় রক্তাক্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, যাদের অনেকের জীবনে ফেরা হয়নি

শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালানো হয়েছিল বলে আওয়ামী লীগ নেতারা তখনই অভিযোগ তুলেছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে কীভাবে জঙ্গিদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিনাশের ওই চেষ্টা চালানো হয়েছিল।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করতেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সমাবেশে ওই গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, তা উঠে এসেছে বিচারকের রায়েও।

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন তারেক; খালেদার রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বসে তিনি সব নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার আগে হাওয়া ভবনে তারেকের সঙ্গে জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের সাক্ষাৎ এবং হত্যার পরিকল্পনার কথা উঠে আসে তদন্তে।

রায়ের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “সে সময় বনানীর হাওয়া ভবন থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হত। তখন বেগম জিয়ার সরকার ক্ষমতায়, হাওয়া ভবন বিকল্প পাওয়ার সেন্টার ছিল। মুফতি হান্নান নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছে যে, অপারেশন চালানোর পূর্ব মুহূর্তে তারেক রহমানের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল।”

এই মামলায় দণ্ডিতদের মধ্যে সাবেক তিন পুলিশ প্রধান, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক দুই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও রয়েছেন; যা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ষড়যন্ত্রে ব্যবহারের প্রমাণ।

তবে বিএনপি এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দকে নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলে আসছে।

রায়ের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জাতির দুর্ভাগ্য, এই সরকার তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার জন্যেই আদালতকে ব্যবহার করে আরেকটি মন্দ দৃষ্টান্ত  স্থাপন করল, যেমনটি করেছে মিথ্যা মামলায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাদণ্ড দিয়ে।”

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য তারেক রহমানের বিবৃতি প্রচারে রয়েছে আদালতের নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থী তারেক রহমানকে দেখা যায় দলের নানা অনুষ্ঠানে

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে পরের বছর মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্য যাওয়া তারেক সেখানে নানা সভা-সমাবেশে দেশের স্বাধীনতার মৌলিক কিছু বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার পর তার বার্তা-বিবৃতি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেয় হাই কোর্ট।

তবে বিএনপি নেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই দলের পরিকল্পনা সাজিয়ে আসছেন। এমনকি গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বন্দি হওয়ার পর তারেককে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার কথাও জানানো হয়েছিল।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেকের রাজনীতিতে আসা ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর। বগুড়া জেলার প্রাথমিক সদস্যপদ নেওয়ার পর তার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তৈরি করা হয় জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব পদ। সর্বশেষ কাউন্সিলে জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টির পর সেখানে তারেককে বসিয়ে খালেদা জিয়ার পরে দলে দ্বিতীয় স্থানটিতে আনা হয় তাকে।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছেলে তারেক রহমান

স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে যাওয়ার পর তারেকের দেশে ফেরার কথা বিএনপি নেতারা বলে এলেও নির্দিষ্ট করে কোনো সময় কখনও বলেনি। মামলাগুলোর রায়ের পর এখন এলে তার সামনে থাকছে কারাগার; ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত বলে ভোট করার অযোগ্যও তিনি।

আবার যুক্তরাজ্যে থাকা তারেকের হাতে এখন বাংলাদেশি পাসপোর্টও নেই। রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য তিনি পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করায় তিনি এখন বাংলাদেশের নাগরিকও নন বলে সরকারের দাবি; যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, তারেক পাসপোর্ট যুক্তরাজ্য সরকারকে জমা দিলেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছাড়েননি।

নানা ঘটনায় বিতর্কিত ও সমালোচিত তারেক এখন আদালতে দণ্ডিত হলেও বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের কাছে এখনও ৫০ বছর বয়সী তারেকেই দলের প্রতীক।