এটি তেমন একটি ঘটনা, যা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না।
এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই আইভী রহমানের শূন্য দৃষ্টি, আদা চাচার নিথর দেহ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ, চাপ চাপ রক্ত আর মানুষের আর্ত চিৎকার।
১৪ বছর আগে আমি তখন ‘ভোরের কাগজ’-এর স্টাফ রিপোর্টার। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আমি বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছিলাম। সেদিন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা হওয়ার কথা ছিল।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে শেষ হবে ধানমণ্ডির রাসেল স্কয়ারে। সাংবাদিকরা বিকাল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে একটি ট্রাক এনে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে আগেই। শোভাযাত্রার আগে যথারীতি একটা সমাবেশ হবে। একসময় শুরুও হল।
আমরা সাংবাদিকরা অপেক্ষায় ছিলাম শেখ হাসিনার বক্তব্যের জন্য। বিকাল ৫টার কিছুক্ষণ আগে তিনি এলেন। বক্তৃতা শুরু করলেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউ তখন লোকে লোকারণ্য। আমরা সাংবাদিকরা রমনা ভবনের সিঁড়িতে বসে শেখ হাসিনার বক্তৃতার নোট নিচ্ছি।
শেখ হাসিনা তার বক্তৃতা শেষ করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান শেষ করতে পারলেন না, এর মধ্যেই যেন শুরু হয়ে গেল প্রলয়।
কী হচ্ছে দেখার জন্য দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম বিকট আওয়াজ। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি গ্রেনেড হামলা হচ্ছে। এরপর আরেকটা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পেলাম। তারপর আরেকটা। আমরা গোণার চেষ্টা করলাম, কটা বিস্ফোরণ হল।
বিকট শব্দের মধ্যে গুলির আওয়াজও পেলাম। তবে ঘটনার ভয়াবহতা তখনও বুঝতে পারিনি। রমনা ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখলাম, ভাষণ শুনতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আসা মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌঁড়াচ্ছে।
আমরা সাংবাদিকরা পড়িমরি করে রমনা ভবনের দোতলায় চলে গেলাম। জনকণ্ঠের উত্তম চক্রবর্তী ও সংবাদের সালাম জুবায়েরকে বাইরে রেখেই এর মধ্যে কখন যেন রমনা ভবনের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেওয়া হল।
আমি, ইউএনবির ফরিদ আহমেদ (সাজু) ও শেখ হাসিনার প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ দোতলা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছি তখন। আর গুণে যাচ্ছি- দশ, এগারো, বারো..। এভাবে তেরো পর্যন্ত গুণলাম। আর কোনো আওয়াজ নেই।
আমরা তিনজন নিচে নেমে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যা দেখলাম তা লিখে বোঝানো যাবে না।
শত শত জোড়া জুতা, স্যান্ডেল রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।
পড়ে আছে মানুষের নিথর দেহ। রক্ত, দেহের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
চারপাশে আহতদের আর্তনাদে ভয়াবহ এক পরিস্থিতি।
হঠাৎ মনে হলো শেখ হাসিনার গাড়িতো আশেপাশে নেই!
আমাদের দেখতে পেয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, “আপা নাই, আপারে নিয়া গেছে ..।”
জীবনের কথা শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ টিয়ার শেল মারতে শুরু করল। আমরা দৌড়ে গেলাম গোলাপ শাহর মাজারের কাছে।
দূর থেকে দেখতে পেলাম, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের সামনে জড়ো হওয়া লোকজন পুলিশকে ধাওয়া করলো। আমরাও আবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। নিজেকে মানসিকভাবে তৈরিই করে নিলাম খারাপ কিছুর জন্য।
দেখলাম সেখানে শেখ হাসিনার বুলেটপ্রুফ গাড়িটি নেই। ট্রাকের ওপর কয়েকজন নেতা পড়ে রয়েছেন। আব্দুল জলিলকে উঠে বসতে দেখলাম। তার সাদা পাঞ্জাবিজুড়ে লাল লাল ছোপ। কয়েকজন মিলে তাকে ধরে ট্রাক থেকে নামিয়ে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে গেল। এরপর ট্রাক থেকে নামানো হলো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তার পুরো শরীর রক্তে লাল।
রমনা ভবনের সামনে দুটি লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। একজনের পা নেই। চারদিকে রক্ত। তার পাশেই আরেকটি মৃতদেহ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে তার পুরো শরীর কেউ থেঁতলে দিয়েছে।
একটু সামনেই রমনা ভবনের এক দোকানের সামনে দেখতে পেলাম আদা চাচার নিথর দেহ। স্থির দৃষ্টি। দেখে মনে হচ্ছে, দোকানের শাটারে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছেন।
আইভী রহমান বসে আছেন। কিন্তু তার পা দুখানি অদৃশ্য। থোক থোক রক্ত আর থেঁতলানো মাংসের চাক। মনে হলো আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু চোখে কোনো ভাষা নেই।
সেই দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। চোখ বুঝলে এখনও দেখি আইভী রহমানের সেই শূন্য দৃষ্টি।
একটা ছেলে আইভী রহমানকে তুলতে চেষ্টা করছিল। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না দেখে ছেলেটা চিৎকার করে যাচ্ছে। সামনে আরও কয়েকজন মহিলার নিস্প্রাণ দেহ। ওয়ার্ড কমিশনার দিপ্তী প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তারও পুরো শরীর রক্তে লাল।
আর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে যাওয়া হল না। কারো ডাকে রমনা ভবনের পূর্ব দিকের গলির দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জুতা আর স্যান্ডেলের মধ্যে একটা গ্রেনেড পড়ে আছে। বুঝলাম, এতক্ষণ এই গ্রেনেড দিয়েই হামলা হয়েছে।
[২০০৮ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ঈষৎ সম্পাদিত আকারে পুনঃপ্রকাশ করা হল।]